বিশেষ সাক্ষাৎকার-দুর্নীতির ব্যাপকতাই সংঘাতের রাজনীতির জন্ম দিচ্ছে by আকবর আলি খান
আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে সম্মানসহ মাস্টার্স করার পর ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অর্জন করেন এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি। ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সালের জুন পর্যন্ত সরকারের অর্থসচিব ছিলেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন এবং ডিসেম্বর মাসে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে লেখালেখি, গবেষণামূলক কাজ ও বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতায় নিয়োজিত। ডিসকভারি অব বাংলাদেশ, পরার্থপরতার অর্থনীতি তাঁর আলোচিত গ্রন্থ। গত বছর ফ্রেন্ডলি ফায়ার্স, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার, অ্যান্ড আদার এসেজ এবং অন্ধকারের উৎস হতে নামে তাঁর দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কেমন বাজেট পরিকল্পনা আপনি প্রত্যাশা করেন?
আকবর আলি খান এ বছর যে বাজেট হবে, এর পেছনে দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী শক্তি কাজ করছে। সরকারের অনেকগুলো নির্বাচনী ওয়াদা রয়েছে। সেগুলো পূর্ণ করার জন্য তাদের বড় ধরনের বাজেট করা প্রয়োজন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। এই চাপ এত তীব্র, সরকার মনে করে না সত্যি সত্যি তারা একা এর সমাধান করতে পারবে। এ জন্য সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছ থেকে সম্প্রসারিত ঋণসুবিধা নিয়েছে। আইএমএফ বিশেষ সংকট মোকাবিলার জন্যই কেবল ঋণ দিয়ে থাকে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আইএমএফের কাছে চিঠি লিখে বলেছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা দেওয়া আর্থিক সংকট বেশ কিছুদিন থাকবে। কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং দেশের ভেতরে সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা বিষয়ে সরকারের সরাসরি কিছু করার নেই। কিন্তু অর্থমন্ত্রী নিজেই যে সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির চাপের কথা বলেছেন, তার জন্ম দিয়েছে সরকার নিজেই। সরকার ব্যয় বেশি করে ফেলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুবিধা এমন মাত্রায় নিয়ে গেছে যা অর্থনীতির পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব না। এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
প্রথম আলো অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে সরকারকে তো সাবধানও করা হয়েছিল।
আকবর আলি খান বহু জায়গা থেকে এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্কবাণী জানানো হয়েছে, রাশ টানতে বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার কান পাতেনি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি ও রাজস্বব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। এই চাপ অগ্রাহ্য করে অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য আইএমএফ যে শর্তগুলো দিয়েছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এই অবস্থায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অর্থনীতি পরিচালনা করতে হবে। এ কথা বলে লাভ নেই, অর্থনীতি ভালো আছে এবং দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কাজেই অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকগুলো সমস্যা মোকাবিলা করছে এবং এর কোনো চটজলদি সমাধান নেই। এই অবস্থায় আমাদের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে হবে।
প্রথম আলো আইএমএফের ঋণের শর্ত পালন করলে তো জনজীবনে চাপ বাড়বে।
আকবর আলি খান আইএমএফ যেটা বলে থাকে, সরকারের সব ধরনের ভর্তুকি তুলে দেওয়া উচিত। সরকার গরিব মানুষের উপকারের জন্য কম দামে জিনিস বিক্রি করে। এটাও এক ধরনের ভর্তুকি, যা আসলে সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা। কৃষি ক্ষেত্রে কম দামে সার বিক্রি করা উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। সব ভর্তুকি তাই খারাপ না। আবার কোনো ক্ষেত্রে অদক্ষতার জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে যদি দাম কমিয়ে রাখতে হয়, তখন কিন্তু বলা যাবে না যে সরকার জনসাধারণকে ভর্তুকি দিচ্ছে। কাজেই ভর্তুকির ক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় সরকারকে চারটি বিষয় সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে দেওয়া ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। যেমন কৃষিতে সারের দামে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এটা না করা হলে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, ভর্তুকি উঠিয়ে সরকার যখন দাম বাড়াবে, তখন সেবার মানও উন্নত করতে হবে। তা না করে ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানো ভোক্তাদের প্রতি অবিচার হবে। একদিকে লোডশেডিং বাড়তে থাকবে, আরেক দিকে বিদ্যুতের দাম বাড়বে—এটা গ্রহণযোগ্য না। তৃতীয়ত, অনেক ভর্তুকি হচ্ছে সরকারের অদক্ষতা, অব্যবস্থা এবং অকার্যকারিতার জন্য। চতুর্থত, সব জায়গায় কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ার জন্য ভর্তুকি হ্রাস করা হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্যাসের উৎস দুটি। একটি হলো সরকারের মালিকানাধীন উৎস, অন্যটি হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির সরবরাহ করা গ্যাস। দুটোর গড়ের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম ঠিক করা হয়। আইএমএফ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বাড়লে এখানেও বাড়াতে হবে। আমরা তো নিজেদের উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করছি, এখানে তো খরচ বাড়ছে না। তাহলে বাড়ানো হবে কেন? এতে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। জনসাধারণ যে দামে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তা যদি তাড়াতাড়ি বাড়ানো হয়, তবে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ভর্তুকি কমিয়ে পণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। সুতরাং ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হলে তা পর্যায়ক্রমে করতে হবে। সরকারের উচিত দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
প্রথম আলো বৈদেশিক মুদ্রাসংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে রেন্টাল পাওয়ার বিদ্যুৎ কেনার ভূমিকা কতটা?
আকবর আলি খান দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এর থেকেও দ্রুততর উপায় ছিল, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা। এটা করলে ৮০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ বাড়ত। দ্বিতীয়ত, সরকার ইতিমধ্যে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন করেছে, সেসবে নিয়মিতভাবে গ্যাস সরবরাহ করলে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। অর্থাৎ কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এই কাজ করেই পাওয়া যেত। তাই সহজ সমাধান না করে কঠিন পথে কেন যাওয়া হলো? রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করার কিছু কোম্পানি আছে পৃথিবীতে। তাদের ভাড়া দেওয়ার মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকে, যেগুলো চটজলদি নিয়ে এসে বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এটা করা হলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের প্রশ্ন আসত না। আমরা উল্টো দেশি উদ্যোক্তাদের দিয়ে কুইক রেন্টাল করার চেষ্টা করেছি। এর ফলে অর্থনীতিতে কতগুলো মারাত্মক প্রভাব পড়ল। একটা হলো, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা দেওয়ার ফলেই বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, অনির্ধারিত সময় ধরে আমরা উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পারব না। চুক্তিমাফিক তিন বছর পর কেনা বন্ধ করে দিলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কী হবে? এরা আন্তর্জাতিক কোম্পানি না যে এক দেশ থেকে তুলে অন্য দেশে ভাড়া দেবে। এরা তখন সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যাবে। যে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ ব্যাংকগুলো থেকে এদের দেওয়া হয়েছে, তাও আর ফিরে আসবে না। তাতে সমষ্টিগত অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
প্রথম আলো তার মানে সরকারি টাকা দিয়ে এসব কোম্পানির মুনাফার ব্যবস্থা করা হয়েছে?
আকবর আলি খান স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ নেওয়াই বিকল্প হলে, সেটা উচ্চ দামে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী? রেন্টাল পাওয়ার সেসব ক্ষেত্রেই নেওয়া হয়, যেখানে তিন মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করার নিশ্চয়তা থাকে। অথচ এদের বেশির ভাগই তিন মাস পার হলেও বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। অনেকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেক ক্ষেত্রে তারা যে জেনারেটরগুলো এনেছে, সেগুলো পুরোনো ও অকেজো। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস ও জ্বালানি ব্যবহার করতে হয়। সুতরাং এগুলো অনেক ব্যয়বহুল। এক রেন্টাল পাওয়ার জ্বালানি খাতে অনেক নৈরাজ্য তৈরি করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না কিনেও টাকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। লোডশেডিং তো কমতে দেখলাম না, কিন্তু পাওয়ার বোর্ডের আর্থিক দেনা বেড়ে গেছে, দীর্ঘমেয়াদি সমষ্টিগত অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে।
প্রথম আলো বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) অনেক প্রকল্পই নেওয়া হয়, যেগুলো অবাস্তবায়িত থেকে যায়। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আকবর আলি খান বাংলাদেশে অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো অমর। সেই যে প্রথম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, বারবার নাম বদলে এগুলো চলতেই থাকে। সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকায় কোন প্রকল্পের দরকার আছে, তা নির্ণয় করতে পারি না। প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক চাপের ওপর চলে। কিন্তু এ থেকে সত্যিকার কোনো লাভ হচ্ছে কি না, এবং সেটা কোথায় বাস্তবায়ন করা উচিত, কোথায় পরিবর্তন করা উচিত, কোথায় বন্ধ করা উচিত, এগুলোর কোনো কিছুই পর্যালোচনা হয় না। এই মূল্যায়নের জন্য দরকার বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা। নইলে তৃণমূলের জনগণের পক্ষে বোঝা সম্ভব না, কোনটা তাদের দরকার আর কোনটা দরকার নেই। জনগণ জানেও না তাদের নামে তাদের টাকায় কী করছে না করছে।
এসবের মাধ্যমে সরকারি অর্থ বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছে যেমন, তেমনি সামাজিক প্রতিরক্ষার কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্রদের কাজে লাগার প্রকল্পও রয়েছে। অতি সম্প্রতি এ ধরনের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রথম আলো কালোটাকা করের আওতায় আনা বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগের মাধ্যমে অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে কি?
আকবর আলি খান কালোটাকা সাদা করে তা দিয়ে রাজস্ব বাড়াবে, এটা ভুল ধারণা। এটা বাংলাদেশে বহুবার করা হয়েছে। কালোটাকা সাদা করা হয় কালোটাকার মালিকদের রাস্তা খোলা রাখার জন্য। তাঁরা এই দাবি করেন, যাতে কখনো বিপদে পড়লে বেরিয়ে যেতে পারেন। কর পরিশোধের জন্য কালোটাকা সাদা করার কথা কিন্তু তাঁরা বলেন না। পক্ষান্তরে এই সুযোগ দেওয়ার ফলে, বৈধ আর অবৈধ অর্থকে একইভাবে দেখার সংস্কৃতি তৈরি করা হলো। এটা চললে দেশের রাজস্বব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সবাই কালোটাকা করতে চাইবে, সাদাটাকা করতে চাইবে না। পৃথিবীর কোনো দেশে বছরের পর বছর এ রকম উদ্ভট সুযোগ দেওয়ার রেওয়াজ নেই। এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং নৈতিক দিক থেকে একেবারেই অসমর্থনযোগ্য। সরকারকে নীতির প্রতি অনুগত থেকে কালোটাকার মালিকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
প্রথম আলো দুর্নীতি টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশে কতটা বাধা সৃষ্টি করছে?
আকবর আলি খান প্রবৃদ্ধি কমে বলে আমরা দুর্নীতির বিরোধিতা করি না। পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতি সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দুর্নীতির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব মানুষেরা। বড়লোকেরা কিন্তু দুর্নীতি করে যা করার তাই করে নিতে পারে। দুর্নীতি সত্যি সত্যি দূর করতে না পারলে সাধারণ মানুষ কোনো দিন উন্নয়নের সুফল পাবে না। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির ব্যাপকতার জন্যই দেশের মধ্যে সংঘাতের রাজনীতি দেখতে পাচ্ছি। এর জন্য আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। কাজেই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো ধরে রাখার স্বার্থে আমরা দুর্নীতি চাই না। আর দুর্নীতি না কমলে গরিব মানুষের ভাগ্য কোনো দিনই বদলাবে না।
প্রথম আলো সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে জনগণের জন্য সুযোগ সৃষ্টির বদলে কীভাবে তা দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগাভাগি হবে, সেটাই রাজনীতি ও অর্থনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে আছে। দ্বিদলীয় দুর্নীতি ও দ্বিদলীয় সংঘাতের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়?
আকবর আলি খান দুর্নীতি বেশি করার সুযোগ থাকায় ক্ষমতায় যাওয়ার আগ্রহ উদগ্র হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতায় গিয়ে টাকা বানানো সম্ভব হয়। এর কারণেই ক্ষমতা না ছাড়ার জন্য এত তীব্র লড়াই চলে। দুর্নীতির ব্যাপকতা আছে বলেই রাজনীতিতে এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, এত ব্যক্তিগত শত্রুতা ইত্যাদি আছে। দুর্নীতি কমলে সংঘাতও অনেক কমে যাবে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আসলেই এটা ভাগাভাগির রাজনীতি। এ জন্যই রাজনীতি এত রক্তক্ষয়ী। এ জন্যই আমাদের রাজনীতিকের সংখ্যাও এত বেশি। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এত পেশাদার রাজনীতিক দেখা যায়। সেখানে বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে লোকজন রাজনীতিতে আসে। আমাদের এখানে অনেকেই আছেন রাজনীতিই যাঁদের সারা জীবনের পেশা।
প্রথম আলো আসন্ন বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলের দায়িত্ব কী বলে মনে করেন?
আকবর আলি খান বাজেট তো সরকারের করা। বিরোধী দল সেটার ত্রুটি ও সমস্যা তুলে ধরার জন্য সংসদে যেতে পারে। সেখানে গিয়ে তাদের প্রতিটি মঞ্জুরি নিয়ে কথা বলতে হবে। প্রতিটি অর্থসংক্রান্ত আইন নিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে এতে কোথায় কোথায় জনসাধারণের সমস্যা বাড়বে। সংসদে যখন তারা আঙুল দিয়ে এগুলো দেখিয়ে দেবে, তখন দেশের মানুষ জানতে পারবে। দেশের মানুষকে জানানো তাদের কর্তব্য। এটা বাইরে বসে সেমিনার করে হবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
আকবর আলি খান ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কেমন বাজেট পরিকল্পনা আপনি প্রত্যাশা করেন?
আকবর আলি খান এ বছর যে বাজেট হবে, এর পেছনে দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী শক্তি কাজ করছে। সরকারের অনেকগুলো নির্বাচনী ওয়াদা রয়েছে। সেগুলো পূর্ণ করার জন্য তাদের বড় ধরনের বাজেট করা প্রয়োজন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। এই চাপ এত তীব্র, সরকার মনে করে না সত্যি সত্যি তারা একা এর সমাধান করতে পারবে। এ জন্য সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছ থেকে সম্প্রসারিত ঋণসুবিধা নিয়েছে। আইএমএফ বিশেষ সংকট মোকাবিলার জন্যই কেবল ঋণ দিয়ে থাকে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আইএমএফের কাছে চিঠি লিখে বলেছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা দেওয়া আর্থিক সংকট বেশ কিছুদিন থাকবে। কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং দেশের ভেতরে সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা বিষয়ে সরকারের সরাসরি কিছু করার নেই। কিন্তু অর্থমন্ত্রী নিজেই যে সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির চাপের কথা বলেছেন, তার জন্ম দিয়েছে সরকার নিজেই। সরকার ব্যয় বেশি করে ফেলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুবিধা এমন মাত্রায় নিয়ে গেছে যা অর্থনীতির পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব না। এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
প্রথম আলো অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে সরকারকে তো সাবধানও করা হয়েছিল।
আকবর আলি খান বহু জায়গা থেকে এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্কবাণী জানানো হয়েছে, রাশ টানতে বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার কান পাতেনি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি ও রাজস্বব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। এই চাপ অগ্রাহ্য করে অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য আইএমএফ যে শর্তগুলো দিয়েছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এই অবস্থায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অর্থনীতি পরিচালনা করতে হবে। এ কথা বলে লাভ নেই, অর্থনীতি ভালো আছে এবং দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কাজেই অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকগুলো সমস্যা মোকাবিলা করছে এবং এর কোনো চটজলদি সমাধান নেই। এই অবস্থায় আমাদের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে হবে।
প্রথম আলো আইএমএফের ঋণের শর্ত পালন করলে তো জনজীবনে চাপ বাড়বে।
আকবর আলি খান আইএমএফ যেটা বলে থাকে, সরকারের সব ধরনের ভর্তুকি তুলে দেওয়া উচিত। সরকার গরিব মানুষের উপকারের জন্য কম দামে জিনিস বিক্রি করে। এটাও এক ধরনের ভর্তুকি, যা আসলে সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা। কৃষি ক্ষেত্রে কম দামে সার বিক্রি করা উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। সব ভর্তুকি তাই খারাপ না। আবার কোনো ক্ষেত্রে অদক্ষতার জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে যদি দাম কমিয়ে রাখতে হয়, তখন কিন্তু বলা যাবে না যে সরকার জনসাধারণকে ভর্তুকি দিচ্ছে। কাজেই ভর্তুকির ক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় সরকারকে চারটি বিষয় সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে দেওয়া ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। যেমন কৃষিতে সারের দামে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এটা না করা হলে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, ভর্তুকি উঠিয়ে সরকার যখন দাম বাড়াবে, তখন সেবার মানও উন্নত করতে হবে। তা না করে ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানো ভোক্তাদের প্রতি অবিচার হবে। একদিকে লোডশেডিং বাড়তে থাকবে, আরেক দিকে বিদ্যুতের দাম বাড়বে—এটা গ্রহণযোগ্য না। তৃতীয়ত, অনেক ভর্তুকি হচ্ছে সরকারের অদক্ষতা, অব্যবস্থা এবং অকার্যকারিতার জন্য। চতুর্থত, সব জায়গায় কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ার জন্য ভর্তুকি হ্রাস করা হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্যাসের উৎস দুটি। একটি হলো সরকারের মালিকানাধীন উৎস, অন্যটি হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির সরবরাহ করা গ্যাস। দুটোর গড়ের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম ঠিক করা হয়। আইএমএফ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বাড়লে এখানেও বাড়াতে হবে। আমরা তো নিজেদের উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করছি, এখানে তো খরচ বাড়ছে না। তাহলে বাড়ানো হবে কেন? এতে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। জনসাধারণ যে দামে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তা যদি তাড়াতাড়ি বাড়ানো হয়, তবে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ভর্তুকি কমিয়ে পণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। সুতরাং ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হলে তা পর্যায়ক্রমে করতে হবে। সরকারের উচিত দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
প্রথম আলো বৈদেশিক মুদ্রাসংকট সৃষ্টির ক্ষেত্রে রেন্টাল পাওয়ার বিদ্যুৎ কেনার ভূমিকা কতটা?
আকবর আলি খান দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এর থেকেও দ্রুততর উপায় ছিল, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা। এটা করলে ৮০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ বাড়ত। দ্বিতীয়ত, সরকার ইতিমধ্যে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন করেছে, সেসবে নিয়মিতভাবে গ্যাস সরবরাহ করলে আরও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। অর্থাৎ কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এই কাজ করেই পাওয়া যেত। তাই সহজ সমাধান না করে কঠিন পথে কেন যাওয়া হলো? রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করার কিছু কোম্পানি আছে পৃথিবীতে। তাদের ভাড়া দেওয়ার মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকে, যেগুলো চটজলদি নিয়ে এসে বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এটা করা হলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের প্রশ্ন আসত না। আমরা উল্টো দেশি উদ্যোক্তাদের দিয়ে কুইক রেন্টাল করার চেষ্টা করেছি। এর ফলে অর্থনীতিতে কতগুলো মারাত্মক প্রভাব পড়ল। একটা হলো, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা দেওয়ার ফলেই বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, অনির্ধারিত সময় ধরে আমরা উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পারব না। চুক্তিমাফিক তিন বছর পর কেনা বন্ধ করে দিলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কী হবে? এরা আন্তর্জাতিক কোম্পানি না যে এক দেশ থেকে তুলে অন্য দেশে ভাড়া দেবে। এরা তখন সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে যাবে। যে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ ব্যাংকগুলো থেকে এদের দেওয়া হয়েছে, তাও আর ফিরে আসবে না। তাতে সমষ্টিগত অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
প্রথম আলো তার মানে সরকারি টাকা দিয়ে এসব কোম্পানির মুনাফার ব্যবস্থা করা হয়েছে?
আকবর আলি খান স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ নেওয়াই বিকল্প হলে, সেটা উচ্চ দামে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী? রেন্টাল পাওয়ার সেসব ক্ষেত্রেই নেওয়া হয়, যেখানে তিন মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করার নিশ্চয়তা থাকে। অথচ এদের বেশির ভাগই তিন মাস পার হলেও বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। অনেকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অনেক ক্ষেত্রে তারা যে জেনারেটরগুলো এনেছে, সেগুলো পুরোনো ও অকেজো। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস ও জ্বালানি ব্যবহার করতে হয়। সুতরাং এগুলো অনেক ব্যয়বহুল। এক রেন্টাল পাওয়ার জ্বালানি খাতে অনেক নৈরাজ্য তৈরি করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না কিনেও টাকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। লোডশেডিং তো কমতে দেখলাম না, কিন্তু পাওয়ার বোর্ডের আর্থিক দেনা বেড়ে গেছে, দীর্ঘমেয়াদি সমষ্টিগত অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে।
প্রথম আলো বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) অনেক প্রকল্পই নেওয়া হয়, যেগুলো অবাস্তবায়িত থেকে যায়। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আকবর আলি খান বাংলাদেশে অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো অমর। সেই যে প্রথম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, বারবার নাম বদলে এগুলো চলতেই থাকে। সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকায় কোন প্রকল্পের দরকার আছে, তা নির্ণয় করতে পারি না। প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক চাপের ওপর চলে। কিন্তু এ থেকে সত্যিকার কোনো লাভ হচ্ছে কি না, এবং সেটা কোথায় বাস্তবায়ন করা উচিত, কোথায় পরিবর্তন করা উচিত, কোথায় বন্ধ করা উচিত, এগুলোর কোনো কিছুই পর্যালোচনা হয় না। এই মূল্যায়নের জন্য দরকার বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা। নইলে তৃণমূলের জনগণের পক্ষে বোঝা সম্ভব না, কোনটা তাদের দরকার আর কোনটা দরকার নেই। জনগণ জানেও না তাদের নামে তাদের টাকায় কী করছে না করছে।
এসবের মাধ্যমে সরকারি অর্থ বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছে যেমন, তেমনি সামাজিক প্রতিরক্ষার কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্রদের কাজে লাগার প্রকল্পও রয়েছে। অতি সম্প্রতি এ ধরনের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রথম আলো কালোটাকা করের আওতায় আনা বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগের মাধ্যমে অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন হচ্ছে কি?
আকবর আলি খান কালোটাকা সাদা করে তা দিয়ে রাজস্ব বাড়াবে, এটা ভুল ধারণা। এটা বাংলাদেশে বহুবার করা হয়েছে। কালোটাকা সাদা করা হয় কালোটাকার মালিকদের রাস্তা খোলা রাখার জন্য। তাঁরা এই দাবি করেন, যাতে কখনো বিপদে পড়লে বেরিয়ে যেতে পারেন। কর পরিশোধের জন্য কালোটাকা সাদা করার কথা কিন্তু তাঁরা বলেন না। পক্ষান্তরে এই সুযোগ দেওয়ার ফলে, বৈধ আর অবৈধ অর্থকে একইভাবে দেখার সংস্কৃতি তৈরি করা হলো। এটা চললে দেশের রাজস্বব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সবাই কালোটাকা করতে চাইবে, সাদাটাকা করতে চাইবে না। পৃথিবীর কোনো দেশে বছরের পর বছর এ রকম উদ্ভট সুযোগ দেওয়ার রেওয়াজ নেই। এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং নৈতিক দিক থেকে একেবারেই অসমর্থনযোগ্য। সরকারকে নীতির প্রতি অনুগত থেকে কালোটাকার মালিকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
প্রথম আলো দুর্নীতি টেকসই অর্থনৈতিক বিকাশে কতটা বাধা সৃষ্টি করছে?
আকবর আলি খান প্রবৃদ্ধি কমে বলে আমরা দুর্নীতির বিরোধিতা করি না। পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতি সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দুর্নীতির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব মানুষেরা। বড়লোকেরা কিন্তু দুর্নীতি করে যা করার তাই করে নিতে পারে। দুর্নীতি সত্যি সত্যি দূর করতে না পারলে সাধারণ মানুষ কোনো দিন উন্নয়নের সুফল পাবে না। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির ব্যাপকতার জন্যই দেশের মধ্যে সংঘাতের রাজনীতি দেখতে পাচ্ছি। এর জন্য আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। কাজেই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো ধরে রাখার স্বার্থে আমরা দুর্নীতি চাই না। আর দুর্নীতি না কমলে গরিব মানুষের ভাগ্য কোনো দিনই বদলাবে না।
প্রথম আলো সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে জনগণের জন্য সুযোগ সৃষ্টির বদলে কীভাবে তা দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগাভাগি হবে, সেটাই রাজনীতি ও অর্থনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে আছে। দ্বিদলীয় দুর্নীতি ও দ্বিদলীয় সংঘাতের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়?
আকবর আলি খান দুর্নীতি বেশি করার সুযোগ থাকায় ক্ষমতায় যাওয়ার আগ্রহ উদগ্র হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতায় গিয়ে টাকা বানানো সম্ভব হয়। এর কারণেই ক্ষমতা না ছাড়ার জন্য এত তীব্র লড়াই চলে। দুর্নীতির ব্যাপকতা আছে বলেই রাজনীতিতে এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, এত ব্যক্তিগত শত্রুতা ইত্যাদি আছে। দুর্নীতি কমলে সংঘাতও অনেক কমে যাবে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আসলেই এটা ভাগাভাগির রাজনীতি। এ জন্যই রাজনীতি এত রক্তক্ষয়ী। এ জন্যই আমাদের রাজনীতিকের সংখ্যাও এত বেশি। পৃথিবীর খুব কম দেশেই এত পেশাদার রাজনীতিক দেখা যায়। সেখানে বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে লোকজন রাজনীতিতে আসে। আমাদের এখানে অনেকেই আছেন রাজনীতিই যাঁদের সারা জীবনের পেশা।
প্রথম আলো আসন্ন বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলের দায়িত্ব কী বলে মনে করেন?
আকবর আলি খান বাজেট তো সরকারের করা। বিরোধী দল সেটার ত্রুটি ও সমস্যা তুলে ধরার জন্য সংসদে যেতে পারে। সেখানে গিয়ে তাদের প্রতিটি মঞ্জুরি নিয়ে কথা বলতে হবে। প্রতিটি অর্থসংক্রান্ত আইন নিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে এতে কোথায় কোথায় জনসাধারণের সমস্যা বাড়বে। সংসদে যখন তারা আঙুল দিয়ে এগুলো দেখিয়ে দেবে, তখন দেশের মানুষ জানতে পারবে। দেশের মানুষকে জানানো তাদের কর্তব্য। এটা বাইরে বসে সেমিনার করে হবে না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
আকবর আলি খান ধন্যবাদ।
No comments