ভিন্নমত-শেয়ারবাজারে ধস : কিছু সত্য প্রবচন বারবার মনে হয় by আবু আহমেদ

শেয়ারবাজারে বড় রকমের ধস না নামলে বাজার যতই বাড়ত, তাতে কারো কিছু আসত-যেত বলে মনে হয় না। বরং আরো উঠতে থাকলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা তাদের সাফল্য বলে দাবি করতেন। সমস্যা হলো, বাজারটি ৮৯০০ সূচকে গিয়ে অতি তাড়াতাড়ি ৫০০০-এর ঘরে চলে এল।


আসার গতিটা এমন ছিল যে বিনিয়োগকারীরা যেন টেরই করতে পারল না। তারা তাদের বিনিয়োগকে বিন্যস্ত করতেও সুযোগ পেল না। তাদের অনেকেরই পুঁজিটা অর্ধেক হয়ে গেল মাত্র কয়েকটি কার্যদিবসে। সাধারণত লোকসান দিয়ে কেউ শেয়ার বেচতে চায় না। তাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। ফল হলো, তারা আরো বড় লোকসানের সম্মুখীন হলো। তাই হারানোর ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত রাস্তায় বিক্ষোভের রূপ নিল।
রাস্তায় যখন ভাঙচুর শুরু হলো, তখন পলিসি মেকাররা নড়েচড়ে বসলেন। শুরু হলো কেন এমন হলো, কে এমন করল ইত্যাদির তালাশ করা। প্রতিটি দেশেই যেমন ধসের পর চোর খোঁজা হয়, বাংলাদেশেও তা-ই খোঁজা হলো। কিন্তু চোর ততক্ষণে টাকার বস্তা নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। বিনিয়োগকারীদের রোষকে কিছুটা প্রশমিত করার জন্য সরকার তড়িঘড়ি করে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করল। সেই কমিটি হয়তো কিছু চোরকে চিহ্নিত করবে, সঙ্গে শেয়ারবাজার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোগত সংস্কারের জন্য অনেক সুপারিশ করবে; কিন্তু তাতে বিনিয়োগকারীরা হারানো টাকা ফেরত পাবেন না। চোরকে শনাক্ত করলেও শাস্তি দেওয়া কতটুকু সম্ভব হবে, সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। কারণ যাদের ধসের জন্য চিহ্নিত করা হবে, তাদের জন্যও আইন-আদালত আছে। বরং তারা কখনো কখনো সরকার থেকেও শক্তিশালী। এ জন্য প্রতিটি দেশেই পরে ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি দেওয়ার থেকে ষড়যন্ত্র যাতে হতেই না পারে, সেদিকে সরকার ও রেগুলেটর নজর রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই নজরটা মোটেই রাখা হয়নি। রাখা হয়নি বলেই আজকে যাদের ষড়যন্ত্রকারী বলা হচ্ছে, তারা নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করছে এই বলে যে, তারা যা করেছে সবই রেগুলেটর ঝঊঈ-এর আইন মেনেই।
আমাদের আসল প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে শেয়ারবাজারের ধসের মধ্যে নয়, শেয়ারবাজার ৮৯০০ সূচকে উঠল কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে। যে বাজার যেখানে যাওয়ার জন্য নয়, সেই বাজারকে সেখানে নিলে তো ধস অনিবার্য। কেউ কি কখনো শুনেছে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্লেসমেন্টও প্রিমিয়ামে বিক্রয় হতে? আর প্লেসমেন্ট বাণিজ্যটা এল কিভাবে? এটা কি বেআইনি ছিল না? টঘউঊজডজওঞওঘ েঅবলোকন বলতে একটা কথা ছিল পাবলিক ইস্যুর ক্ষেত্রে। গত কয়েক বছরে আমরা কেউ কোনো ওচঙ-তেই অবলেখনের ব্যাপারটি দেখিনি। কখন, কোন আইনে ঝঊঈ অবলেখন উঠিয়ে দিয়েছিল? যেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অর্ধমাইলের লাইনে দাঁড়িয়ে ওচঙ-এর জন্য দরখাস্ত দিতেন, সেখানে ঢ়ষধপবসবহঃ-এর দরকার হলো কেন? প্লেসমেন্ট আবার হাতবদল করে একটা অলিখিত, অস্বীকৃত বাজারে চৎবসরঁস-এ বিক্রয় হয়েছে। সত্যি কথা হলো, শেয়ারবাজারের বর্তমান ধসের বীজ বপন হওয়া শুরু হয়েছিল ২০০৯-এর প্রথম থেকেই। যে বাজারে মোট লেনদেনকৃত শেয়ারের ৬০ শতাংশ বা এই পরিমাণ শেয়ার ঋণের মাধ্যমে অর্থায়িত হয়, সেই বাজার অতিদ্রুত যেমন উঠবে, তেমনি অতিদ্রুত পড়বেও।
আজকে ঋণ বিক্রেতারা বেঁচে গেছেন, কিন্তু ঋণের ক্রেতারা বা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা বাঁচতে পারেননি। ২০০৯ এবং ২০১০-এর অর্ধসময় পর্যন্ত কতগুলো ভুসিতুল্য শেয়ারকে জুয়ার আইটেম বানানো হলো এবং ওইগুলোর পেছনে ব্যাংক ঋণ দেওয়া হলো। ফলে দেখা গেলো, একদিন যেসব শেয়ারের ক্রেতা পাওয়া যেত না, সেসব শেয়ার হয়ে পড়ল লাভ করার ক্ষেত্রে অতি মূল্যবান হাতিয়ার। শেয়ারবাজারের অধিকাংশ লোককে ওই জুয়ার ঘুটির পেছনে দৌড়ানো হলো। ওই দেখে যারা পাকা খেলোয়াড়, তারা তাদের সব শেয়ার অস্বাভাবিক উঁচু মূল্যে একেবারে উজাড় করে বিক্রি করে দিয়েছেন। এবং অন্য ব্যবসা থেকে তারা তাদের দুর্বল শেয়ারকে শেয়ারপাগল ক্রেতাদের মধ্যে বিক্রয় করে দেওয়া ভালো ব্যবসা মনে করলেন। যাদের হাতে শেয়ার ছিল না তারা শেয়ার সৃষ্টি করেছেন, তারপর বেচেছেন। তারপর এল ১০০ টাকার শেয়ারকে ১০ টাকার অভিহিত মূল্যে রূপান্তর করা। ১০ টাকা করলে মূল্য বাড়বে, বিনিয়োগকারীদের এই মনস্তাত্তি্বক ধারণাকে অনেকেই নিজেদের পক্ষে কাজে লাগালেন। আর যখন শেয়ারবাজারে ধস নামল তখন ঠিক উল্টো গতিতে ১০ টাকার শেয়ার সম্পূর্ণরূপে ধরাশায়ী হল।
এখনো শেয়ারবাজারে অনেক ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এখনো কথিত মার্জিন লোনকে শেয়ার কেনার জন্য আবারও অবাধ করে দেওয়া হয়েছে বা হবে বলে বলা হচ্ছে। এখনো অনেক শেয়ারের মূল্য বেশি। বিশ্বাস অনেকের হতে চাইবে না। তারপরও সত্যি হলো, বাজারের এই স্তরেও অনেক শেয়ারের মূল্য বেশি। কি কারণে দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোর মূল্য প্রত্যহ ৮-৯ শতাংশ করে বাড়ছে? আমরা যতই উরারফবহফ দেখে শেয়ার কেনার জন্য বলি, কিন্তু কয়জন বিনিয়োগকারী সেই আদর্শ বাক্য শুনতে প্রস্তুত? ঝঊঈ মূল্য বৃদ্ধি বা পতন ঠেকানোর জন্য একটি সার্কিট ব্রেকার আরোপ করেছে সত্য, কিন্তু সেই ব্রেকার ভালো শেয়ারগুলোর মূল্য ঠেকানোর পক্ষেই ভালোভাবে কাজ করে। আর ভুসিতুল্য শেয়ারগুলোর মূল্য ব্রেকার মেনে ঠিকই প্রত্যহ ৮-৯ শতাংশ করে বাড়ছে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.