সপ্তাহের হালচাল-সংবিধান সংশোধন: কে কত কাজের কাজি by আব্দুল কাইয়ুম
সংবিধান সংশোধনীর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন, তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এ পর্যন্ত যত সংশোধনী এসেছে, সেগুলো একতরফাভাবে ক্ষমতাসীন দলই করেছে। বিরোধী দলের পরামর্শ নেওয়ার কথা কেউ ভাবেনি। ব্যতিক্রম ছিল শুধু একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী।
১৯৯১ সালে সার্বভৌম সংসদ ও সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার জন্য বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতৈক্যের ভিত্তিতে সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে এ দুটি সংশোধনী গৃহীত হয়। এবার যদি সংসদীয় কমিটিতে মতৈক্যের ভিত্তিতে সংবিধানের সংশোধনী গৃহীত হয়, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে আমাদের গণতন্ত্রের পথে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।
প্রথম কাজ হবে সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের কমিটিতে পূর্ণ মর্যাদায় রাখা। তাঁদের কথা শোনা। সুপারিশগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা। আওয়ামী লীগ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সবকিছু করতে চায় আর কমিটিকে লোক দেখানো ব্যাপারে পরিণত করে, তাহলে উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। বিএনপিকে কোনোভাবেই বাইরে রাখা যাবে না। শুধু বিএনপি না, জাতীয় পার্টিকেও জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রাখা দরকার। কারণ, এরাই সেই দুই দল, যারা স্বাধীনতা-উত্তরকালে দুই দফায় সামরিক শাসন চালিয়েছিল। আর পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় মূলত সামরিক শাসনবিরাধী। তাই এই সংশোধনীতে তাদের সম্মতি ও সক্রিয় অবদান থাকাটা জরুরি।
প্রশ্ন হলো, কমিটিতে বিএনপি থাকতে রাজি হবে কি না। তারা এ ব্যাপারে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে। আমরা ইতিবাচক সিদ্ধান্তই আশা করব। যদি তারা কমিটিতে না থাকার কথা ভাবে, সেটা হবে দুঃখজনক ব্যাপার। বিএনপি তো দাবি করে যে তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। তা-ই যদি হয়, তাহলে তো তাদের সদলবলে এই সংবিধান সংশোধনীতে যোগ দেওয়া দরকার। এটা তাদের সংসদ অধিবেশনে ফিরে যাওয়ার একটি মোক্ষম উপলক্ষ হতে পারে। তাদের সংসদে গ্যাঁট মেরে বসে দাবি করা উচিত যে এটা তাদের এজেন্ডা। কারণ তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। সুতরাং পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের রায়কে তাদের সানন্দে বরণ করে নেওয়া দরকার। তারা এখন জোরগলায় বলুক যে আর কখনো কোনো শক্তিকে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিপন্ন করতে দেওয়া হবে না। বহুদলীয় গণতন্ত্র নিরবচ্ছিন্ন রাখার ব্যাপারে তারা যে কত বড় কাজের কাজি, সেটা প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ তাদের সামনে এসেছে।
এ ব্যাপারে যদি মতৈক্য হয় তাহলে আমরা বলব, সংশোধনীতে এমন একটা বিধান রাখা উচিত যেন ভবিষ্যতে সংবিধানবহির্ভূত পথে কেউ ক্ষমতা দখল করার সাহস না পায়। এটা কি করা সম্ভব? নিশ্চয়ই সম্ভব। সোজা বাংলায় লিখে দেওয়া হোক যে ভবিষ্যতে যদি কেউ বন্দুকের জোরে বা বলপ্রয়োগে সামরিক শাসন জারি করে, সংবিধান স্থগিত রাখে, তাহলে তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যখনই জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরে আসবে, তখনই অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের সম্মুখীন করা যাবে। এ জন্য আদালতের অতিরিক্ত কোনো রায়ের প্রয়োজন হবে না।
এই বিধানটা যোগ করা দরকার এ জন্য যে পঁচাত্তর-উত্তর সামরিক শাসকেরা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বলে তাঁদের অবৈধ শাসন জায়েজ করিয়ে নিয়েছিলেন। এবং সেই অবৈধ জিনিসটাকে অবৈধ ঘোষণার জন্য ২৫-৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলকারীদের আর এই সুযোগ দেওয়া যাবে না। যদি কেউ সংবিধান-বহির্ভূতভাবে ক্ষমতায় আসেন, তাঁকে বিচার ও শায়েস্তা করার বিধান সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লিখে রাখা হোক।
দ্বিতীয় আরেকটি সংশোধনী দরকার। সেটা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কোনো অজুহাতেই তিন মাসের বেশি হতে পারবে না। কমিটি যদি সর্বসম্মতিক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পরিসমাপ্তি চায়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি ব্যবস্থাটি অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করতে হবে। ওয়ান-ইলেভেন নামে খ্যাত বা অখ্যাত সরকার যে দুই বছর থাকতে পেরেছে, সেটা সম্ভব হয়েছে আইনে কিছু ফাঁকফোকরের সুযোগে। ওগুলো বন্ধ করতে হবে। সংবিধানের ৫৮খ (১) অনুচ্ছেদের দিকে নজর দিন। এটাই যত নষ্টের গোড়া। সেখানে বলা হয়েছে, ‘...নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁহার পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকিবে।’ ৫৮গ (১২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নতুন সংসদ গঠিত হইবার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তাঁহার পদের কার্যভার গ্রহণ করেন, সেই তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হইবে।’ সমস্যাটা হলো, নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন না, আর তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও যায় না! এভাবে দুই বছর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকল সংবিধানসম্মত উপায়েই। এই ফাঁক বন্ধ করতে হবে।
কীভাবে? খুব সোজা। লিখে দেওয়া হোক যে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায় নেবে। নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যেই যথেষ্টভাবে তার ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও করা হোক, যেন তারা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সুসম্পন্ন করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের কাজের ওপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ রাখা যাবে না। তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করবে।
এটা কি সম্ভব? খুব সম্ভব। আমেরিকায় যদি প্রতি চার বছর পর নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরদিন যে মঙ্গলবার, সেদিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে পারে এবং সেটা যুগ যুগ ধরে যদি অবিচলভাবে অনুসৃত হতে পারে, তাহলে আমরা কেন সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় এ কথাটা বলতে পারব না যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর তিন মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। হ্যাঁ, ব্যতিক্রমের একটা বিধান থাকতে পারে। যদি ভূমিকম্প বা ওই ধরনের কোনো কারণে সব ওলটপালট হয়ে যায়, যদি কিছু সময় লাগে, তাহলে সংবিধানের ১১৯ ও ১২৩ অনুচ্ছেদ কার্যকর হবে, যেখানে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো নিয়ম হতে পারে না।
গণতন্ত্র নিরঙ্কুশ করতে হলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদেরও মেরামত দরকার। অনেকে এ ব্যাপারে বাহাত্তরের সংবিধানের বিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। আমরা আরেকটু সংযোজন করে বলতে পারি, ৭০ অনুচ্ছেদটি এভাবে লেখা হোক যে শুধু বাজেট ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো প্রশ্নে সাংসদেরা স্বাধীনভাবে নিজ বিবেচনায় ভোট দিতে পারবেন। সেখানে কোনো হুইপিং খাটবে না। সাংসদদের এটুকু অধিকার না থাকলে কিসের গণতন্ত্র? মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে জীবন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সংসদে নিজ দলীয় সাংসদদের মত প্রকাশের অধিকার দিতে নারাজ! এটা হাস্যকর।
প্রায় ৪০ বছর আগে মস্কোতে কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায়ের জন্য এত ধর্মঘট, সংগ্রাম, বিপ্লব করে ক্ষমতায় যাওয়ার পর চীন-রাশিয়ায় শ্রমিকদের কেন ধর্মঘট করতে দেওয়া হয় না? উত্তরে তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণী তো রাষ্ট্রের মালিক, কোনো কারখানার মালিক কি ধর্মঘট করে! মনে হয়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারাও ওই ধরনের অকেজো যুক্তি আওড়ে চলেছেন। তাঁরাও হয়তো বলতে চান, বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য রাজপথে এত সংগ্রাম করে ক্ষমতায় এসেছি, এখন আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতার দরকার কী? এসব বস্তাপচা যুক্তি ঝেড়ে ফেলার সময় এসেছে।
একটা কথা স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় এসেছে যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর তো থাকে বাহাত্তরের সংবিধান, সেখানেই ফিরে যেতে হবে। কারণ, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আওয়ামী লীগ নিজেই পরিত্যাগ করেছে। আর তা ছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান ছিল প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক। কিন্তু যখন বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা ওঠে, তখন একদল রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক আর্তস্বরে চিৎকার শুরু করেন—গেল গেল, সব গেল; বিসমিল্লাহ থাকবে না, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে না, ইত্যাদি। এটা আসলে দেশের সরল সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটি অপকৌশল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা ধারণ করেই বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়েছিল। যাহা বাহাত্তর, তাহা যে আসলে একাত্তর, এই সরল সমীকরণটি অনেকের সহ্য হয় না। সে জন্যই তাদের আপত্তি। একাত্তরের জন্মসূত্রে ফিরে যাওয়ার জন্যই বাহাত্তরের সংবিধান দরকার। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। বাহাত্তরের সংবিধান মানে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা দেওয়া।
একাত্তরের সঙ্গে বাহাত্তরের এই সংযোগটা অনেকে খেয়াল করেন না। বাহাত্তরের সংবিধানের খসড়া উপস্থাপন করার সময় ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি জানি না, আপনাদের মেমোরি শর্ট কি না। বাংলার মানুষ ভুলে যায় কি না। কিন্তু এমন ইতিহাস আমরা পেয়েছি।...এদের পাশবিক অত্যাচার—পশুর মতো, বর্বরের মতো—যাতে হিটলারও লজ্জা পায়, যাতে হালাকু খানও লজ্জা পায়, যাতে চেঙ্গিস খানও লজ্জা পায়। অত্যাচার করেছে বাংলাদেশের মাটিতে। আজ বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্যরা সেই রক্তলেখা দিয়ে শাসনতন্ত্র দিতে চান। শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না’ (সংসদীয় কার্য বিবরণী, খণ্ড ২, সংখ্যা ১, পৃষ্ঠা ১৭)।
রক্তে লেখা বাহাত্তরের সংবিধান হুবহু ফিরিয়ে আনার কথা কেউ বলেন না। কিন্তু তার মূল সুরটি অবিকল থাকতে হবে। অসাম্প্রদায়িকতা, সার্বভৌম সংসদ—এককথায় সংসদীয় গণতন্ত্র। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সংবিধানের ওপর সামরিক কাঁচি চালানো হয়েছে। পরে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে সেগুলো সংবিধানে ঢোকানো হয়। ২০০৫ সালে হাইকোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পথে বাধা নেই। তবে অবশ্যই বাস্তবতা বিচারে কিছু সংযোজন-বিয়োজন দরকার, সে কথা আগেই বলেছি। সংসদের নেতাদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এখন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো প্রমাণ করুন কে কতটা দায়িত্বশীল।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
প্রথম কাজ হবে সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের কমিটিতে পূর্ণ মর্যাদায় রাখা। তাঁদের কথা শোনা। সুপারিশগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করা। আওয়ামী লীগ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সবকিছু করতে চায় আর কমিটিকে লোক দেখানো ব্যাপারে পরিণত করে, তাহলে উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। বিএনপিকে কোনোভাবেই বাইরে রাখা যাবে না। শুধু বিএনপি না, জাতীয় পার্টিকেও জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রাখা দরকার। কারণ, এরাই সেই দুই দল, যারা স্বাধীনতা-উত্তরকালে দুই দফায় সামরিক শাসন চালিয়েছিল। আর পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় মূলত সামরিক শাসনবিরাধী। তাই এই সংশোধনীতে তাদের সম্মতি ও সক্রিয় অবদান থাকাটা জরুরি।
প্রশ্ন হলো, কমিটিতে বিএনপি থাকতে রাজি হবে কি না। তারা এ ব্যাপারে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে। আমরা ইতিবাচক সিদ্ধান্তই আশা করব। যদি তারা কমিটিতে না থাকার কথা ভাবে, সেটা হবে দুঃখজনক ব্যাপার। বিএনপি তো দাবি করে যে তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। তা-ই যদি হয়, তাহলে তো তাদের সদলবলে এই সংবিধান সংশোধনীতে যোগ দেওয়া দরকার। এটা তাদের সংসদ অধিবেশনে ফিরে যাওয়ার একটি মোক্ষম উপলক্ষ হতে পারে। তাদের সংসদে গ্যাঁট মেরে বসে দাবি করা উচিত যে এটা তাদের এজেন্ডা। কারণ তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। সুতরাং পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের রায়কে তাদের সানন্দে বরণ করে নেওয়া দরকার। তারা এখন জোরগলায় বলুক যে আর কখনো কোনো শক্তিকে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিপন্ন করতে দেওয়া হবে না। বহুদলীয় গণতন্ত্র নিরবচ্ছিন্ন রাখার ব্যাপারে তারা যে কত বড় কাজের কাজি, সেটা প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ তাদের সামনে এসেছে।
এ ব্যাপারে যদি মতৈক্য হয় তাহলে আমরা বলব, সংশোধনীতে এমন একটা বিধান রাখা উচিত যেন ভবিষ্যতে সংবিধানবহির্ভূত পথে কেউ ক্ষমতা দখল করার সাহস না পায়। এটা কি করা সম্ভব? নিশ্চয়ই সম্ভব। সোজা বাংলায় লিখে দেওয়া হোক যে ভবিষ্যতে যদি কেউ বন্দুকের জোরে বা বলপ্রয়োগে সামরিক শাসন জারি করে, সংবিধান স্থগিত রাখে, তাহলে তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যখনই জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরে আসবে, তখনই অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের সম্মুখীন করা যাবে। এ জন্য আদালতের অতিরিক্ত কোনো রায়ের প্রয়োজন হবে না।
এই বিধানটা যোগ করা দরকার এ জন্য যে পঁচাত্তর-উত্তর সামরিক শাসকেরা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বলে তাঁদের অবৈধ শাসন জায়েজ করিয়ে নিয়েছিলেন। এবং সেই অবৈধ জিনিসটাকে অবৈধ ঘোষণার জন্য ২৫-৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলকারীদের আর এই সুযোগ দেওয়া যাবে না। যদি কেউ সংবিধান-বহির্ভূতভাবে ক্ষমতায় আসেন, তাঁকে বিচার ও শায়েস্তা করার বিধান সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে লিখে রাখা হোক।
দ্বিতীয় আরেকটি সংশোধনী দরকার। সেটা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কোনো অজুহাতেই তিন মাসের বেশি হতে পারবে না। কমিটি যদি সর্বসম্মতিক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পরিসমাপ্তি চায়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি ব্যবস্থাটি অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে তিন মাসের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করতে হবে। ওয়ান-ইলেভেন নামে খ্যাত বা অখ্যাত সরকার যে দুই বছর থাকতে পেরেছে, সেটা সম্ভব হয়েছে আইনে কিছু ফাঁকফোকরের সুযোগে। ওগুলো বন্ধ করতে হবে। সংবিধানের ৫৮খ (১) অনুচ্ছেদের দিকে নজর দিন। এটাই যত নষ্টের গোড়া। সেখানে বলা হয়েছে, ‘...নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁহার পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকিবে।’ ৫৮গ (১২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নতুন সংসদ গঠিত হইবার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তাঁহার পদের কার্যভার গ্রহণ করেন, সেই তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হইবে।’ সমস্যাটা হলো, নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন না, আর তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও যায় না! এভাবে দুই বছর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকল সংবিধানসম্মত উপায়েই। এই ফাঁক বন্ধ করতে হবে।
কীভাবে? খুব সোজা। লিখে দেওয়া হোক যে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায় নেবে। নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যেই যথেষ্টভাবে তার ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও করা হোক, যেন তারা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সুসম্পন্ন করতে পারে। নির্বাচন কমিশনের কাজের ওপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ রাখা যাবে না। তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করবে।
এটা কি সম্ভব? খুব সম্ভব। আমেরিকায় যদি প্রতি চার বছর পর নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরদিন যে মঙ্গলবার, সেদিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে পারে এবং সেটা যুগ যুগ ধরে যদি অবিচলভাবে অনুসৃত হতে পারে, তাহলে আমরা কেন সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় এ কথাটা বলতে পারব না যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর তিন মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। হ্যাঁ, ব্যতিক্রমের একটা বিধান থাকতে পারে। যদি ভূমিকম্প বা ওই ধরনের কোনো কারণে সব ওলটপালট হয়ে যায়, যদি কিছু সময় লাগে, তাহলে সংবিধানের ১১৯ ও ১২৩ অনুচ্ছেদ কার্যকর হবে, যেখানে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো নিয়ম হতে পারে না।
গণতন্ত্র নিরঙ্কুশ করতে হলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদেরও মেরামত দরকার। অনেকে এ ব্যাপারে বাহাত্তরের সংবিধানের বিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। আমরা আরেকটু সংযোজন করে বলতে পারি, ৭০ অনুচ্ছেদটি এভাবে লেখা হোক যে শুধু বাজেট ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো প্রশ্নে সাংসদেরা স্বাধীনভাবে নিজ বিবেচনায় ভোট দিতে পারবেন। সেখানে কোনো হুইপিং খাটবে না। সাংসদদের এটুকু অধিকার না থাকলে কিসের গণতন্ত্র? মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে জীবন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সংসদে নিজ দলীয় সাংসদদের মত প্রকাশের অধিকার দিতে নারাজ! এটা হাস্যকর।
প্রায় ৪০ বছর আগে মস্কোতে কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায়ের জন্য এত ধর্মঘট, সংগ্রাম, বিপ্লব করে ক্ষমতায় যাওয়ার পর চীন-রাশিয়ায় শ্রমিকদের কেন ধর্মঘট করতে দেওয়া হয় না? উত্তরে তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রে শ্রমিক শ্রেণী তো রাষ্ট্রের মালিক, কোনো কারখানার মালিক কি ধর্মঘট করে! মনে হয়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারাও ওই ধরনের অকেজো যুক্তি আওড়ে চলেছেন। তাঁরাও হয়তো বলতে চান, বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য রাজপথে এত সংগ্রাম করে ক্ষমতায় এসেছি, এখন আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতার দরকার কী? এসব বস্তাপচা যুক্তি ঝেড়ে ফেলার সময় এসেছে।
একটা কথা স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় এসেছে যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর তো থাকে বাহাত্তরের সংবিধান, সেখানেই ফিরে যেতে হবে। কারণ, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আওয়ামী লীগ নিজেই পরিত্যাগ করেছে। আর তা ছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান ছিল প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক। কিন্তু যখন বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা ওঠে, তখন একদল রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক আর্তস্বরে চিৎকার শুরু করেন—গেল গেল, সব গেল; বিসমিল্লাহ থাকবে না, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে না, ইত্যাদি। এটা আসলে দেশের সরল সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটি অপকৌশল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা ধারণ করেই বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়েছিল। যাহা বাহাত্তর, তাহা যে আসলে একাত্তর, এই সরল সমীকরণটি অনেকের সহ্য হয় না। সে জন্যই তাদের আপত্তি। একাত্তরের জন্মসূত্রে ফিরে যাওয়ার জন্যই বাহাত্তরের সংবিধান দরকার। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। বাহাত্তরের সংবিধান মানে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা দেওয়া।
একাত্তরের সঙ্গে বাহাত্তরের এই সংযোগটা অনেকে খেয়াল করেন না। বাহাত্তরের সংবিধানের খসড়া উপস্থাপন করার সময় ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি জানি না, আপনাদের মেমোরি শর্ট কি না। বাংলার মানুষ ভুলে যায় কি না। কিন্তু এমন ইতিহাস আমরা পেয়েছি।...এদের পাশবিক অত্যাচার—পশুর মতো, বর্বরের মতো—যাতে হিটলারও লজ্জা পায়, যাতে হালাকু খানও লজ্জা পায়, যাতে চেঙ্গিস খানও লজ্জা পায়। অত্যাচার করেছে বাংলাদেশের মাটিতে। আজ বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্যরা সেই রক্তলেখা দিয়ে শাসনতন্ত্র দিতে চান। শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না’ (সংসদীয় কার্য বিবরণী, খণ্ড ২, সংখ্যা ১, পৃষ্ঠা ১৭)।
রক্তে লেখা বাহাত্তরের সংবিধান হুবহু ফিরিয়ে আনার কথা কেউ বলেন না। কিন্তু তার মূল সুরটি অবিকল থাকতে হবে। অসাম্প্রদায়িকতা, সার্বভৌম সংসদ—এককথায় সংসদীয় গণতন্ত্র। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর সংবিধানের ওপর সামরিক কাঁচি চালানো হয়েছে। পরে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে সেগুলো সংবিধানে ঢোকানো হয়। ২০০৫ সালে হাইকোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পথে বাধা নেই। তবে অবশ্যই বাস্তবতা বিচারে কিছু সংযোজন-বিয়োজন দরকার, সে কথা আগেই বলেছি। সংসদের নেতাদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এখন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো প্রমাণ করুন কে কতটা দায়িত্বশীল।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments