বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪১৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। লিয়াকত আলী খান, বীর উত্তম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বীরযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধকালের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ গৌরীপুরের যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সেখানে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
গৌরীপুর সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার (তখন থানা) অন্তর্গত। জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সড়কে সুরমা নদীর তীরে থানা সদরের অবস্থান। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে। অবস্থানগত কারণে ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী উভয়ের কাছেই কানাইঘাট ছিল সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কানাইঘাটে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক অবস্থান। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল তাদের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। আরও ছিল মিলিশিয়া ও রাজাকার। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এটিই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্মুখ প্রতিরক্ষা লাইন। কারণ, তখন কানাইঘাটের অগ্রবর্তী এলাকা জকিগঞ্জ, আটগ্রাম, চারগ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।
জকিগঞ্জ, আটগ্রাম, চারগ্রাম দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকেন সিলেট অভিমুখে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলে ছিলেন লিয়াকত আলী খান। ২৫ নভেম্বর তাঁরা কানাইঘাট থানা সদরের দুই মাইল অদূরে গৌরীপুরে পৌঁছেন। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। কানাইঘাটে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তাঁরা গৌরীপুরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।
২৬ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে (আলফা কোম্পানি) আক্রমণ করে। এ রকম অবস্থায় পাল্টা আক্রমণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকেন। কিন্তু বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরও তাঁদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা দলের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (বীর উত্তম)। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ মোকাবিলা করছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শাহাদতবরণ করেন। এ অবস্থায় লিয়াকত আলী খান যুদ্ধক্ষেত্রে অধিনায়কের দায়িত্ব পান। একপর্যায়ে তিনিও শত্রুর গুলিতে আহত হন।
এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর) বয়ানে। তিনি বলেন, ‘ভোরে পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাদের ‘এ’ কোম্পানির পজিশনের ওপর আক্রমণ করে। ‘এ’ কোম্পানি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়।
‘এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেনসহ ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ক্যাপ্টেন মাহবুবসহ ১০-১১ জন শহীদ এবং প্রায় ২০ জন আহত হন। ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হওয়ার পর তদস্থলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী ওই কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। এ ধরনের পদাতিক যুদ্ধে তাঁর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। একটু পরে তিনি শত্রুর বুলেটে আহত হন। আহত অবস্থায়ই তিনি অনেকক্ষণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।’
লিয়াকত আলী খান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের শেষে বাবার অসুস্থতার কথা বলে বাংলাদেশে আসেন। কয়েকদিন পর ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিছুদিন পর তাঁকে নিয়মিত বাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য লিয়াকত আলী খানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬৩।
লিয়াকত আলী খানকে ১৯৭৫ সালে ক্যু, পাল্টা ক্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। পরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করেন। এরপর বাংলাদেশ বিমানে বৈমানিক হিসেবে চাকরি করেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিমান সংস্থায় কর্মরত।
লিয়াকত আলী খানের পৈতৃক বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। বাগেরহাট পৌরসভার অন্তর্গত সরাই রোডের আমলাপাড়ায়। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার উত্তরায়। তাঁর বাবার নাম আতাহার আলী খান, মা আজিজা খাতুন। স্ত্রী নাজমা আনোয়ার বেগম। তাঁদের এক মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
কানাইঘাটে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক অবস্থান। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল তাদের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। আরও ছিল মিলিশিয়া ও রাজাকার। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এটিই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্মুখ প্রতিরক্ষা লাইন। কারণ, তখন কানাইঘাটের অগ্রবর্তী এলাকা জকিগঞ্জ, আটগ্রাম, চারগ্রাম মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে।
জকিগঞ্জ, আটগ্রাম, চারগ্রাম দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যেতে থাকেন সিলেট অভিমুখে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলে ছিলেন লিয়াকত আলী খান। ২৫ নভেম্বর তাঁরা কানাইঘাট থানা সদরের দুই মাইল অদূরে গৌরীপুরে পৌঁছেন। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। কানাইঘাটে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তাঁরা গৌরীপুরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।
২৬ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে (আলফা কোম্পানি) আক্রমণ করে। এ রকম অবস্থায় পাল্টা আক্রমণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকেন। কিন্তু বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরও তাঁদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা দলের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (বীর উত্তম)। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ মোকাবিলা করছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শাহাদতবরণ করেন। এ অবস্থায় লিয়াকত আলী খান যুদ্ধক্ষেত্রে অধিনায়কের দায়িত্ব পান। একপর্যায়ে তিনিও শত্রুর গুলিতে আহত হন।
এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর) বয়ানে। তিনি বলেন, ‘ভোরে পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাদের ‘এ’ কোম্পানির পজিশনের ওপর আক্রমণ করে। ‘এ’ কোম্পানি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়।
‘এ যুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেনসহ ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ক্যাপ্টেন মাহবুবসহ ১০-১১ জন শহীদ এবং প্রায় ২০ জন আহত হন। ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হওয়ার পর তদস্থলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী ওই কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সাবেক পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের পাইলট ছিলেন। এ ধরনের পদাতিক যুদ্ধে তাঁর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। একটু পরে তিনি শত্রুর বুলেটে আহত হন। আহত অবস্থায়ই তিনি অনেকক্ষণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।’
লিয়াকত আলী খান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের শেষে বাবার অসুস্থতার কথা বলে বাংলাদেশে আসেন। কয়েকদিন পর ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কিছুদিন পর তাঁকে নিয়মিত বাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য লিয়াকত আলী খানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬৩।
লিয়াকত আলী খানকে ১৯৭৫ সালে ক্যু, পাল্টা ক্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। পরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করেন। এরপর বাংলাদেশ বিমানে বৈমানিক হিসেবে চাকরি করেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিমান সংস্থায় কর্মরত।
লিয়াকত আলী খানের পৈতৃক বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। বাগেরহাট পৌরসভার অন্তর্গত সরাই রোডের আমলাপাড়ায়। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার উত্তরায়। তাঁর বাবার নাম আতাহার আলী খান, মা আজিজা খাতুন। স্ত্রী নাজমা আনোয়ার বেগম। তাঁদের এক মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments