সময়ের প্রতিবিম্ব-অতি পুরাতন ভাব নব আবিষ্কার by এবিএম মূসা

‘একটি বিশেষ ঘোষণা। মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুর এলাকা থেকে একটি বালক নিখোঁজ হয়েছে, কেউ খোঁজ পেলে এই ঠিকানায় জানাবেন।’ রিকশায় মাইক লাগিয়ে ঘোষণাটি পাড়াময় প্রচার করা হচ্ছে। ঘোষণাটিতে হারানো ছেলে বা মেয়ে কিংবা কোনো ব্যক্তির পারিবারিক পরিচয়, শারীরিক গঠন, পরিধেয় বস্ত্র ও আনুষঙ্গিক বিশেষত্ব ঘোষিত হচ্ছে।


বর্ণিত খবরটি একটি উদাহরণ মাত্র, তবে এমন ‘ঘোষণা’ হরহামেশা বাড়ির বারান্দায় বসে শুনতে পাই। শেষ পর্যন্ত নিখোঁজের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল কি না, তা জানা যায় না। খোঁজ পেলেও তা ঘোষণা করা হয় না। ঘোষণাটি যাঁরা শোনেন, তাঁদের মনে ক্ষণিকের কৌতূহল জাগে মাত্র, এর অধিকতর কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। কিন্তু সম্প্রতি একটি ব্যতিক্রমী ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, বলা যায় তোলপাড় হচ্ছে। সংবাদটি হচ্ছে, সিটি করপোরেশনের বিএনপি-সমর্থক কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নামীয় এক ব্যক্তি ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন।
চৌধুরী আলমের রাজনৈতিক পরিচয় যদি থাকে, তা সর্বজনবিদিত নয়। বিরোধী দল তাদের দলীয় পরিচয় দিয়ে সর্বসাধারণ্যে অজ্ঞাত ব্যক্তিটির এই ‘নিখোঁজ’ হওয়াকে ‘গায়েব’ করে দেওয়া হয়েছে বলে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচারণার সুযোগ পেয়েছে। এই পরিচয় হচ্ছে, তিনি বিএনপির একজন পাতিনেতা। দলে তাঁর অবস্থান যা-ই হোক, ‘নিখোঁজ’ বা ‘গায়েব হওয়া কিংবা নিরুদ্দেশের’ সঙ্গে অতীতের ও বর্তমান আমলের ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’সহ সব হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বহীন একটি রাজনৈতিক পরিচয়কেই বিরোধী দল অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সর্বসাধারণেও এর গুরুত্ব পেয়েছে তাদের নিজেদের অতীতের ও বর্তমান সরকারের আমলের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতার কারণে। ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক যুগের সূচনায় বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর। ‘আইনশৃঙ্খলা’ পরিস্থিতির অবনতি রোধের অজুহাতে হার্ট ক্লিনিং বা কিলিং শুরু হয়। স্বীকার করতে হবে, আইনি সনাতন পন্থায় একটি সরকার দেশ শাসনে ব্যর্থ হলেই অনৈতিক পন্থায় প্রতিবাদীকে শায়েস্তা করার যতসব অভিনব সব পদ্ধতি অবলম্বন করে। ব্যাপক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবাদ ও ক্ষোভের বিস্তারের কারণে প্রকাশ্যে কিলিং অপারেশন, বন্দুকযুদ্ধ অনেকখানি সম্প্রতি বন্ধ আছে। আপাতত স্থগিত আছে, এমনটিও মনে করা যেতে পারে। অতীতের দুর্বৃত্ত দমনের নামে অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরিচালিত অভিযানটির বাস্তবে উদ্দেশ্য কী ছিল, তা নিয়ে বিএনপি সরকারের হুকুমদাতাদের নিজেদেরও সংশয় ছিল। তাই ক্ষমতা ত্যাগের আগে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘ইনডেমনিটি দিলেন’, তাঁরা দায়মুক্ত করে গেলেন। বাস্তবে ‘কিলিং’ বা ক্লিনিং বাহিনীকে নয়, তৎকালীন সরকারের সবাই নিজেদের দায়মুক্ত করে গেলেন। তাঁদের উত্তরাধিকারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ‘ইনডেমনিটি মুক্ত’ করলেও এসব খুনের দায়মুক্তির অবসান ঘটাননি। নিজেদের আমলের শেষেও তাঁরা বন্দুকযুদ্ধ আর হেফাজতে মৃত্যুর ইনডেমনিটি দিয়ে যাবেন কি না, তা যথাসময়ে জানা যাবে।
অপারেশন ক্লিন হার্ট ভিন্ন ভিন্ন, বিচিত্র পদ্ধতিতে ঘটেছে পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পাঁচ দশক ধরে সোচ্চার দলটির আমলে। তারপর কত নামে ডাকি যে তোমায়। বিচিত্র, উদ্ভাবনী জ্ঞানের পরিচায়ক সেসব নাম। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান—এসবই হচ্ছে ক্লিনিং হার্ট অপারেশনের উত্তরসূরি মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ। ইংরেজিতে বলা যায় ‘ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল’, পুরোনো কাজ নতুন পন্থায়। পরবর্তী সরকার পুরাতন পদ্ধতিকে নতুন নাম দিয়েছে, দেশের ও বিদেশের মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘ এগুলোকে অবশ্য পুরোপুরি অর্থহীন অথবা সরাসরি খুন বলছে না, বলে, ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড। সাধারণ মানুষের অনেকের ফিসফিসানি হচ্ছে ‘ঠান্ডা মাথায় খুন’। সম্প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচিত্র ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড, ধরে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় মেরে ফেলা, ‘হেফাজতে মৃত্যু’, প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারা নিয়ে বিচলিত হয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। সেসব নির্দেশনা নির্বাহী বিভাগ কতখানি আমলে নেবে ভবিতব্যই বলতে পারে।
যা হোক, দেশি-বিদেশি সমালোচনা ক্ষমতাসীন সরকারকে একটুখানি হলেও বিব্রত করেছে। কিলিং, এনকাউন্টার, আত্মরক্ষার্থে গুলি চালনা, মানুষের জীবন রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও সংগঠন সদস্যদের খুনের ঘটনা এখন অনেকখানি কমে এসেছে। তবে নিন্দুকেরা বলছেন, কমেনি ‘অপ্রকাশ্য’ হয়ে গেছে, বস্তুত, গোপন করা হচ্ছে। তাঁদের মনে হচ্ছে, বিচারবহির্ভূত খুনেরই ভিন্নরূপ ‘গায়েব করে দেওয়া’, ভিন্নার্থে ‘নিরুদ্দেশ’। তবে সম্প্রতি পুলিশের হাতে ‘প্রকাশ্য’ মৃত্যুর ঘটনা ‘নিরুদ্দেশের’ পর্যায়ে পড়ে না বলে সরকার একটু বেকায়দায় পড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছে। তারপরও সবাই বলছেন, ‘ও কিছু না, সময়ে চাপা পড়ে যাবে।’
এদিকে বিরোধী দলও দেশি-বিদেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে সরকারবিরোধী প্রচারণাকে নতুন মাত্রা দিয়ে চাঙা করতে চায়। এ কারণে বর্তমান সরকারের জন্য নতুন ঝামেলা বাধিয়েছে অথবা নতুন মাত্রা যোগ করেছে, ‘নিখোঁজ’। এই নিখোঁজ নিয়েই বিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনের পুকুরে ঢেউ খেলাচ্ছে, আমি ভাবছি, সত্যিই লোকটা গেল কই। পত্রিকায় যেমন হঠাৎ একটি বিচিত্র খবর পাওয়া যায় ‘এত দিন নিহত বলে কলিমুদ্দিনকে হত্যার দায়ে সলিমুদ্দিনকে জেল দেওয়া হয়েছে।’ হঠাৎ কয়েক বছর পর জানা গেল, তাকে কোনো বিশেষ স্থানে ‘আবিষ্কার’ করা হয়েছে। বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে গায়েব করে রাখা হয়েছিল, হঠাৎ উদয় হয়েছে। কিন্তু এই গায়েবটি করল কে? চৌধুরী আলমের ব্যাপারটি তেমন কিছু কি না, সরকারপক্ষের কেউ কেউ অপ্রকাশ্যে এমনটিও বলছেন। কিন্তু তাঁদের এতসব করিতকর্মা সংস্থা এমন বক্তব্যটি প্রমাণ করতে পারছেন না বলেই বিরোধী দলের গায়েব করার অভিযোগ জোরদার হয়েছে।
আরেকটি প্রশ্ন, আলমকে নিয়ে হইচই বাধানোর আগে বেশ কিছুদিন বিরোধী দল চুপ ছিল কেন? যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, তাঁদের ‘গিল্টি কনসান্স’ অপরাধী মনোভাবটির কারণেই কি এত দিন তাঁরা নিজেরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দেননি? বিএনপির অখ্যাত পাতিনেতা চৌধুরী আলমের ক্ষেত্রে কোনটি সত্যি—তা আবিষ্কারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন গরজ পরিলক্ষিত হয়নি। এ কারণেই ‘নিখোঁজ’ হওয়ার সঙ্গে অতীতের ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ সামঞ্জস্য খুঁজছে সবাই। এমনকি বিচার বিভাগ পর্যন্ত এখন অতীত-বর্তমানের মানবতাবিরোধী রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতসব ক্লিনিং, হার্ট ফেল, বন্দুকযুদ্ধে একতরফা মৃত্যু নিয়ে অতীতে যেসব সংস্থা যতটা সোচ্চার হয়েছিল, এবার তেমন হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনজন নিরীহ ব্যক্তিকে পুলিশের হাতে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হলো ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ হয়েছিল, হয়েছে এবং হচ্ছে। শুধু দেশে-বিদেশে একটু-আধটু তোলপাড় হয়েছে। কিন্তু অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আমাদের উচ্চতম আদালত এ তিনটি মৃত্যুকে সরাসরি আমলে নিয়েছেন। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে হারিয়ে যায়নি, এ জন্য আমাদের মহামান্য উচ্চ আদালতের বিচারকদের বিলম্বিত পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করছি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে যে একটু-আধটু সংশয় বিরাজ করছিল, তা অনেকাংশে দূর হয়েছে তাঁদের এই তৎপরতার কারণে। এমনকি অস্বাভাবিক পন্থায় নিহত তিন হতভাগ্যের আত্মার প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই। তাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে অতীত ও বর্তমানের বিচিত্র সব সরকারের আমলের নানা নামে বিচিত্র সব প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সর্বসাধারণ্যের বিবেককে কিছুদিনের জন্য হলেও নাড়া দিতে পেরেছেন। ‘কিছুদিন’ বললাম কারণ আমি আগেই বলেছি, সব হত্যাকাণ্ডের মতো এগুলোও কিছুদিন উত্তালতা বা সুনামি সৃষ্টি করে অবশেষে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যাবে।
হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে বিজ্ঞ আইনবিদ ড. শাহ্দীন মালিকের শ্লেষাত্মক প্রতিবেদন প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। সেই শ্লেষের মর্মার্থ আমাদের শাসক মহলের কতখানি হূদয়ঙ্গম হবে, জানি না। তবে আসিফ নজরুলের সরাসরি বিশ্লেষণ আমার কাছে তাঁর জ্ঞানগর্ভ লেখা বা টক শো বক্তব্যের আদলে অধিকতর সহজবোধ্য হয়েছে। যা হোক, এ দুজনের প্রতিবেদন দুটির প্রতিক্রিয়ায় অথবা বিষয়বস্তুটি নিয়ে আমি একটুখানি ভিন্নতর বক্তব্য দিয়েছি। তবে আমার বক্তব্য তাঁদের দেওয়া বর্ণনার মূল ভাষ্য থেকে ভিন্নতর নয়। বিষয়ও এক ও অভিন্ন, তবে আমার কথাবার্তা-লেখালেখি জ্ঞানগর্ভ নয়, সাবধানী শব্দচয়নও নেই, অত্যন্ত চাঁছাছোলা। শুরুতেই বলেছি, তিনজন নিরীহ ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, এ ধরনের হত্যার পরিমাণ বর্তমান সরকারের আমলে একটু বেশি বেশি হওয়ায় এবং ‘ক্লিন হার্ট’ আর ‘এনকাউন্টার’ ভিন্ন রূপ নিয়েছে বলে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। সঠিক বা বেঠিক হোক, সবাই মনে করছেন এসবই হচ্ছে ‘নিখোঁজ হওয়া, নিরুদ্দেশ করে দেওয়া’ ক্লিনিং-এনকাউন্টারে অতি পুরাতন ভাব নব আবিষ্কার।
কিন্তু সব আবিষ্কারেরই অপরূপ অগ্রযাত্রা ও পরিণতি থাকে। যেমন—আমার প্রবাসী কলামিস্ট বন্ধু গাফ্্ফার চৌধুরী ইতিমধ্যে নাৎসি জার্মানির গেস্টাপে, চিলির পিনোচেটের ‘তুলে নিয়ে’ গায়েব করে দেওয়া, ইরানের শাহের সাভাক বাহিনীর প্রকাশ্য হত্যার উদাহরণ দিয়ে ‘সরকারি হত্যার’ ক্রমবিকাশের কাহিনির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে একটি পত্রিকায় এ কথাই বলেছেন। বর্তমান সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু গাফ্ফার বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলের ঘটনাবলিকে ফ্যাসিস্ট আমলের নির্মমতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু সেসব সরকার সব শেষ পর্যন্ত ‘হজম’ করতে পারেনি। তাদের পরিণাম এখন সর্বজনবিদিত।
এবার চৌধুরী আলমের ‘নিরুদ্দেশ’ নিয়ে একটি গ্রাম্য ঘটনার বিবরণ দেওয়ার মাধ্যমে ভিন্ন ধরনের চিন্তার আভাস দেব। মেহেরবানি করে কেউ চৌধুরী আলমের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে অতঃপর বর্ণিত কাহিনির সম্পর্ক খুঁজবেন না। পুরাতন গ্রাম্য কাহিনিটি বলছি। গাঁয়ের এক কুটিল ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর প্রতিবেশীর ঝগড়া আর মামলা-মোকদ্দমা লেগেই থাকত। মরণকালে সেই ব্যক্তি ছেলেদের বললেন, ‘আমার মৃত্যু স্বাভাবিক হলেও “লাশ আমার চিরশত্রু অমুকের বাড়ির সামনের গাছে ঝুলিয়ে রাখবি।” যথা হুকুম তথা কাজ। মৃত্যুর পরদিন পুলিশ এসে সেই প্রতিবেশীকে খুনের দায়ে বেঁধে নিয়ে গেল। বুঝহ সে লোক যে জানো সন্ধান।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.