পোশাকশ্রমিক-বাঁচার মতো মজুরি এবং রাহেলাদের প্রাণীজীবন by ফারুক ওয়াসিফ
বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের মালিকদের নিয়ে পরিহাস হলো, তাঁরা নিজেদের তৈরি সমস্যার জন্য নিজেদের ছাড়া বাকি সবাইকে দায়ী করতে ভালোবাসেন। চলমান শ্রমিক অসন্তোষের জন্য তাঁরা শ্রমিকদের ক্ষুধার্ত পেট নয়, তাকান তাঁদের মনের দিকে। ভাবেন, সেখানে কিলবিল করছে ষড়যন্ত্র।
তাঁদের জবানীতে যা জানা যায়, তাতে মনে হয়, শ্রমিকেরা ষড়যন্ত্র নামক কোনো এক যন্ত্রের দখলে চলে গেছেন। পরিহাসটি এই, পোশাকশিল্পের অধিকারীরা নিজেরাই ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্বের’ প্রচার করেছেন। এখন নিজেরাই এর পেছনে দৌড়াচ্ছেন। নিজেদের তৈরি সমস্যার সমাধান দিতে তাঁরা অক্ষম।
আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনকদের একজন ডেভিড রিকার্ডো। শ্রমিকের মজুরি সম্পর্কে তাঁর বিধি হলো, শ্রমিকদের মজুরি ততটাই হওয়া প্রয়োজন, যতটা না দিলে তাঁরা বাঁচতে ও শ্রম বিক্রি করতে পারবেন না। এখান থেকেই ‘বাঁচার মতো মজুরি’ কথাটা এসেছে। কেউ কিন্তু বলেন না যে বাঁচার মতো মজুরিই ন্যায্য মজুরি। বাঁচার মতো মজুরি হলো সেটাই, যা না হলে প্রাণীর মতো করেও প্রাণ ধারণ করা যায় না। আর ন্যায্য মজুরি হলো তাই, যা পেলে শ্রমিক তাঁর পরিবার নিয়ে মানুষের মতো বাঁচতে পারেন। ধনী ও গরিবের বাঁচা সমান নয়, কারণ উভয়ের চাহিদা এক নয়। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা যে নিম্নতম মজুরির দাবি তুলেছেন, তা দিয়েও মানুষের মতো বাঁচা সম্ভব নয়।
এক হিসাবে দেখা গেছে, একজন পোশাকশ্রমিকের কর্মক্ষম থাকার জন্য প্রতিদিন ৩০৩০ কিলোক্যালরি তাপ প্রয়োজন। বাজারে পাওয়া সস্তা খাদ্য দিয়ে একজন শ্রমিককে তাঁর পুষ্টি ও শক্তি রক্ষা করতে হলে প্রতিদিন খাদ্য বাবদ ব্যয় করতে হবে কমসে কম ৬৪ দশমিক ৫০ টাকা। অর্থাৎ তাঁকে রিকার্ডোর কথিত পদ্ধতিতে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মাসে ১৯৩৫ টাকা খাদ্যের জন্য ব্যয় করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান মিলিয়ে পরিবারের সদস্য চারজন হলে দরকার হবে ১৯৩৫ X ৪ = ৭৭৪০ টাকা। এর সঙ্গে তাঁর এক কক্ষের বাসা ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা, পোশাক ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে একটি শ্রমিক পরিবারের মাসিক ব্যয় হওয়ার কথা নিম্নে ১৪,২৪০ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করলে তা ভাগ হয়ে ৭,৭৪০ টাকাই হয়। এটাই হওয়া উচিত শ্রমিকের বাঁচার মতো নিম্নতম মজুরি।
এই বাঁচা প্রাণীর মতো উদরের জ্বালা শান্ত রাখার মতো বাঁচা, মানুষের মতো বাঁচা নয়। নিছক পেটের কাছে বন্দী থাকা জীবন প্রাণীর জীবন, পশুর জীবন। আদিম পরিবেশে কোনো প্রাণীকে ক্ষুধা মেটানোর জন্য যতটা পরিশ্রম করতে হয়, আমাদের পোশাকশ্রমিককে কাজ করতে হয় তার থেকে বেশি—দিনে প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা! তাঁদের জীবন তাই মানবিক নয়, প্রাণবিক। এটা চলতে পারছে কারণ, প্রতিটি সরকারই বাঁচার মতো মজুরি নির্ধারণে শ্রমিককে ফাঁকি দিয়েছে।
১৯৯৪ সালে পোশাকশিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঠিক হয়েছিল ৯৩০ টাকা, ১২ বছর পর তা পুনর্নির্ধারণ করা হয় ১৬২২ টাকা। গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, ২০০৬ সালে নির্ধারিত সপ্তম গ্রেডের একজন সাহায্যকারী বা শিক্ষানবিশের বেতন হওয়া উচিত কমপক্ষে ২১৫৬ টাকা। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ‘এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত দেশজ প্রবৃদ্ধির হিসাবটুকুও। এই দুটি সমন্বয় করলে শ্রমিকের মজুরি কমপক্ষে ৭০ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানো দরকার।’ (খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রথম আলো, ১৭ জুলাই) এই হিসাবে একজন শিক্ষানবিশের বেতন কমপক্ষে ২৮৪০ টাকা হওয়া উচিত। কিন্তু এই হিসাবের সমস্যা হলো ১৯৯৪ সালের ৯৩০ টাকা বেতনকেই মেনে নিয়ে হিসাব করা হয়েছে মাত্র।
গত ৭ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিজেএমইএর সহসভাপতি জানিয়েছেন, একজন শ্রমিকের জীবন ধারণের জন্য মাসিক এক হাজার ৯৮৯ টাকার বেশি দরকার নেই। বিজেএমইএর নেতারা বলে থাকেন, তাঁদের ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। অথচ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে তাঁদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৩-১৪ শতাংশ। বিশ্বমন্দার আঘাতও তেমন লাগেনি এই খাতে। তারপরও সরকার তাঁদের জন্য ‘বেইল-আউট’ তথা নগত অর্থসহায়তার ব্যবস্থা করছে। তাঁরা স্বল্পসুদে ঋণ পান। ‘ব্যাক টু ব্যাক’ পদ্ধতিতে তাঁদের কাপড় আমদানি করমুক্ত। গোড়ার দিকে তাঁরা পেয়েছেন ২৫ শতাংশ নগদ অর্থ সহায়তা। ছিল ২০০৪-৫ পর্যন্ত ছিল আমেরিকায় করমুক্তভাবে রপ্তানি সুবিধার কোটা। এখনও ইউরোপের দেশগুলিতে রপ্তানির বেলায় কর দিতে হয় না। এছাড়াও আছে ৫ শতাংশ ইনসেনটিভ। বিভিন্ন সময়ে সরকারের তরফে নগদ সহায়তাধন্য হয়েছে এই শিল্প। তারপরও তাঁদের মুনাফার সোনার ডিম পাড়া হাঁস যে শ্রমিকরা, তাদের কেন বাঁচার মতো মজুরি কেন দেওয়া হবে না, তা বোধগম্য নয়। যেখানে বিদেশি ক্রেতারাও বেশি মজুরি দেওয়ার পক্ষে, সেখানে এর থেকে নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে? যে পোশাকশিল্প দেশের সবচেয়ে মুনাফাধন্য খাত, সেই শিল্পের মজুরি কীভাবে রিকশাচালক কিংবা মাটিকাটা দিনমজুরদের থেকেও কম হয়! রপ্তানীমুখী শিল্পে আয় বেশি হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের বেতন অরপ্তানীমুখী খাতের শ্রমিকদের থেকে কম। মালিকেরা চান কম মজুরি আর দ্রুত চলা আঙুল। শ্রমিক বাঁচেন ওভারটাইমের বাড়তি আয়ে, বেতনে তার কুলায় না। মালিকও বাড়তি খাটিয়ে খুশি, কিন্তু শ্রমিকের সন্তোষ বাড়লে যে উৎপাদনশীলতাও বাড়ে সেই বুঝ আমাদের প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যক্তাদের আসেনি।
জাজ্বল্যমান এই বাস্তবতা থেকে উটপাখির মতো মুখ লুকিয়ে থাকা পোশাকশিল্পের মালিকদের জন্য আত্মঘাতী হবে। অতি মুনাফার বাসনায় খোদ শিল্পটিকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিলে মালিক-শ্রমিক কারোরই লাভ হবে না। এখানে সরকারের করণীয় রয়েছে। শেষ বিচারে শ্রম ও মুনাফার চূড়ান্ত ব্যবস্থাপক হলো রাষ্ট্র। কে কতটা লাভ করবে, কাদের কোন মাত্রার নিচে শোষণ করা যাবে না, নিজ স্বার্থেই রাষ্ট্র তা ঠিক করে দেয়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অনেক সময় নিজেদের আসল স্বার্থের বিপরীত আচরণ করে, রাষ্ট্রের তরফে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় তখনই। সরকার ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে পোশাকশিল্পের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত নিরপেক্ষ না হোক, নিদেনপক্ষে যৌক্তিক হতে হবে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর জোটের দাবি ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা। আমাদের দেখানো প্রাণীর মতো বাঁচার জন্যও যে মজুরি প্রয়োজন, তাঁরা সেই ৭৭৪০ টাকা পর্যন্ত চাওয়ার সাহস করেননি। এই পাঁচ হাজার টাকাও যদি না দেওয়া হয়, তাহলে জীবন টিকিয়ে রাখার ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, গরিব মানুষ যেভাবে বাজারের স্বাধীনতা হারাচ্ছে, তাতে করে অচিরেই শ্রমিক অঞ্চলে আবার বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতে পারে।
একসময় পাটচাষি আর পাটকল শ্রমিকেরা যেমন অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিলেন, আজ সেই ভূমিকা নিয়েছে পোশাকশিল্প ও এর শ্রমিকেরা। তাঁরাই দেশের বৃহত্তম শ্রমশক্তি। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে দেখানো হচ্ছে, এই শিল্পের ৯৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৭৮ শতাংশ নারীই এক-দুই ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। এঁদের অধিকাংশের জীবনদৃষ্টিই আধুনিক। আজকাল গ্রামের অনেক পরিবারই মেয়েকে পোশাকশিল্পে পাঠাবে বলে এক-দুই ক্লাস পর্যন্ত পড়ায়। শ্রমিকতার মাধ্যমে অনেক তরুণী বাল্যবিবাহ এড়িয়ে নিজের জীবনের কর্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। এই মেয়েরা দ্বিগুণ ওভারটাইম করে খেয়ে না-খেয়ে সঞ্চয় করেন এবং গ্রামে টাকা পাঠিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। এঁদের চাহিদাকে ঘিরে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও বাজারও বিকশিত হচ্ছে। রাজপথের একপাশ দিয়ে সারবেঁধে হেঁটে যাওয়া এইসব তরুণ-তরুণীরা তাই কেবল এক ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠী নন। তাঁদের এই চলা নারীর এগিয়ে যাওয়ার কাফেলারই অংশ। এঁরা আত্মসচেতন ও মুক্তমনা, নীরবে এঁরাই বহন করছেন নাগরিক আধুনিকতার মশাল। উপযুক্ত মজুরি দিয়ে এঁদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া আজ জাতীয় দায়িত্ব। দেখা যাক, এ মাসের ২৭ তারিখে সরকার তাদের জন্য কী করে।
তাঁদের প্রাণীর দশায় আটকে রেখে বাদবাকি সমাজ মানবিক হতে পারে না। তাঁদের বাঁচার মতো মজুরির দাবি আসলে মানুষের মতো জীবন পাবারই আকুতি। কেবল মজুরির বঞ্চনাই নয়, আরও নানা বঞ্চনা ও নিপীড়নে জর্জর অবস্থা পোশাকশিল্পের নারী কর্মীদের। নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিককে অমানবিক জীবনে আটকে রেখে মালিকদের ভাবমূর্তিও কিন্তু উজ্জ্বল হয় না। পাঁচ হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরি তাই আর কিছু নয়, শ্রমিকের দাস বা প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার নিম্নতম চাহিদা। আর সেটাই মালিকের সভ্য সমাজের উৎপাদনের সংগঠক হয়ে ওঠার ন্যূনতম শর্ত।
বছর কয়েক আগে সাভারে রাহেলা নামে এক পোশাকশ্রমিককে গণধর্ষণ করে গলা কেটে পশুর মতো ফেলে রাখা হয়েছিল। সে অবস্থায় এক ঝোপের মধ্যে কয়েক দিন তিনি বেঁচে ছিলেন। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। কদিন আগে দেখলাম, মিরপুরে রাহেলা নামে আরেক শ্রমিক মজুরির দাবিতে পুলিশের সঙ্গে লড়ছেন আর মার খাচ্ছেন। এই রাহেলার জেদ, সেই রাহেলার আর্তনাদ নিরর্থক হয়ে যেতে পারে না। জবাই করা রাহেলার বুকের ভেতর থেকে রক্তের সঙ্গে যে ফরিয়াদ ঘড়ঘড় শব্দে বেরিয়ে আসছিল, বঞ্চনার শিকার মিরপুরের রাহেলারা যেকারণে ভয়ডর ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছে, সেই ফরিয়াদ আর সেই সংগ্রামই পোশাকশ্রমিকের জীবনের সত্য। সেই জীবন আজ প্রাণীর জীবন থেকে মানুষের মতো জীবন চাইছে। এই চাওয়াকে উপেক্ষা করার মতো অনৈতিক ও অমানবিক কী আমরা হব?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনকদের একজন ডেভিড রিকার্ডো। শ্রমিকের মজুরি সম্পর্কে তাঁর বিধি হলো, শ্রমিকদের মজুরি ততটাই হওয়া প্রয়োজন, যতটা না দিলে তাঁরা বাঁচতে ও শ্রম বিক্রি করতে পারবেন না। এখান থেকেই ‘বাঁচার মতো মজুরি’ কথাটা এসেছে। কেউ কিন্তু বলেন না যে বাঁচার মতো মজুরিই ন্যায্য মজুরি। বাঁচার মতো মজুরি হলো সেটাই, যা না হলে প্রাণীর মতো করেও প্রাণ ধারণ করা যায় না। আর ন্যায্য মজুরি হলো তাই, যা পেলে শ্রমিক তাঁর পরিবার নিয়ে মানুষের মতো বাঁচতে পারেন। ধনী ও গরিবের বাঁচা সমান নয়, কারণ উভয়ের চাহিদা এক নয়। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা যে নিম্নতম মজুরির দাবি তুলেছেন, তা দিয়েও মানুষের মতো বাঁচা সম্ভব নয়।
এক হিসাবে দেখা গেছে, একজন পোশাকশ্রমিকের কর্মক্ষম থাকার জন্য প্রতিদিন ৩০৩০ কিলোক্যালরি তাপ প্রয়োজন। বাজারে পাওয়া সস্তা খাদ্য দিয়ে একজন শ্রমিককে তাঁর পুষ্টি ও শক্তি রক্ষা করতে হলে প্রতিদিন খাদ্য বাবদ ব্যয় করতে হবে কমসে কম ৬৪ দশমিক ৫০ টাকা। অর্থাৎ তাঁকে রিকার্ডোর কথিত পদ্ধতিতে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মাসে ১৯৩৫ টাকা খাদ্যের জন্য ব্যয় করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান মিলিয়ে পরিবারের সদস্য চারজন হলে দরকার হবে ১৯৩৫ X ৪ = ৭৭৪০ টাকা। এর সঙ্গে তাঁর এক কক্ষের বাসা ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা, পোশাক ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে একটি শ্রমিক পরিবারের মাসিক ব্যয় হওয়ার কথা নিম্নে ১৪,২৪০ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ করলে তা ভাগ হয়ে ৭,৭৪০ টাকাই হয়। এটাই হওয়া উচিত শ্রমিকের বাঁচার মতো নিম্নতম মজুরি।
এই বাঁচা প্রাণীর মতো উদরের জ্বালা শান্ত রাখার মতো বাঁচা, মানুষের মতো বাঁচা নয়। নিছক পেটের কাছে বন্দী থাকা জীবন প্রাণীর জীবন, পশুর জীবন। আদিম পরিবেশে কোনো প্রাণীকে ক্ষুধা মেটানোর জন্য যতটা পরিশ্রম করতে হয়, আমাদের পোশাকশ্রমিককে কাজ করতে হয় তার থেকে বেশি—দিনে প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা! তাঁদের জীবন তাই মানবিক নয়, প্রাণবিক। এটা চলতে পারছে কারণ, প্রতিটি সরকারই বাঁচার মতো মজুরি নির্ধারণে শ্রমিককে ফাঁকি দিয়েছে।
১৯৯৪ সালে পোশাকশিল্পের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঠিক হয়েছিল ৯৩০ টাকা, ১২ বছর পর তা পুনর্নির্ধারণ করা হয় ১৬২২ টাকা। গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, ২০০৬ সালে নির্ধারিত সপ্তম গ্রেডের একজন সাহায্যকারী বা শিক্ষানবিশের বেতন হওয়া উচিত কমপক্ষে ২১৫৬ টাকা। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ‘এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত দেশজ প্রবৃদ্ধির হিসাবটুকুও। এই দুটি সমন্বয় করলে শ্রমিকের মজুরি কমপক্ষে ৭০ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানো দরকার।’ (খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রথম আলো, ১৭ জুলাই) এই হিসাবে একজন শিক্ষানবিশের বেতন কমপক্ষে ২৮৪০ টাকা হওয়া উচিত। কিন্তু এই হিসাবের সমস্যা হলো ১৯৯৪ সালের ৯৩০ টাকা বেতনকেই মেনে নিয়ে হিসাব করা হয়েছে মাত্র।
গত ৭ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিজেএমইএর সহসভাপতি জানিয়েছেন, একজন শ্রমিকের জীবন ধারণের জন্য মাসিক এক হাজার ৯৮৯ টাকার বেশি দরকার নেই। বিজেএমইএর নেতারা বলে থাকেন, তাঁদের ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। অথচ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে তাঁদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৩-১৪ শতাংশ। বিশ্বমন্দার আঘাতও তেমন লাগেনি এই খাতে। তারপরও সরকার তাঁদের জন্য ‘বেইল-আউট’ তথা নগত অর্থসহায়তার ব্যবস্থা করছে। তাঁরা স্বল্পসুদে ঋণ পান। ‘ব্যাক টু ব্যাক’ পদ্ধতিতে তাঁদের কাপড় আমদানি করমুক্ত। গোড়ার দিকে তাঁরা পেয়েছেন ২৫ শতাংশ নগদ অর্থ সহায়তা। ছিল ২০০৪-৫ পর্যন্ত ছিল আমেরিকায় করমুক্তভাবে রপ্তানি সুবিধার কোটা। এখনও ইউরোপের দেশগুলিতে রপ্তানির বেলায় কর দিতে হয় না। এছাড়াও আছে ৫ শতাংশ ইনসেনটিভ। বিভিন্ন সময়ে সরকারের তরফে নগদ সহায়তাধন্য হয়েছে এই শিল্প। তারপরও তাঁদের মুনাফার সোনার ডিম পাড়া হাঁস যে শ্রমিকরা, তাদের কেন বাঁচার মতো মজুরি কেন দেওয়া হবে না, তা বোধগম্য নয়। যেখানে বিদেশি ক্রেতারাও বেশি মজুরি দেওয়ার পক্ষে, সেখানে এর থেকে নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে? যে পোশাকশিল্প দেশের সবচেয়ে মুনাফাধন্য খাত, সেই শিল্পের মজুরি কীভাবে রিকশাচালক কিংবা মাটিকাটা দিনমজুরদের থেকেও কম হয়! রপ্তানীমুখী শিল্পে আয় বেশি হওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের বেতন অরপ্তানীমুখী খাতের শ্রমিকদের থেকে কম। মালিকেরা চান কম মজুরি আর দ্রুত চলা আঙুল। শ্রমিক বাঁচেন ওভারটাইমের বাড়তি আয়ে, বেতনে তার কুলায় না। মালিকও বাড়তি খাটিয়ে খুশি, কিন্তু শ্রমিকের সন্তোষ বাড়লে যে উৎপাদনশীলতাও বাড়ে সেই বুঝ আমাদের প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যক্তাদের আসেনি।
জাজ্বল্যমান এই বাস্তবতা থেকে উটপাখির মতো মুখ লুকিয়ে থাকা পোশাকশিল্পের মালিকদের জন্য আত্মঘাতী হবে। অতি মুনাফার বাসনায় খোদ শিল্পটিকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিলে মালিক-শ্রমিক কারোরই লাভ হবে না। এখানে সরকারের করণীয় রয়েছে। শেষ বিচারে শ্রম ও মুনাফার চূড়ান্ত ব্যবস্থাপক হলো রাষ্ট্র। কে কতটা লাভ করবে, কাদের কোন মাত্রার নিচে শোষণ করা যাবে না, নিজ স্বার্থেই রাষ্ট্র তা ঠিক করে দেয়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অনেক সময় নিজেদের আসল স্বার্থের বিপরীত আচরণ করে, রাষ্ট্রের তরফে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় তখনই। সরকার ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে পোশাকশিল্পের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত নিরপেক্ষ না হোক, নিদেনপক্ষে যৌক্তিক হতে হবে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর জোটের দাবি ন্যূনতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা। আমাদের দেখানো প্রাণীর মতো বাঁচার জন্যও যে মজুরি প্রয়োজন, তাঁরা সেই ৭৭৪০ টাকা পর্যন্ত চাওয়ার সাহস করেননি। এই পাঁচ হাজার টাকাও যদি না দেওয়া হয়, তাহলে জীবন টিকিয়ে রাখার ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, গরিব মানুষ যেভাবে বাজারের স্বাধীনতা হারাচ্ছে, তাতে করে অচিরেই শ্রমিক অঞ্চলে আবার বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতে পারে।
একসময় পাটচাষি আর পাটকল শ্রমিকেরা যেমন অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিলেন, আজ সেই ভূমিকা নিয়েছে পোশাকশিল্প ও এর শ্রমিকেরা। তাঁরাই দেশের বৃহত্তম শ্রমশক্তি। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে দেখানো হচ্ছে, এই শিল্পের ৯৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৭৮ শতাংশ নারীই এক-দুই ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। এঁদের অধিকাংশের জীবনদৃষ্টিই আধুনিক। আজকাল গ্রামের অনেক পরিবারই মেয়েকে পোশাকশিল্পে পাঠাবে বলে এক-দুই ক্লাস পর্যন্ত পড়ায়। শ্রমিকতার মাধ্যমে অনেক তরুণী বাল্যবিবাহ এড়িয়ে নিজের জীবনের কর্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। এই মেয়েরা দ্বিগুণ ওভারটাইম করে খেয়ে না-খেয়ে সঞ্চয় করেন এবং গ্রামে টাকা পাঠিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। এঁদের চাহিদাকে ঘিরে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও বাজারও বিকশিত হচ্ছে। রাজপথের একপাশ দিয়ে সারবেঁধে হেঁটে যাওয়া এইসব তরুণ-তরুণীরা তাই কেবল এক ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠী নন। তাঁদের এই চলা নারীর এগিয়ে যাওয়ার কাফেলারই অংশ। এঁরা আত্মসচেতন ও মুক্তমনা, নীরবে এঁরাই বহন করছেন নাগরিক আধুনিকতার মশাল। উপযুক্ত মজুরি দিয়ে এঁদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া আজ জাতীয় দায়িত্ব। দেখা যাক, এ মাসের ২৭ তারিখে সরকার তাদের জন্য কী করে।
তাঁদের প্রাণীর দশায় আটকে রেখে বাদবাকি সমাজ মানবিক হতে পারে না। তাঁদের বাঁচার মতো মজুরির দাবি আসলে মানুষের মতো জীবন পাবারই আকুতি। কেবল মজুরির বঞ্চনাই নয়, আরও নানা বঞ্চনা ও নিপীড়নে জর্জর অবস্থা পোশাকশিল্পের নারী কর্মীদের। নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিককে অমানবিক জীবনে আটকে রেখে মালিকদের ভাবমূর্তিও কিন্তু উজ্জ্বল হয় না। পাঁচ হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরি তাই আর কিছু নয়, শ্রমিকের দাস বা প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার নিম্নতম চাহিদা। আর সেটাই মালিকের সভ্য সমাজের উৎপাদনের সংগঠক হয়ে ওঠার ন্যূনতম শর্ত।
বছর কয়েক আগে সাভারে রাহেলা নামে এক পোশাকশ্রমিককে গণধর্ষণ করে গলা কেটে পশুর মতো ফেলে রাখা হয়েছিল। সে অবস্থায় এক ঝোপের মধ্যে কয়েক দিন তিনি বেঁচে ছিলেন। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। কদিন আগে দেখলাম, মিরপুরে রাহেলা নামে আরেক শ্রমিক মজুরির দাবিতে পুলিশের সঙ্গে লড়ছেন আর মার খাচ্ছেন। এই রাহেলার জেদ, সেই রাহেলার আর্তনাদ নিরর্থক হয়ে যেতে পারে না। জবাই করা রাহেলার বুকের ভেতর থেকে রক্তের সঙ্গে যে ফরিয়াদ ঘড়ঘড় শব্দে বেরিয়ে আসছিল, বঞ্চনার শিকার মিরপুরের রাহেলারা যেকারণে ভয়ডর ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছে, সেই ফরিয়াদ আর সেই সংগ্রামই পোশাকশ্রমিকের জীবনের সত্য। সেই জীবন আজ প্রাণীর জীবন থেকে মানুষের মতো জীবন চাইছে। এই চাওয়াকে উপেক্ষা করার মতো অনৈতিক ও অমানবিক কী আমরা হব?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments