এসব কী বলছেন কাদের সিদ্দিকী! by মহসীন হাবিব

এক পাঠান পুলিশ এক চোরকে হাতেনাতে ধরে ফেলল। তারপর শক্ত করে চোরের হাত দুটো বেঁধে একটি গাছের নিচে বসিয়ে রেখে থানায় ফিরে এসে চোর ধরার খবর দিল। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উর্দুতে বললেন, তুমি যে ওর হাত দুটো বেঁধে গাছের নিচে বসিয়ে রেখে এলে, সে তো হেঁটে পালিয়ে যাবে!


পাঠান পুলিশ একটু চিন্তা করে বলল, 'কই বাদ নেহি, ও ভি পাঠান হ্যায়!'
'বঙ্গবীর' কাদের সিদ্দিকীও বাংলাদেশের জনসাধারণকে ওই পুলিশের মতোই এসটিমেট করছেন। তা না হলে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর কাদের সিদ্দিকী কী করে বলেন যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক নন? তাহলে কার ঘোষণায়, কার নির্দেশে, কার অনুপ্রেরণায় কাদের সিদ্দিকী স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন? শুরুতেই বলে রাখা ভালো, কাদের সিদ্দিকী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসীম সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছেন। যুদ্ধে তাঁর অনেক বীরগাথা আছে। তিনি একজন বীর-উত্তম। বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সদস্যের কাদেরিয়া বাহিনী অনেক সফল অভিযান চালিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি সাহসিকতার সঙ্গে ভূঞাপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনকারী নৌযান দখল করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে (জেনারেল নাগরা সন্ধর্বের পাশাপাশি) ঢাকায় প্রবেশ করেন। অসংখ্য স্মৃতিকথায়, বিশেষ করে ভারত পাকিস্তানের জেনারেলদের স্মৃতিকথায় অত্যন্ত কার্যকর বাহিনী বলে উল্লেখ আছে। বীর-উত্তম কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে চলে যান, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিরুদ্ধে আবার অস্ত্র ধরতে চেষ্টা করেন এবং ১৫ বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করে ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে আসেন। আবার এ কথাও সত্যি যে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা শেষ পর্যন্ত তাঁদের আদর্শ ধরে রাখতে পারেননি। এমনকি কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। খোন্দকার মোশতাক কিংবা মাহবুবুল আলম চাষীও কিন্তু সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রসঙ্গত, যুদ্ধের ময়দান একটি নিষ্ঠুর জায়গা। যুদ্ধের সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা হলো, হয় শত্রুকে মারতে হবে, না হলে নিজেকে মরতে হবে। তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক মানুষকে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যায়। আমার সঙ্গে পোল্যান্ডের একটি শহরে দেখা হয়েছিল একজন পাকিস্তানি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির। পরিচয়ের পর দেখেছি, তাঁর মধ্যে নানা ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ। চা খেতে খেতে আমি সেই পাকিস্তানি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিকে ভাঙা ভাঙা উর্র্দু ব্যবহার করে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা আপনার বয়স কত? তিনি চোখ দুটো বড় করে অত্যন্ত উদ্ধত ভঙ্গিতে বললেন, 'লড়কে দেখো!' অর্থাৎ আমার সঙ্গে মারামারি করে দেখো। আমি বললাম, চাচা, আমি তো আপনার সঙ্গে লড়াই করতে আসিনি। বয়স জানতে চেয়েছি। তিনি এবার গর্বের সঙ্গে যা বললেন তা বাংলা করলে দাঁড়ায় : 'আমি '৭১ সালে যুদ্ধের সময় চিটাগাঙে ছিলাম। কমপক্ষ ২০০ বাঙালি 'কতল' করেছি। তারপর থেকে আমার মাথা মাঝেমধ্যে বিগড়ে যায়। আগে পাকিস্তানে ফিরে আসার পর বেশি হতো। ধীরে ধীরে কিছুটা কমেছে। তুমি কিছু মনে করো না।' রাজবাড়ীর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে জানি। তিনি কয়েক ডজন শত্রু খতম করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর '৭১-পরবর্তী সময়ে এমন কোনো সমস্যা হয়েছে কি না জানি না। বাংলাদেশে আজও মানসিক রোগ নির্ণয় বা মানসিক রোগ চিকিৎসা ডেভলপ করেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাদের সিদ্দিকীর ভূমিকা নিয়ে কথা না বলাই ভালো। তখন যুদ্ধাবস্থা ছিল। সে সময়ের সবার সব কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়, শুধু মুখে মুখে, কানে কানে কিছু বিষয় শোনা যায়। মুখের স্বীকারোক্তি বা অস্বীকার ছাড়া সে সময়ের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ-তথ্যাদি পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর কিন্তু অনেক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, সাধারণ মানুষের নখদর্পণে রয়েছে। অনেক বছর আগে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (সম্ভবত গাফ্ফার ভাই, আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত নই) তঁাঁর একটি নিবন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন, দেশ স্বাধীনের পর কাদের সিদ্দিকী কেন হত্যা করার সময়ে সাংবাদিক ডেকে নিয়েছিলেন তা বোঝা গেল না।' (যদি বলি কাদের সিদ্দিকী, আপনিই সেই ব্যক্তি যিনি জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছিলেন? সেসব কিন্তু ইতালির বিখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফ্যালাসিসহ আরো বিদেশি সাংবাদিকদের দেখা ছিল। তাঁরা লিখে গেছেন। যদি বলি আপনিই সেই ব্যক্তি, যাকে দেশ স্বাধীনের পর অস্ত্র শক্তি প্রয়োগ থেকে ঠেকাতে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে হিমশিম খেতে হয়েছিল?) ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর একটি সাধারণ দেশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কাদের সিদ্দিকীর ভালো লাগেনি। দেশ স্বাধীনের পর কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র ঝনঝন করেছে, যা আওয়ামী লীগের জন্য বদনাম কুড়িয়ে এনেছে। মনে পড়ে, কাদের সিদ্দিকী কতবার বঙ্গবন্ধুর কাছে অন্যায় আবদার নিয়ে হাজির হয়েছেন? বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে সেসব ম্যানেজ করতে হয়েছে। এ লেখাটির শিরোনাম হতে পারত, তুমি মহারাজ, সাধু হলে আজ। কিন্তু অসংখ্য লেখার এ শিরোনাম হওয়ায় তা রাখা গেল না।
স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন সে বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু কাদের সিদ্দিকী হঠাৎ করে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যে উক্তি করেছেন, তা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সে ব্যাপারে আমরা ১০০ ভাগ নিশ্চিত। তিনি এমন উদ্দেশ্য বহুবার হাসিল করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর পর একটি লেজিটিমেট সরকারের কাছে তিনি অস্ত্র জমা দেননি। এটি একটি আদর্শ মুক্তিযোদ্ধার সিদ্ধান্ত হতে পারে না। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সিমপ্যাথি কুড়াতে এবং নিজেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার উদ্দেশে (অবশ্য তখনই তিনি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন)। তিনি ঘটা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে 'অস্ত্র সমর্পণ' করেছিলেন। কাদের সিদ্দিকী ভালো করেই জানেন, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম'_এর বাইরে আর কোনো ঘোষণার দরকার নেই, এর বাইরে আর কোনো ঘোষণা বাকি থাকে না, এর বাইরে আর কোনো ঘোষণা তাৎপর্য অতটা নয়। তাহলে কেন তিনি নতুন করে বিতর্ক চাঙ্গা করতে চাচ্ছেন?
কাদের সিদ্দিকীকে ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে বহিষ্কারের পেছনে কতগুলো কারণ ছিল তা কি তিনি একবার ভেবে দেখেছেন? এ লেখাটির প্রয়োজন পড়ত না যদি কাদের সিদ্দিকী সেই পাঠান পুলিশের মতো আচরণ না করতেন। বর্তমান আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকতেই পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাদের সিদ্দিকীর এ নতুন খেলা মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ২৮ জুলাই, অর্থাৎ শেখ মুজিব নিহত হওয়ার ১৮ দিন আগে। তখনো কী কাদের সিদ্দিকীর মনে হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক নন? দুই বছর আগে একটি অনলাইনে সাক্ষাৎকার দিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেছিলেন, 'বঙ্গবন্ধুকে হত্যা শুধু একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করা। এসব দুষ্কৃৃতকারীকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।' বুকে হাত দিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলতে পারবেন যে এসব দুষ্কৃৃতকারীর হোতা কে, তা তিনি জানেন না?

লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.