কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

অতি আবেগীরা বলেন, সাড়ে তিন ঘণ্টা। কিন্তু মাওয়া থেকে ফেরিতে পদ্মার অসংখ্য ডুবোচর অতি সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে ওপার পেঁৗছতেই তো তিন ঘণ্টা লেগে যায়। সব মিলিয়ে গোপালগঞ্জে যেতে ঢাকা থেকে প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা লাগল। আমার স্মৃতিতে দেশের নির্জনতম শহর ছিল গোপালগঞ্জ।


কবি জীবনানন্দের কবিতায় যখন প্রথম পড়েছিলাম 'সেইখানে দারুচিনি বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে'_ শৈশবের গোপালগঞ্জের রূপটি চোখে ভেসেছিল। যে শহরে একটি বাইসাইকেলও যানবাহন হিসেবে ছিল না। সেই শহরে ঢোকার মুখেই যানজটে আটকে থাকতে হলো বেশ খানিকটা সময়। ছোট্ট নিরাভরণ শান্ত শহরটির শরীর ছুঁয়ে একদা যে বিশাল স্বচ্ছসলিলা মধুমতি ছিল, আজ তার চিহ্নমাত্র নেই। মধুমতির বুকে যে অসংখ্য এক মাল্লার 'টাবুরা' নাও সারা দিন ভাসত ইতালির ভেনিসের মতো_কোথায় তারা! এসব ৫০ বছরের কিছু বেশি সময়ের আগের কথা। এই শহরের মধ্যপাড়ায় গোপাল ডাক্তারের যে দুইখানা দোতলা টিনের ঘর পিঠাপিঠি এখনো দাঁড়িয়ে আছে তার একটাতে ছিলাম আমি। আমার আট, নয় এবং দশ বছর বয়সের সহস্রাধিক রঙিন দিন মাখামাখি হয়ে আছে গোপালগঞ্জের মাটি-জলে।
এই দিনগুলোকে স্মৃতি বললে ভুল হবে। এই দিনগুলো আমার জীবনের অমূল্য অর্জন।
গোপালগঞ্জে তখন মুসলিম লীগের খুব দাপট। স্থানীয় ওয়াহিদুজ্জামান কেন্দ্রের মন্ত্রী। মাঝেমধ্যে সি প্লেনে এসে সাঁই করে মধুমতির জলে ঝুপুৎ করে নেমে আবার বিকেল নাগাদ ফিরে যান। তারপর আবার সময়টা তো ছিল আইয়ুব খানের প্রথম মার্শাল ল'র দাপট। মানুষের মনে ভয়, উৎকণ্ঠা যেমন ছিল, তেমনি ছিল চাপা অসন্তোষ। প্রতিবাদী নেতা হিসেবে তখন শেখ মুজিবের নাম স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে। সেই প্রথম আমিও শেখ মুজিবের নাম শুনি। কোনো দিন চোখে দেখিনি, তবুও তাঁকেই আমার তখন বিপন্ন সময়ের বলবান বীর মনে হতো। শেখ মুজিবের বাবা শেখ লুৎফর রহমানকে নিজ চোখে দেখতে মডেল স্কুলে যাওয়ার পথে একদিন মুন্সেফ কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। পরে আমার শৈশবের সেই বলবান বীর দিনে দিনে হয়ে উঠলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বিবিসির জরিপে তিনি 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি'। এ জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট, ত্যাগ এবং কঠিন সময় পার হতে হয়েছে। দেশের মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে হয়েছে। একটা জাতিকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় একবিন্দুতে এনে জাগাতে হয়েছে। শত প্রতিকূলতা, কুটিল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অকুতোভয়চিত্তে বুকটান করে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। হাজার বছরের আবহমান সংস্কৃতিকে ধারণ করে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের স্বাদ উপহার দিতে হয়েছে।
বাঙালি জাতির এই মহানায়ক সম্পর্কে কথার কি শেষ আছে! তবু বলি, যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা ভাষা ও বাঙালি থাকবে_তত দিন তিনি চিরজাগরূক থাকবেন। যতকাল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে বেড়ে ওঠা হাজার বছরের জনপদে মানুষ থাকবে, ততকাল অন্তরের মণিকোঠায় চিরভাস্কর হয়ে থাকবে তাঁর কীর্তি।
গোপালগঞ্জে শেষ কবে রাত কাটিয়েছি মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, তখনো এই শহরটায় নির্জনতা ছিল। গাড়ির হর্ন, যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইট-সুরকির শ্রীহীন ঘরবাড়ি আর দোকানপাটে ঘিঞ্জি হয়নি। আজ মধুমতি নিশ্চিহ্ন। নদীপারের লম্বা রাস্তার দুই পাশে নতুন বাড়িঘর।
যেখানে মধুমতির গভীর জল, সেখানে এখন বাসস্ট্যান্ড, হেলিপ্যাড, কলেজ, গির্জা, আধুনিক অডিটরিয়াম নির্মাণের আয়োজন। কষ্ট তো একটু লাগেই। স্মৃতিময় আয়নার কাচ ভেঙে টুকরো হয়ে গেলে দুঃখ পাব না, তা কি হয়! এবার এসেছি টুঙ্গিপাড়া থেকে বঙ্গবন্ধুর ৯১তম জন্মদিন উপলক্ষে বিটিভি এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ডের সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের ধারা বর্ণনা দিতে। কাজটি যে আমার খুব পছন্দের তা নয়। তবু এই উছিলায় স্মৃতিময় শহরটাতে সময় কাটানো এবং বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল পুণ্যভূমি টুঙ্গিপাড়া আরেকবার দেখে যাওয়া।
গোপালগঞ্জ শহর থেকে ঝকঝকে রাস্তায় টুুঙ্গিপাড়া পেঁৗছতে ১০ মিনিটও লাগল না। অথচ একসময় টাবুরা নাওয়ে গোপালগঞ্জ থেকে কোটালীপাড়ার কোনো গ্রামে যেতে বেলা পার হয়ে যেত। থাকার জন্য রেস্টহাউস-হোটেল ছিল না। একবার আমরা সাংগঠনিক কাজে এ অঞ্চলে এসে দিনসাতেক নৌকাতেই কাটিয়েছি। সেটা বোধ হয় ১৯৬৯ সালের কথা। সঙ্গী ছিল ইসমত কাদির গামা, ফরিদ ও লুলু। শুনলাম মারকুটে ছাত্রনেতা লুলু আর নেই। খারাপ লাগল।
আজকাল যাঁরা কথায় কথায় টুঙ্গিপাড়া যান তাঁরা সেই টুঙ্গিপাড়াকে দেখেননি। শেখ মুজিব নামটাও তাঁদের অনেকের কাছে অপাঙ্ক্তেয় ছিল। আজ তাঁরা ঘটা করে মুজিব কোট পরেন। বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জানান, এখানে না এলে তিনি জানতেনই না বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেঙ্ কত সুন্দর করে নির্মিত হয়েছে। ভদ্রলোক বোধ হয় সরল, তাই অত সহজেই কথাটা বলতে পেরেছেন। তবে শুনতে কানে লাগল বৈকি।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল এবং আশপাশের জায়গাটুকু সত্যি সুন্দর। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গোটা অঞ্চল। একসময় একচিলতে খাল ছিল, এখন নেই। আগেকার মতো ঘরবাড়ি নেই। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির প্রাঙ্গণে একটা ধানের গোলা ছিল, এখন নেই। দুপুরে সেলিম ভাইয়ের (শেখ সেলিম) সঙ্গে খেতে গিয়ে পুরনো বাড়িটার চিহ্ন পেলাম না। তার পরও শতসহস্র মানুষের বিনম্র পদচারণে জায়গাটা সত্যিই সুন্দর, পবিত্র। বিশ্ব পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় তো বটেই। বিশ্বশান্তির শক্তিশালী প্রবক্তা, জাতিসংঘে বাংলা ভাষার উচ্চারণ যিনি সর্বপ্রথম করেছিলেন, জনগণের ক্ষমতায়ন এবং নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যিনি জীবনপাত করেছেন, বিশ্বের তাবৎ নেতা যাঁকে জনপ্রিয় নেতা বলেছেন, তাঁর সমাধিস্থল তো বিশ্ব পর্যটককে টেনে আনবেই। কিন্তু সে ব্যাপারে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। দায়সারা গোছের একটা পর্যটন মোটেল তৈরি করলেই যেন কাজ শেষ! কে ভাবে এসব।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিয়ে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাতে মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলেন। জাতীয় শিশুদিবস উপলক্ষে সেখানে শিশু-কিশোরদের প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক প্রযোজনা দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী, অনেক সময় ধরে। পুরো অনুষ্ঠানটি প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড সরাসরি সম্প্রচার করেছে। পুরোটা সময় ধারা বর্ণনার ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি আমাকেই করতে হয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার পেছনেই ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশাল এক পোট্র্রেট। বারবার চোখ আটকে যায় সেই পোট্র্রেটে। বারবার মনে হয়, দেয়ালে ঝুলছে কাগজের ছবি/আসল ছবিটা বুকে/সেই ছবিটাই আগলে রেখেছি/হাসিমুখে সুখে দুঃখে/বুকের ছবিটা আর কেউ নয়/বাংলাদেশের প্রাণ/জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু/মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ-বাঙালি কি আলাদা কিছু? জয় বাংলা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.