মৃত্যুর আগে হিমাদ্রীর শেষ কথা... by প্রণব বল

‘আমাকে ওরা ডেকে নিয়ে গেল। রাস্তায় আমার মোবাইলটি ভেঙে ফেলল। তারপর ছাদে নিয়ে গেল। সেখানে কয়েকটি কুত্তা (কুকুর) লাগিয়ে দিল। হাতে মেরেছে আমাকে। সেখানে ডেনি ভাই, শাওন ভাই ছিল। আর ছিল টিপু আঙ্কেলের পোলা (জুনায়েদ আহমেদ ওরফে রিয়াদ)। তিনি আমাকে বলেন, তুই কার সাথে বেয়াদবি করছিস জানিস।


ওটা আমার বাবা। আমি বললাম, ভাইয়া আমি জীবনে কারও সঙ্গে বেয়াদবি করিনি।’
গত ২৭ এপ্রিল ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার পরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক্সরে বিভাগের শয্যায় শুয়ে হিমাদ্রী মজুমদার কারা কীভাবে তাঁকে নিয়ে যায়, কীভাবে কুকুর লেলিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয় তা বন্ধুদের বলে যান। হাসপাতালের এক্সরে বিভাগে দুই চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যদের সামনে দেওয়া হিমাদ্রীর দুই মিনিট ২৪ সেকেন্ডের ওই বক্তব্য বন্ধুরা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে রেখেছেন।
কথা বলার একপর্যায়ে তাঁকে বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি এসব সজ্ঞানে বলছ কি না? তখন হিমাদ্রী বলেন, ‘আমি সজ্ঞানে বলছি। আমি তাঁদের বাসাও চিনি, দেখিয়ে দিতে পারব।’
তাঁকে কোথা থেকে ধরে নিয়ে গেল বন্ধুদের এমন প্রশ্নের জবাবে হিমাদ্রী বলেন, ‘আমি রিজভি ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছিলাম। সেখান থেকে রাজা ভাইয়ের আব্বার মেজবানে যাওয়ার কথা ছিল। ওই সময় নামাজের আগে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এদিকে, হিমাদ্রী খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র একজন আসামি। ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত তিনটি কুকুর আদালতের আদেশে আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বন্ধুদের কাছে হিমাদ্রী যে জবানবন্দি দিয়ে গেছেন তা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে পুলিশ জব্দ করেছে।
হিমাদ্রীর এই জবানবন্দি মামলাটির গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। তাঁরা বলেন, ‘যেহেতু এই মামলার কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই, তাই মৃত্যুর আগে ভুক্তভোগীর ঘটনার আদ্যপান্ত বিবরণ মামলাটিতে কাজ দেবে। পাশাপাশি যাঁদের সামনে ভুক্তভোগী এসব বলে গেছেন তাঁদেরও সাক্ষী করা উচিত।’
এ প্রসঙ্গে মহানগর আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) কামাল উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘তাঁর মা-বাবা এবং বন্ধুদের সামনে যদি মৃত্যুর আগে এই ধরনের কথা বলে যায় তাহলে তা পুলিশ চাইলে জব্দ করতে পারে। তবে যাদের সামনে বলে গেছে তাদের সাক্ষ্য নেওয়া যায়। প্রয়োজনে ১৬১ অথবা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে যদি চিকিৎসক সাক্ষী হতে রাজি হয় তাহলে আরও ভালো। তাঁকে (চিকিৎসক) বলতে হবে তাঁর সামনে ভুক্তভোগী মা-বাবা ও বন্ধুবান্ধবদের এসব কথা বলে গেছেন।’
জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এই জবানবন্দিটি পুলিশের হাতে দিয়েছে হিমাদ্রীর বন্ধুরা। এটি এখন আলামত হিসেবে ব্যবহার করা হবে বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাজী জহির জানান।
তিনি বলেন, ‘হিমাদ্রীর রেকর্ডটি আমরা জব্দ করেছি। এটি মামলায় ব্যবহূত হবে। এর আগে তিনটি বিদেশি কুকুরও জব্দ করে চিড়িয়াখানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে একটি মারা গেছে।’
প্রসঙ্গত, গত ২৭ এপ্রিল নগরের সামারফিল্ড স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী হিমাদ্রী মজুমদারকে পাঁচলাইশের একটি চারতলা ভবনের ছাদ থেকে কুকুর লেলিয়ে ও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত হিমাদ্রীকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। এরপর গত ২৩ মে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে হিমাদ্রী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মারা যাওয়ার পর হিমাদ্রীর মামা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার প্রধান আসামি জুনায়েদ আহমেদ ওরফে রিয়াদ ঘটনার দুই দিনের মাথায় লন্ডন পালিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এর আগে ২৭ এপ্রিল হিমাদ্রীর বাবা প্রবীর মজুমদার একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। তখন পুলিশ তৎপর হলে তাঁর পালানো সম্ভব হতো না। এজাহারভুক্ত অপর আসামিরা হলেন, জুনায়েদের বাবা বারবিডার সাবেক সহসভাপতি শাহ সেলিম ওরফে টিপু, মাহবুবুর রহমান ওরফে ডেনি, শাহদাত হোসেন ওরফে সাজু ও শাওন। তাঁদের মধ্যে গতকাল শনিবার গ্রেপ্তার হয়েছেন হয়েছন শাহাদাত হোসেন।

No comments

Powered by Blogger.