সহজিয়া কড়চা-শুধু সংবিধান সংশোধন নয়, প্রয়োজন রাজনীতিকদের সংশোধন by সৈয়দ আবুল মকসুদ
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা মৌলিক আইন। কোনো কোনো দেশের কনস্টিটিউশনকেই বলা হয় ‘মৌলিক আইন’। যেমন জার্মানির সংবিধানের নাম Basic Law। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের অবসানের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি ৩৪ সদস্যের সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২-এর ১০-১১ এপ্রিল কমিটির প্রথম বৈঠক বসে। দ্বিতীয় ও শেষ বৈঠকটি বসে ১২ অক্টোবর। তারপর তিন সপ্তাহের মতো আলোচনা করে ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর এবং বাংলাদেশের নাম হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
ভালো হোক মন্দ হোক, ওই সংবিধান রচনার একক কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। সে জন্য বিভিন্ন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে কঠোর সমালোচনা করে। তারা চাইত, সব দল সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করুক। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমালোচনা ছিল খুবই কঠোর। মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সমালোচনা ছিল অপেক্ষাকৃত নরম। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পাঁচ দিন আগে মস্কোপন্থী ন্যাপ পল্টন ময়দানে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করে ২৯ অক্টোবর। সে উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে পীর হাবিবুর রহমান, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন:
‘গভীর ক্ষোভ ও পরিতাপের বিষয় যে, শাসনতন্ত্রের মতো জাতির একটি পবিত্র দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে শাসক দল চরম একদলীয় সংকীর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছে। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জনমত যাচাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলির মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের তোয়াক্কা তাঁহারা করেন নাই। ...খসড়া শাসনতন্ত্রে এমন কতিপয় মারাত্মক ও ত্রুটিপূর্ণ বিধান রহিয়াছে যাহাতে গণতন্ত্রের প্রতি বাধা ও হুমকি দেখা দিয়াছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যাহা সমগ্র জাতির সুদৃঢ় সংকল্প, খসড়া শাসনতন্ত্রে কেবলমাত্র ইহা সদিচ্ছারূপে ব্যক্ত করা হইয়াছে। ইহার কোনো আইনগত বিধান শাসনতন্ত্রে নাই।’
ন্যাপের জনসভায় ‘বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ’ তোলা হয়: ‘প্রধানমন্ত্রীর অযৌক্তিক ক্ষমতা কমাইয়া পরিষদকে সার্বভৌম করিতে হইবে।’ অন্যান্য দলও ’৭২-এর সংবিধানের সমালোচনা করে।
সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন তাঁরাই তা হত্যা করেন ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপর সেই মৃতদেহকে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। মূল সংবিধানের সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের দূরত্ব বিশাল।
সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাঁরা জাতীয় পরিষদে ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরাই ছিলেন সাংবিধানিক সভার সদস্য। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ (মো) থেকে। খসড়া সংবিধানে তিনি স্বাক্ষর করেননি। বর্তমানে তিনি বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্পর্কে ২০ জুলাই তিনি সাংবাদিকদের বলেন:
‘পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধানের সার্বিক এই সংশোধনের বিষয়টি হবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশে ’৭৫-পূর্ব সাংবিধানিক রাজনীতির পুনর্জাগরণ হবে। অন্যদিকে ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত হবে। যাত্রা শুরু হবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের, বিজয় হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার।...সংবিধানের এই সংশোধনের ফলে বিএনপি সংঘাতিক বেকায়দায় পড়বে। কারণ তাদের রাজনীতি পঞ্চম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করেই গঠিত। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর তাদের সাংবিধানিক রাজনীতি বলতে আর কিছু থাকবে না। একই দশা জামায়াত ও জাতীয় পার্টিরও (এরশাদ)। এসব দলের রাজনীতির কাঠামো কী হবে, কী হবে তাদের রাজনীতি, বলা কঠিন। আগামীতে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সম্ভাব্য এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো তৈরি হবে, তা অন্তত পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারবে না।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রবীণ আইনজীবী ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন বাম বলয়ের রাজনীতিক। এখন মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগে আছেন। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ আমি তাঁর রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত। ধারণা করেছিলাম, তিনিই হবেন সংবিধান সংশোধন কমিটির প্রধান। হলে খুশি হতাম। তবে মূল দায়িত্ব তাঁকেই পালন করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে কয়েক দিন ধরে তিনি যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে খুশি হতে পারিনি।
মহাজোট যেভাবে সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছে তাতে কীভাবে ‘পঁচাত্তর-পূর্ব রাজনীতির পুনর্জাগরণ’ ঘটবে, তা আমার মাথায় আসে না। ‘পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত’ কীভাবে হবে, তাও বুঝতে অপারগ। বিএনপির রাজনীতি ‘বেকায়দায়’ পড়লে তো ভালো। জামায়াত এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিও যদি বেকায়দায় পড়ে তাতে তো পোয়াবারো জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫১-র কম এবং জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি যৌথভাবে যদি দেড় শ আসন পায়, তাহলে ওই দুই দলের কোনো নেতাই হবেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলে বসতে হবে শেখ হাসিনাকে। নেতাদের কথাবার্তা শুনে সপ্তাহখানেক যাবৎ মনে হচ্ছে তাই।
বাংলাদেশে সব কিছুই ‘অতি দ্রুত’ করার যে কালচার শুরু হয়েছে তা কৌতূহলের সৃষ্টি না করে পারে না। মহাজোটের নেতারা বেগম জিয়ার বিএনপিকে তো নয়ই, ‘সময়’কে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন, সময় অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার মতো জিনিস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। একদিকে তাঁরা ২০২১ বা ২০৪৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চান, অন্যদিকে সময়কে বিশ্বাস করেন না। ভয় পান। তাই সময় নিয়ে ভেবে-চিন্তে কিছু করার নীতিতে তাঁরা বিশ্বাসী নন। তা ছাড়া আর একটি জিনিস তাঁরা ভুলে গেছেন। গণতান্ত্রিক সরকার আর সামরিক সরকার এক জিনিস নয়। সন্ধেবেলা কলমের এক খোঁচায় সামরিক শাসক যা করতে পারেন, গণতান্ত্রিক নেতা তা পারেন না।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া, জনগণের মতামত না নিয়ে ‘অতি দ্রুত’ কাজ করতে গেলে ভুল হয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ ‘এক রাতের মধ্যে’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখা হয়েছিল। সে জন্যে রচয়িতার অগোচরেই সেটি হয়ে থাকে একটি অগণতান্ত্রিক দলিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন...রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী ও যে রূপ প্রয়োজন বিবেচনা করেন সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, কর ধার্য ও আদায় করিবার এবং অর্থসমূহ ব্যয় করিবার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতবি করার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যে রূপ প্রয়োজন হইবে সে মত কার্য করিবেন।’
এই বক্তব্যে প্রজাতন্ত্র কোথায় আর গণতন্ত্র কোথায়? রাষ্ট্রের জন্মের শুরুতেই রাষ্ট্রের একনায়কত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। ব্রিটেনের রানি, স্পেনের রাজা বা জাপানের সম্রাটেরও তো এই ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে একজন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে গণ্য না করে তাঁকে একজন সর্বশক্তিমান সামন্তপ্রভু বানানো হয়েছিল, যা শুধু মধ্যযুগেই সম্ভব ছিল।
যুদ্ধের মধ্যে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সরকার না ছিল রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির, না সংসদীয় পদ্ধতির। ’৭২-এ যে সরকার গঠিত হয় তা ছিল সংসদীয় পদ্ধতির। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের চেতনার ভিত্তিতেই এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে এমন ক্ষমতা সংবিধান দেয় যা ‘নির্বাচিত একনায়কত্ব’কে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রধানমন্ত্রীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর দলের অন্য সদস্যরা শক্তিহীন। মন্ত্রী হওয়ার আশায় এবং মন্ত্রিত্ব রক্ষা করতে সাংসদদের প্রধানমন্ত্রীকে তোয়াজ করতেই হবে। তাতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী।
এক রাতে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ লেখা এবং যৎসামান্য আলোচনা করে সংবিধান রচনা শুধু বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। আধুনিক যুগের লিখিত সংবিধানের মধ্যে আমেরিকার সংবিধান সবচেয়ে পুরোনো। বহু মনীষীর চিন্তার ফসল ওই সংবিধান। সংবিধানসংক্রান্ত কত দলিল তাদের! ৪ জুলাই ১৭৭৬-এর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’, ১২ জুলাইয়ের ভার্জিনিয়া এসেম্বলিতে ‘দ্য ভার্জিনিয়া বিল অব রাইটস’ এবং ‘ভার্জিনিয়া স্ট্যাটিউট অব রিলিজিয়াস লিবার্টি’, ২৩ এপ্রিল ১৭৮৪-র ‘জেফারসন’স অর্ডিন্যান্স’, ১৩ জুলাই ১৭৮৭-র ‘দ্য নর্থওয়েস্ট অর্ডিন্যান্স’, ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১-এর ‘দ্য বিল অব রাইটস’ এবং ১৮৬৫, ১৮৬৮, ১৮৭০, ১৯১৩-এর সংবিধান সংশোধন যখন আমরা পাঠ করি, তখন ও দেশের রাজনীতিকদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, এখন আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাকে নৃশংসতা করা অন্য অধ্যায়।
সব দেশেই সংবিধান খুব ভেবে-চিন্তে লেখা হয়। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও জাপানে সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। আত্মসমর্পণের দুই বছর পর জাপান তার সংবিধান গ্রহণ করে ১৯৪৭-এর মে-তে। সাম্রাজ্যবাদী অতীত থেকে জাপান সরে এসে এক নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করে। ডায়েট বা পার্লামেন্টকে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধান ভারতের। সেটির প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর। তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিন্দু। বর্ণহিন্দুদের আচরণে তিষ্ঠোতে না পেরে ১৯৫৬-তে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেই সংবিধান লিখতে পারতেন তিনমূর্তিভবনের বিশাল বাড়িতে বসে। কিন্তু তা না করে দায়িত্ব দেন আম্বেদকরকে।
আম্বেদকর কাউকে খুশি করার পাত্র ছিলেন না। কোনো মতলবি মানুষও ছিলেন না। কোনো গোষ্ঠীর আবদার মেনে নেওয়ার লোকও ছিলেন না তিনি। সংবিধান রচনার সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে তাঁর লেগে যায়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের লেখা বিল তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের বিলের বিপরীতে পণ্ডিত নেহরু রচনা করেন আর একটি ‘হিন্দু কোড বিল’। অসাম্প্রদায়িক নেহরুর বিলটিই আম্বেদকর গ্রহণ করেন। হিন্দু কোড বিল নিয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ, নেহরু ও আম্বেদকর যে বিতর্ক করেন, সে সম্পর্কে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নিশ্চয়ই জানেন। ওটাকেই বলে গণতন্ত্র। ভিন্নমত শুনেই বর্জন করতে হয়। ভিন্ন মতাবলম্বীকে কৌশলে বা চাতুর্য করে দূরে রাখা গণতন্ত্র নয়।
তিন তুড়িতে সংবিধান সংশোধন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধী। সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া অপরাধ। যে অপরাধ করেছেন আমাদের দুই সামরিক শাসক—জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। জিয়া বিসমিল্লাহ যোগ করার পর এবং এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করার পর থেকে একজন নাগরিক হিসেবে আমি অব্যাহতভাবে তার বিরোধিতা করেছি। আমরা চাইতাম অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমাদের সংবিধানের মূল অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি পুনরুদ্ধার করুক। শেখ হাসিনার পক্ষেই সেটা করা স্বাভাবিক। তবে তিনি যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না, তাও জানি। কাজটি শেখ হাসিনা করতে পারতেন সব দলকে আস্থায় এনে। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই। সেটা তিনি পেরেছিলেন বেগম জিয়াকে আস্থায় এনে। সেদিনের সংসদের দৃশ্যটি আমার মনে আছে। সেদিন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।
এবার তা নয়। সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছেন তিনি একা, তাঁর কয়েকজন নতুন মোসাহেবকে নিয়ে। যে ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি গঠিত হয়েছে, তাকে একদলীয় বললে কম বলা হয়। এই কমিটি যা করবে, তা তিনি সামরিক শাসকদের মতো এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা প্রশাসনিক ক্ষমতাবলেই করতে পারতেন। এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়েছে যে দল সেই বিএনপির কাছে মাত্র একটি নাম না চাইলেই পারতেন। বাংলাদেশের নিয়তিই হয় ক্ষমতাসীন দলের গণতান্ত্রিক শাসন অথবা সামরিক শাসন। সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন এ দেশে নিষিদ্ধ।
সবকিছুই তড়িঘড়ি ‘অতি দ্রুত’ কাঁচা হাতে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না গেলে বাংলাদেশ বাঁচবে না এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের চেয়ে মহাজোটের ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতারাই বেশি মুখর। মৌলবাদী দল ও ইসলামি রাজনীতি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। সুতরাং ক্ষমতার রাজনীতিতে ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য কোনো বড় বাধা নয়।
অনেক কথারই অর্থ বোঝা কঠিন। বলা হচ্ছে ‘হাইকোর্টের প্রতি সম্মান দেখিয়ে’ সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে। এর পরিষ্কার অর্থ হাইকোর্ট না বললে আমরা সংশোধনে যেতাম না। বুধবার প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমতে’ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন তাঁরা পেয়েছেন ‘একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি আসন পাওয়া আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়।
প্রয়োজনে সব দেশেই সংবিধান সংশোধন করা হয়, কিন্তু সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া হয় না। সংবিধানের basic structure-এর পরিবর্তন বিষয়ে উপমহাদেশে অনেকগুলো বিখ্যাত মামলা হয়েছে। ভারতের সংবিধানসংক্রান্ত বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে গোলকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (১৯৬৭), ইন্দিরা নেহরু গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ (১৯৭৫), কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩), মিনার্ভা মিলস বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (১৯৮০) প্রভৃতি। পাকিস্তানেও সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার বিষয়ে মামলা হয়েছে। যেমন—ফজলুল কাদের চৌধুরী বনাম মোহাম্মদ আবদুল হক (১৯৬৩), সুলেমান বনাম প্রেসিডেন্ট (১৯৮০) প্রভৃতি। আমাদের সংশোধনীর বিষয়েও যে মামলা-মোকদ্দমা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আইন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ইউরোপের সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতা পায় বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে। খালেদা জিয়া-নিজামীরা সে আয়োজন করেছিলেন। আমরা তা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। সে মুক্তি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে, গায়ের জোরে নয়। গলা টিপে ইসলামি রাজনীতি বন্ধ করতে গেলে আরও জঙ্গিজাতীয় ধর্মান্ধ রাজনীতি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার পরিণাম হবে জাতীয় জীবনে ভয়াবহ।
অন্য তাৎপর্যও আছে। ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কাজ করে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাঁদের ডলার-রিয়ালে-দিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুক ভরে গেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও দাতাগোষ্ঠীর খয়রাতি টাকায় নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা মাত্র ওই সব দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাবে। আমাদের শ্রমিকদের শূন্যস্থান পূরণ করবেন ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিকেরা। তাতে বাংলাদেশে বেকারত্ব শুধু বাড়বে না, ভারতবিরোধী চেতনাও চাঙা হবে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতির জন্য শুধু মৌলবাদী পাকিস্তানপন্থী লোকেরাই দায়ী নয়। বামদের একটি গোত্রের ভূমিকা বিরাট। ১৯৭৫-এর ১৫ নভেম্বরের এক বিবৃতির পর মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, ড. আখলাকুর রহমান, কর্নেল তাহের এবং হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হলে জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও বিপ্লবী গণবাহিনী এক বিবৃতিতে বলে: ‘সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা মোকাবিলার কোনো সাধ্যই ক্ষমতাসীন সরকারের নেই।...ভারতীয় আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমস্ত গোপন ও অসম চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।’
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ ইউনাইটেড পিপলস পার্টির পক্ষে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া প্রমুখ দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে বলেন: ‘একুশের চেতনা প্রতিরোধের চেতনা। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসী পাকিস্তানি নিপীড়নের ২৪ বছর এবং মুজিবী বিশ্বাসঘাতকতা ও সন্ত্রাসের দিনগুলোতে কোনো কিছু পরোয়া না করে একের পর এক কঠিন কঠোর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজ যখন সীমান্তে ভারতীয় হানাদাররা হামলা চালাচ্ছে, রুশ-ভারত চক্রের এ দেশীয় অনুচররা নানা কায়দায় এই হামলার জমিন তৈরি করতে একটুও দ্বিধা করছে না...’
সব দোষ মধ্যযুগপন্থী ইসলামি মৌলবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ হবে না। সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করলে বাংলাদেশে মাওবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটবে। তাদের যদি নিষিদ্ধ ধর্মীয় মৌলবাদীরা সহযোগিতা দেয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলেই মার্শাল ল আসা বন্ধ হবে। সবচেয়ে সেক্যুলার সংবিধানও যেমন ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না, সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক সংবিধানও ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না। ইরানের শাহ তো ছিলেন সেক্যুলার শাসক। সুস্থ গণতন্ত্র ও সুশাসনই পারে অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখল বন্ধ করতে।
বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সরকার নিজেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এখন সরকারের উচিত হবে সেই সংবিধান গণভোটে দেওয়া। অগণতান্ত্রিক, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান সংশোধন করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো, রাজনীতিকে সংশোধন করা অর্থাৎ রাজনীতিকদের সংশোধিত হওয়া। সবচেয়ে ভালো সংবিধানও ভালো গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তা দিতে পারেন সুশিক্ষিত ও ন্যায়নীতিসম্পন্ন এবং ভালো স্বভাবচরিত্রসম্পন্ন রাজনীতিকেরাই।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ভালো হোক মন্দ হোক, ওই সংবিধান রচনার একক কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। সে জন্য বিভিন্ন বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে কঠোর সমালোচনা করে। তারা চাইত, সব দল সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করুক। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমালোচনা ছিল খুবই কঠোর। মোজাফ্ফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সমালোচনা ছিল অপেক্ষাকৃত নরম। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পাঁচ দিন আগে মস্কোপন্থী ন্যাপ পল্টন ময়দানে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করে ২৯ অক্টোবর। সে উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে পীর হাবিবুর রহমান, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন:
‘গভীর ক্ষোভ ও পরিতাপের বিষয় যে, শাসনতন্ত্রের মতো জাতির একটি পবিত্র দলিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে শাসক দল চরম একদলীয় সংকীর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছে। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জনমত যাচাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলির মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের তোয়াক্কা তাঁহারা করেন নাই। ...খসড়া শাসনতন্ত্রে এমন কতিপয় মারাত্মক ও ত্রুটিপূর্ণ বিধান রহিয়াছে যাহাতে গণতন্ত্রের প্রতি বাধা ও হুমকি দেখা দিয়াছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যাহা সমগ্র জাতির সুদৃঢ় সংকল্প, খসড়া শাসনতন্ত্রে কেবলমাত্র ইহা সদিচ্ছারূপে ব্যক্ত করা হইয়াছে। ইহার কোনো আইনগত বিধান শাসনতন্ত্রে নাই।’
ন্যাপের জনসভায় ‘বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ’ তোলা হয়: ‘প্রধানমন্ত্রীর অযৌক্তিক ক্ষমতা কমাইয়া পরিষদকে সার্বভৌম করিতে হইবে।’ অন্যান্য দলও ’৭২-এর সংবিধানের সমালোচনা করে।
সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন তাঁরাই তা হত্যা করেন ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। তারপর সেই মৃতদেহকে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। মূল সংবিধানের সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের দূরত্ব বিশাল।
সত্তরের নির্বাচনে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাঁরা জাতীয় পরিষদে ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরাই ছিলেন সাংবিধানিক সভার সদস্য। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ (মো) থেকে। খসড়া সংবিধানে তিনি স্বাক্ষর করেননি। বর্তমানে তিনি বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্পর্কে ২০ জুলাই তিনি সাংবাদিকদের বলেন:
‘পঞ্চম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধানের সার্বিক এই সংশোধনের বিষয়টি হবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশে ’৭৫-পূর্ব সাংবিধানিক রাজনীতির পুনর্জাগরণ হবে। অন্যদিকে ’৭৫-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত হবে। যাত্রা শুরু হবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের, বিজয় হবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার।...সংবিধানের এই সংশোধনের ফলে বিএনপি সংঘাতিক বেকায়দায় পড়বে। কারণ তাদের রাজনীতি পঞ্চম সংশোধনীর ওপর ভিত্তি করেই গঠিত। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর তাদের সাংবিধানিক রাজনীতি বলতে আর কিছু থাকবে না। একই দশা জামায়াত ও জাতীয় পার্টিরও (এরশাদ)। এসব দলের রাজনীতির কাঠামো কী হবে, কী হবে তাদের রাজনীতি, বলা কঠিন। আগামীতে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও সম্ভাব্য এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো তৈরি হবে, তা অন্তত পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারবে না।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রবীণ আইনজীবী ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন বাম বলয়ের রাজনীতিক। এখন মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগে আছেন। প্রায় ৫০ বছর যাবৎ আমি তাঁর রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত। ধারণা করেছিলাম, তিনিই হবেন সংবিধান সংশোধন কমিটির প্রধান। হলে খুশি হতাম। তবে মূল দায়িত্ব তাঁকেই পালন করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে কয়েক দিন ধরে তিনি যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে খুশি হতে পারিনি।
মহাজোট যেভাবে সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছে তাতে কীভাবে ‘পঁচাত্তর-পূর্ব রাজনীতির পুনর্জাগরণ’ ঘটবে, তা আমার মাথায় আসে না। ‘পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির গণকবর রচিত’ কীভাবে হবে, তাও বুঝতে অপারগ। বিএনপির রাজনীতি ‘বেকায়দায়’ পড়লে তো ভালো। জামায়াত এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিও যদি বেকায়দায় পড়ে তাতে তো পোয়াবারো জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫১-র কম এবং জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি যৌথভাবে যদি দেড় শ আসন পায়, তাহলে ওই দুই দলের কোনো নেতাই হবেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলে বসতে হবে শেখ হাসিনাকে। নেতাদের কথাবার্তা শুনে সপ্তাহখানেক যাবৎ মনে হচ্ছে তাই।
বাংলাদেশে সব কিছুই ‘অতি দ্রুত’ করার যে কালচার শুরু হয়েছে তা কৌতূহলের সৃষ্টি না করে পারে না। মহাজোটের নেতারা বেগম জিয়ার বিএনপিকে তো নয়ই, ‘সময়’কে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন, সময় অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার মতো জিনিস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। একদিকে তাঁরা ২০২১ বা ২০৪৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চান, অন্যদিকে সময়কে বিশ্বাস করেন না। ভয় পান। তাই সময় নিয়ে ভেবে-চিন্তে কিছু করার নীতিতে তাঁরা বিশ্বাসী নন। তা ছাড়া আর একটি জিনিস তাঁরা ভুলে গেছেন। গণতান্ত্রিক সরকার আর সামরিক সরকার এক জিনিস নয়। সন্ধেবেলা কলমের এক খোঁচায় সামরিক শাসক যা করতে পারেন, গণতান্ত্রিক নেতা তা পারেন না।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া, জনগণের মতামত না নিয়ে ‘অতি দ্রুত’ কাজ করতে গেলে ভুল হয়। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ ‘এক রাতের মধ্যে’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখা হয়েছিল। সে জন্যে রচয়িতার অগোচরেই সেটি হয়ে থাকে একটি অগণতান্ত্রিক দলিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন...রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী ও যে রূপ প্রয়োজন বিবেচনা করেন সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, কর ধার্য ও আদায় করিবার এবং অর্থসমূহ ব্যয় করিবার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতবি করার ক্ষমতা তাঁহার থাকিবে, বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ানুগ সরকার দিবার জন্য যে রূপ প্রয়োজন হইবে সে মত কার্য করিবেন।’
এই বক্তব্যে প্রজাতন্ত্র কোথায় আর গণতন্ত্র কোথায়? রাষ্ট্রের জন্মের শুরুতেই রাষ্ট্রের একনায়কত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। ব্রিটেনের রানি, স্পেনের রাজা বা জাপানের সম্রাটেরও তো এই ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে একজন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে গণ্য না করে তাঁকে একজন সর্বশক্তিমান সামন্তপ্রভু বানানো হয়েছিল, যা শুধু মধ্যযুগেই সম্ভব ছিল।
যুদ্ধের মধ্যে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সরকার না ছিল রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির, না সংসদীয় পদ্ধতির। ’৭২-এ যে সরকার গঠিত হয় তা ছিল সংসদীয় পদ্ধতির। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের চেতনার ভিত্তিতেই এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে এমন ক্ষমতা সংবিধান দেয় যা ‘নির্বাচিত একনায়কত্ব’কে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রধানমন্ত্রীই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর দলের অন্য সদস্যরা শক্তিহীন। মন্ত্রী হওয়ার আশায় এবং মন্ত্রিত্ব রক্ষা করতে সাংসদদের প্রধানমন্ত্রীকে তোয়াজ করতেই হবে। তাতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন একনায়ক ও স্বেচ্ছাচারী।
এক রাতে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ লেখা এবং যৎসামান্য আলোচনা করে সংবিধান রচনা শুধু বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। আধুনিক যুগের লিখিত সংবিধানের মধ্যে আমেরিকার সংবিধান সবচেয়ে পুরোনো। বহু মনীষীর চিন্তার ফসল ওই সংবিধান। সংবিধানসংক্রান্ত কত দলিল তাদের! ৪ জুলাই ১৭৭৬-এর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’, ১২ জুলাইয়ের ভার্জিনিয়া এসেম্বলিতে ‘দ্য ভার্জিনিয়া বিল অব রাইটস’ এবং ‘ভার্জিনিয়া স্ট্যাটিউট অব রিলিজিয়াস লিবার্টি’, ২৩ এপ্রিল ১৭৮৪-র ‘জেফারসন’স অর্ডিন্যান্স’, ১৩ জুলাই ১৭৮৭-র ‘দ্য নর্থওয়েস্ট অর্ডিন্যান্স’, ১৫ ডিসেম্বর ১৭৯১-এর ‘দ্য বিল অব রাইটস’ এবং ১৮৬৫, ১৮৬৮, ১৮৭০, ১৯১৩-এর সংবিধান সংশোধন যখন আমরা পাঠ করি, তখন ও দেশের রাজনীতিকদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, এখন আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাকে নৃশংসতা করা অন্য অধ্যায়।
সব দেশেই সংবিধান খুব ভেবে-চিন্তে লেখা হয়। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও জাপানে সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে। আত্মসমর্পণের দুই বছর পর জাপান তার সংবিধান গ্রহণ করে ১৯৪৭-এর মে-তে। সাম্রাজ্যবাদী অতীত থেকে জাপান সরে এসে এক নতুন গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করে। ডায়েট বা পার্লামেন্টকে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সংবিধান ভারতের। সেটির প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর। তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিন্দু। বর্ণহিন্দুদের আচরণে তিষ্ঠোতে না পেরে ১৯৫৬-তে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেই সংবিধান লিখতে পারতেন তিনমূর্তিভবনের বিশাল বাড়িতে বসে। কিন্তু তা না করে দায়িত্ব দেন আম্বেদকরকে।
আম্বেদকর কাউকে খুশি করার পাত্র ছিলেন না। কোনো মতলবি মানুষও ছিলেন না। কোনো গোষ্ঠীর আবদার মেনে নেওয়ার লোকও ছিলেন না তিনি। সংবিধান রচনার সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে তাঁর লেগে যায়। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের লেখা বিল তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের বিলের বিপরীতে পণ্ডিত নেহরু রচনা করেন আর একটি ‘হিন্দু কোড বিল’। অসাম্প্রদায়িক নেহরুর বিলটিই আম্বেদকর গ্রহণ করেন। হিন্দু কোড বিল নিয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ, নেহরু ও আম্বেদকর যে বিতর্ক করেন, সে সম্পর্কে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নিশ্চয়ই জানেন। ওটাকেই বলে গণতন্ত্র। ভিন্নমত শুনেই বর্জন করতে হয়। ভিন্ন মতাবলম্বীকে কৌশলে বা চাতুর্য করে দূরে রাখা গণতন্ত্র নয়।
তিন তুড়িতে সংবিধান সংশোধন গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরোধী। সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া অপরাধ। যে অপরাধ করেছেন আমাদের দুই সামরিক শাসক—জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। জিয়া বিসমিল্লাহ যোগ করার পর এবং এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করার পর থেকে একজন নাগরিক হিসেবে আমি অব্যাহতভাবে তার বিরোধিতা করেছি। আমরা চাইতাম অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমাদের সংবিধানের মূল অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি পুনরুদ্ধার করুক। শেখ হাসিনার পক্ষেই সেটা করা স্বাভাবিক। তবে তিনি যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না, তাও জানি। কাজটি শেখ হাসিনা করতে পারতেন সব দলকে আস্থায় এনে। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে তাঁর উদ্যোগেই। সেটা তিনি পেরেছিলেন বেগম জিয়াকে আস্থায় এনে। সেদিনের সংসদের দৃশ্যটি আমার মনে আছে। সেদিন খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।
এবার তা নয়। সংবিধান সংশোধন করতে যাচ্ছেন তিনি একা, তাঁর কয়েকজন নতুন মোসাহেবকে নিয়ে। যে ১৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি গঠিত হয়েছে, তাকে একদলীয় বললে কম বলা হয়। এই কমিটি যা করবে, তা তিনি সামরিক শাসকদের মতো এক্সিকিউটিভ অর্ডার বা প্রশাসনিক ক্ষমতাবলেই করতে পারতেন। এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়েছে যে দল সেই বিএনপির কাছে মাত্র একটি নাম না চাইলেই পারতেন। বাংলাদেশের নিয়তিই হয় ক্ষমতাসীন দলের গণতান্ত্রিক শাসন অথবা সামরিক শাসন। সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন এ দেশে নিষিদ্ধ।
সবকিছুই তড়িঘড়ি ‘অতি দ্রুত’ কাঁচা হাতে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে না গেলে বাংলাদেশ বাঁচবে না এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতেই হবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের চেয়ে মহাজোটের ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতারাই বেশি মুখর। মৌলবাদী দল ও ইসলামি রাজনীতি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ একাধিকবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। সুতরাং ক্ষমতার রাজনীতিতে ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আওয়ামী লীগের জন্য কোনো বড় বাধা নয়।
অনেক কথারই অর্থ বোঝা কঠিন। বলা হচ্ছে ‘হাইকোর্টের প্রতি সম্মান দেখিয়ে’ সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে। এর পরিষ্কার অর্থ হাইকোর্ট না বললে আমরা সংশোধনে যেতাম না। বুধবার প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমতে’ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন তাঁরা পেয়েছেন ‘একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি আসন পাওয়া আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়।
প্রয়োজনে সব দেশেই সংবিধান সংশোধন করা হয়, কিন্তু সংবিধানের মূল জায়গায় হাত দেওয়া হয় না। সংবিধানের basic structure-এর পরিবর্তন বিষয়ে উপমহাদেশে অনেকগুলো বিখ্যাত মামলা হয়েছে। ভারতের সংবিধানসংক্রান্ত বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে গোলকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য (১৯৬৭), ইন্দিরা নেহরু গান্ধী বনাম রাজনারায়ণ (১৯৭৫), কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩), মিনার্ভা মিলস বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (১৯৮০) প্রভৃতি। পাকিস্তানেও সংবিধানের মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার বিষয়ে মামলা হয়েছে। যেমন—ফজলুল কাদের চৌধুরী বনাম মোহাম্মদ আবদুল হক (১৯৬৩), সুলেমান বনাম প্রেসিডেন্ট (১৯৮০) প্রভৃতি। আমাদের সংশোধনীর বিষয়েও যে মামলা-মোকদ্দমা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আইন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। খ্রিষ্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি ইউরোপের সব দেশেই আছে। বাংলাদেশে মৌলবাদীরা যদি ক্ষমতা পায় বাংলাদেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে। খালেদা জিয়া-নিজামীরা সে আয়োজন করেছিলেন। আমরা তা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। সে মুক্তি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে, গায়ের জোরে নয়। গলা টিপে ইসলামি রাজনীতি বন্ধ করতে গেলে আরও জঙ্গিজাতীয় ধর্মান্ধ রাজনীতি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার পরিণাম হবে জাতীয় জীবনে ভয়াবহ।
অন্য তাৎপর্যও আছে। ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কাজ করে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাঁদের ডলার-রিয়ালে-দিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুক ভরে গেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও দাতাগোষ্ঠীর খয়রাতি টাকায় নয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা মাত্র ওই সব দেশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাবে। আমাদের শ্রমিকদের শূন্যস্থান পূরণ করবেন ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিকেরা। তাতে বাংলাদেশে বেকারত্ব শুধু বাড়বে না, ভারতবিরোধী চেতনাও চাঙা হবে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতির জন্য শুধু মৌলবাদী পাকিস্তানপন্থী লোকেরাই দায়ী নয়। বামদের একটি গোত্রের ভূমিকা বিরাট। ১৯৭৫-এর ১৫ নভেম্বরের এক বিবৃতির পর মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, ড. আখলাকুর রহমান, কর্নেল তাহের এবং হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হলে জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও বিপ্লবী গণবাহিনী এক বিবৃতিতে বলে: ‘সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা মোকাবিলার কোনো সাধ্যই ক্ষমতাসীন সরকারের নেই।...ভারতীয় আগ্রাসন নীতির বিরুদ্ধে শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমস্ত গোপন ও অসম চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।’
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ ইউনাইটেড পিপলস পার্টির পক্ষে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া প্রমুখ দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে বলেন: ‘একুশের চেতনা প্রতিরোধের চেতনা। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসী পাকিস্তানি নিপীড়নের ২৪ বছর এবং মুজিবী বিশ্বাসঘাতকতা ও সন্ত্রাসের দিনগুলোতে কোনো কিছু পরোয়া না করে একের পর এক কঠিন কঠোর সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আজ যখন সীমান্তে ভারতীয় হানাদাররা হামলা চালাচ্ছে, রুশ-ভারত চক্রের এ দেশীয় অনুচররা নানা কায়দায় এই হামলার জমিন তৈরি করতে একটুও দ্বিধা করছে না...’
সব দোষ মধ্যযুগপন্থী ইসলামি মৌলবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ হবে না। সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করলে বাংলাদেশে মাওবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটবে। তাদের যদি নিষিদ্ধ ধর্মীয় মৌলবাদীরা সহযোগিতা দেয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। বলা হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলেই মার্শাল ল আসা বন্ধ হবে। সবচেয়ে সেক্যুলার সংবিধানও যেমন ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না, সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক সংবিধানও ধর্মীয় রাজনীতি ঠেকাতে পারে না। ইরানের শাহ তো ছিলেন সেক্যুলার শাসক। সুস্থ গণতন্ত্র ও সুশাসনই পারে অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখল বন্ধ করতে।
বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সরকার নিজেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এখন সরকারের উচিত হবে সেই সংবিধান গণভোটে দেওয়া। অগণতান্ত্রিক, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান সংশোধন করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো, রাজনীতিকে সংশোধন করা অর্থাৎ রাজনীতিকদের সংশোধিত হওয়া। সবচেয়ে ভালো সংবিধানও ভালো গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তা দিতে পারেন সুশিক্ষিত ও ন্যায়নীতিসম্পন্ন এবং ভালো স্বভাবচরিত্রসম্পন্ন রাজনীতিকেরাই।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments