বিদেশি পত্রিকা থেকে-গাড়ি দুর্ঘটনার দায় স্বীকার by মিজানুর রহমান খান
এটি একটি গাড়ি দুর্ঘটনার গল্প। সে গল্প পুরোনো। কিন্তু এই গল্পের একটি নতুনত্ব আছে। মহত্ত্ব আছে। সেটাই শিক্ষণীয়। গতকাল ব্রিটিশ পত্রিকা হেরাল্ড প্রেস-এ ঘটনাটি পড়লাম। দুর্ঘটনাটি ঘটে গত বছরের জুনে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ ডেভোনে। নাম তাঁর হাশেম ভূঁইয়া। বাংলাদেশি।
একটি রেস্তোরাঁ চালাতেন। বয়স ৩৯। তাঁর গাড়িটি ছিল গ্রিন ফোর্ড মন্ডো। ঘাতক গাড়িটি ছিল একটি ভ্যান। ভক্সহল মুভানো। চালক ব্রায়ান হোয়াইট। বয়স ৩৫। তাঁর বাড়ি পেন্টোনের মার্লডন্ট সড়কে।
হাশেমের সহযাত্রী মোহাম্মদ মাফুজ। তাঁর বর্ণনায়, ‘গাড়িটি যখন আঘাত হানে, তখন মনে হচ্ছিল, আমাদের ওপর ১০টি বোমা ফেলা হয়েছে।’ আদালত দুর্ঘটনার বৃত্তান্ত শোনেন। আদালত জানেন, নিহত হাশেম সমস্যায় পড়েছিলেন। তাঁর গাড়ির গতি কমানো হয়েছিল। এমনকি দুর্ঘটনার আগে সেটি থেমে গিয়েছিল। হতভাগ্য হাশেমের ২৫ বছর বয়সী স্ত্রী আয়েশা বলেন, তাঁর স্বামী গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করেছিলেন। এমনকি বিপদে পড়ার বাতি জ্বালিয়েছিলেন। তখনই গাড়ির রিয়ারভিউতে তাঁর চোখ পড়ে। তিনি দেখতে পান, হোয়াইটের ভ্যান ধেয়ে আসছে। হাশেম চিৎকার করেন, ‘আমাকে হত্যা করতে যাচ্ছে। গাড়িটি দ্রুত ধেয়ে আসছে।’ আয়েশা বলেন, আঘাত হানার পর তিনি তাঁর স্বামীর কান থেকে রক্ত ঝরতে দেখেন। প্যাথলজিস্ট দেবোরা কুক ময়নাতদন্ত করেন। তাঁর সাক্ষ্য, মাথায় গুরুতর জখমজনিত কারণে হাশেমের মৃত্যু ঘটেছে। এই মামলার সাক্ষী ছিলেন ব্রায়ান মোমেন্ট। তিনি নিউটন অ্যাবোট থেকে এক্সেটারে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রথম স্থানীয়, যিনি দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখতে পান। দুর্ঘটনার পর হোয়াইট তাঁকে বলেন, ‘আমি তাঁদের কখনো দেখতেই পাইনি।’ নিউটন অ্যাবোট ট্রাফিক ইউনিটের কর্মকর্তা এমসি ডেভিড লিডোল বলেন, এটা ‘রিয়ার-এন্ড শান্ট’ ধরনের দুর্ঘটনা। এর মানে হলো, গাড়ির নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হারিয়ে অন্য গাড়ির ওপর উঠিয়ে দেওয়া। ব্রিটেনে এ ধরনের দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। পুলিশের গাড়ি দুর্ঘটনাবিষয়ক তদন্তকারী ফিলিপ রোয়ান স্মিথ এ ধরনের দুর্ঘটনাকে ‘তাকানো অথচ না দেখা দুর্ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর ধারণা, হাশেমের দুর্ঘটনাকবলিত ফোর্ড হয়তো রাস্তায় চোখে না পড়ার মতো অবস্থায় স্থির ছিল।
তবে পুলিশ বলেছে, দুর্ঘটনার শিকার হওয়া কোনো গাড়িরই যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। এটাও প্রমাণিত, ফোর্ডের বিপদ-বাতি জ্বলছিল। রোয়ান স্মিথের কথায়, যেটা নির্ধারণ করা কঠিন, সেটা হলো ভক্সহলের চালক হোয়াইট কেন থেমে থাকা গাড়িটি দেখতে পাননি। কিন্তু তাঁর চোখে পড়ার কথা ছিল। দক্ষিণ ডেভোনের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ইয়ান অ্যারো আদালতে বলেন, ‘কোনো কারণে হাশেম গাড়িটি চালাতে পারেননি, যে কারণে গাড়িটি এ ৩৮০ ইগল ফার্ম এলাকার কাছে থেমে যায়। গাড়িটিকে পেছন থেকে ধাক্কা মারা হয়েছিল। তিনি গুরুতর আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি ১৭ জুলাই মারা যান।
ঘাতক ভক্সহল ভ্যানচালক হোয়াইট আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর অমনোযোগের ফলেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। আদালত তাঁকে বিনা পারিশ্রমিকে ১০০ ঘণ্টা কাজ করার দণ্ড দেন। ১২ মাস ধরে তিনি কমিউনিটিতে সেবামূলক কাজ করবেন। এ সময় তাঁর গাড়ি চালানো চলবে না। আদালতের খরচ বাবদ তাঁকে শোধ করতে হবে ৮৫ পাউন্ড। আদালত অবশ্য ১২ মাস পর পুনরায় গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র পেতে তাঁকে আর পরীক্ষা দিতে হবে না বলেও আদেশে উল্লেখ করেন।
দোষ বা দায় স্বীকার একটি প্রতিকার, যা আমাদের আইনি রাজ্যে এখনো অচেনা। গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য অভিযুক্ত চালকেরা আন্দোলন করে সফল হয়েছেন। ১৯৮২ সালে দন্ডবিধিতে যখন ৩০৪(খ) ধারাটি সংযোজন করা হয় তখন ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ছিল। সে বিধান এরশাদের আমলে রহিত হয়। ১৯৮৪ সালে সংশোধনী এনে সাত বছর কারাদণ্ড করা হয় । ১৯৮৫ সালে আরেক দফা সংশোধনী এনে সাজার পরিমান কমিয়ে তিন বছরের বিনা শ্রম জেলের বিধান করা হয় । কিন্তু সেই দণ্ড পাওয়ার নজির বিরল। ইলিয়াস কাঞ্চন প্রশংসনীয়ভাবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করছেন। তাঁকে কখনো সইতে হচ্ছে গঞ্জনা। কিন্তু তাঁর অর্জন ব্যাপকতা পাচ্ছে না। মর্মান্তিক কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে একটা হইচই পড়ে যায়। এরপর আবার ঘুম। তাই মনে হলো, এ কথা বলা দায় স্বীকারকে উৎসাহিত করার একটা বিধিবিধান বাংলাদেশে চালু করা যায় কি না।
উন্নত সমাজে দায় স্বীকার একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে মনে পড়ছে। টেড কেনেডি হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। ১৯৬৯ সাল। মিজ মেরি জোকে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনা ঘটান তিনিই। তিনি জন এফ কেনেডি ও রবার্ট কেনেডির ভাই। দুজনই নিহত হন। সমগ্র আমেরিকার সহানুভূতি পেয়েছিলেন তিনি। অনেকেই ভাবছিলেন, তিনিই হবেন আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটে টেড গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টিভি ভাষণে তিনি দোষ স্বীকার করেন। বলেন, তিনি সিনেটর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ভাবছেন। তাঁর অনুকূলে দরদ তাতে আরও উতলে ওঠে। এমনকি নিহত মেরির মা তাঁকে পদত্যাগ না করতে অনুরোধ করেন। তবে এটাও সত্য, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সেই গাড়ি দুর্ঘটনা তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে ম্লান করেছে, সুযোগটা হাতছাড়া করতে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশি হাশেমের শোকাহত স্ত্রী আয়েশার একটি সান্ত্বনা আছে। ঘাতক চালক দোষ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশে যারা গাড়ি দুর্ঘটনায় স্বজন হারায়, তাদের সাধারণত কোনো সান্ত্বনা থাকে না। সুতরাং এখানে একটা সংস্কার আনা যায় কি না, তা আমরা ভাবতে পারি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
হাশেমের সহযাত্রী মোহাম্মদ মাফুজ। তাঁর বর্ণনায়, ‘গাড়িটি যখন আঘাত হানে, তখন মনে হচ্ছিল, আমাদের ওপর ১০টি বোমা ফেলা হয়েছে।’ আদালত দুর্ঘটনার বৃত্তান্ত শোনেন। আদালত জানেন, নিহত হাশেম সমস্যায় পড়েছিলেন। তাঁর গাড়ির গতি কমানো হয়েছিল। এমনকি দুর্ঘটনার আগে সেটি থেমে গিয়েছিল। হতভাগ্য হাশেমের ২৫ বছর বয়সী স্ত্রী আয়েশা বলেন, তাঁর স্বামী গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করেছিলেন। এমনকি বিপদে পড়ার বাতি জ্বালিয়েছিলেন। তখনই গাড়ির রিয়ারভিউতে তাঁর চোখ পড়ে। তিনি দেখতে পান, হোয়াইটের ভ্যান ধেয়ে আসছে। হাশেম চিৎকার করেন, ‘আমাকে হত্যা করতে যাচ্ছে। গাড়িটি দ্রুত ধেয়ে আসছে।’ আয়েশা বলেন, আঘাত হানার পর তিনি তাঁর স্বামীর কান থেকে রক্ত ঝরতে দেখেন। প্যাথলজিস্ট দেবোরা কুক ময়নাতদন্ত করেন। তাঁর সাক্ষ্য, মাথায় গুরুতর জখমজনিত কারণে হাশেমের মৃত্যু ঘটেছে। এই মামলার সাক্ষী ছিলেন ব্রায়ান মোমেন্ট। তিনি নিউটন অ্যাবোট থেকে এক্সেটারে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রথম স্থানীয়, যিনি দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখতে পান। দুর্ঘটনার পর হোয়াইট তাঁকে বলেন, ‘আমি তাঁদের কখনো দেখতেই পাইনি।’ নিউটন অ্যাবোট ট্রাফিক ইউনিটের কর্মকর্তা এমসি ডেভিড লিডোল বলেন, এটা ‘রিয়ার-এন্ড শান্ট’ ধরনের দুর্ঘটনা। এর মানে হলো, গাড়ির নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হারিয়ে অন্য গাড়ির ওপর উঠিয়ে দেওয়া। ব্রিটেনে এ ধরনের দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। পুলিশের গাড়ি দুর্ঘটনাবিষয়ক তদন্তকারী ফিলিপ রোয়ান স্মিথ এ ধরনের দুর্ঘটনাকে ‘তাকানো অথচ না দেখা দুর্ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর ধারণা, হাশেমের দুর্ঘটনাকবলিত ফোর্ড হয়তো রাস্তায় চোখে না পড়ার মতো অবস্থায় স্থির ছিল।
তবে পুলিশ বলেছে, দুর্ঘটনার শিকার হওয়া কোনো গাড়িরই যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। এটাও প্রমাণিত, ফোর্ডের বিপদ-বাতি জ্বলছিল। রোয়ান স্মিথের কথায়, যেটা নির্ধারণ করা কঠিন, সেটা হলো ভক্সহলের চালক হোয়াইট কেন থেমে থাকা গাড়িটি দেখতে পাননি। কিন্তু তাঁর চোখে পড়ার কথা ছিল। দক্ষিণ ডেভোনের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ইয়ান অ্যারো আদালতে বলেন, ‘কোনো কারণে হাশেম গাড়িটি চালাতে পারেননি, যে কারণে গাড়িটি এ ৩৮০ ইগল ফার্ম এলাকার কাছে থেমে যায়। গাড়িটিকে পেছন থেকে ধাক্কা মারা হয়েছিল। তিনি গুরুতর আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি ১৭ জুলাই মারা যান।
ঘাতক ভক্সহল ভ্যানচালক হোয়াইট আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর অমনোযোগের ফলেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। আদালত তাঁকে বিনা পারিশ্রমিকে ১০০ ঘণ্টা কাজ করার দণ্ড দেন। ১২ মাস ধরে তিনি কমিউনিটিতে সেবামূলক কাজ করবেন। এ সময় তাঁর গাড়ি চালানো চলবে না। আদালতের খরচ বাবদ তাঁকে শোধ করতে হবে ৮৫ পাউন্ড। আদালত অবশ্য ১২ মাস পর পুনরায় গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র পেতে তাঁকে আর পরীক্ষা দিতে হবে না বলেও আদেশে উল্লেখ করেন।
দোষ বা দায় স্বীকার একটি প্রতিকার, যা আমাদের আইনি রাজ্যে এখনো অচেনা। গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য অভিযুক্ত চালকেরা আন্দোলন করে সফল হয়েছেন। ১৯৮২ সালে দন্ডবিধিতে যখন ৩০৪(খ) ধারাটি সংযোজন করা হয় তখন ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ছিল। সে বিধান এরশাদের আমলে রহিত হয়। ১৯৮৪ সালে সংশোধনী এনে সাত বছর কারাদণ্ড করা হয় । ১৯৮৫ সালে আরেক দফা সংশোধনী এনে সাজার পরিমান কমিয়ে তিন বছরের বিনা শ্রম জেলের বিধান করা হয় । কিন্তু সেই দণ্ড পাওয়ার নজির বিরল। ইলিয়াস কাঞ্চন প্রশংসনীয়ভাবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করছেন। তাঁকে কখনো সইতে হচ্ছে গঞ্জনা। কিন্তু তাঁর অর্জন ব্যাপকতা পাচ্ছে না। মর্মান্তিক কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে একটা হইচই পড়ে যায়। এরপর আবার ঘুম। তাই মনে হলো, এ কথা বলা দায় স্বীকারকে উৎসাহিত করার একটা বিধিবিধান বাংলাদেশে চালু করা যায় কি না।
উন্নত সমাজে দায় স্বীকার একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে মনে পড়ছে। টেড কেনেডি হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। ১৯৬৯ সাল। মিজ মেরি জোকে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনা ঘটান তিনিই। তিনি জন এফ কেনেডি ও রবার্ট কেনেডির ভাই। দুজনই নিহত হন। সমগ্র আমেরিকার সহানুভূতি পেয়েছিলেন তিনি। অনেকেই ভাবছিলেন, তিনিই হবেন আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটে টেড গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টিভি ভাষণে তিনি দোষ স্বীকার করেন। বলেন, তিনি সিনেটর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ভাবছেন। তাঁর অনুকূলে দরদ তাতে আরও উতলে ওঠে। এমনকি নিহত মেরির মা তাঁকে পদত্যাগ না করতে অনুরোধ করেন। তবে এটাও সত্য, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সেই গাড়ি দুর্ঘটনা তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে ম্লান করেছে, সুযোগটা হাতছাড়া করতে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশি হাশেমের শোকাহত স্ত্রী আয়েশার একটি সান্ত্বনা আছে। ঘাতক চালক দোষ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশে যারা গাড়ি দুর্ঘটনায় স্বজন হারায়, তাদের সাধারণত কোনো সান্ত্বনা থাকে না। সুতরাং এখানে একটা সংস্কার আনা যায় কি না, তা আমরা ভাবতে পারি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments