পুলিশি নির্যাতনের প্রতিকার কী? by তানজিম আল ইসলাম

সম্প্রতি সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন এবং নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটলেও পুলিশের দ্বারা অযথাই সাধারণ মানুষের নির্যাতনের ঘটনা খুব বিরল নয়। এমনকি পুলিশের হেফাজতেও নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় তখন সত্যিই অসহায় হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।


কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পুলিশি নির্যাতনের কি কোনো প্রতিকার নেই? সাধারণ নাগরিকদের অনেকেই জানেন না, পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধেও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আইনে আছে। আইন অনুযায়ী, এসব পুলিশের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়ার পথ সুগম আছে, যদিও পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে বিচার চাইতে কিছু ঝামেলা এবং ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু এই ত্রুটির কারণে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পথ একবারে সংকীর্ণ হয়ে যায়নি। প্রচলিত ফৌজদারি আইন, পুলিশ আইন, মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশে দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়া যায়। পুলিশের সিটিজেন চার্টারেও (নাগরিক সনদ) কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, থানা থেকে আইনগত সহযোগিতা না পাওয়া গেলে বা কোনো পুলিশসদস্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করা যাবে। সে ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ (ক) লিখিত অভিযোগপ্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তা অভিযোগকারীকে অবহিত করবে; (খ) ব্যক্তিগতভাবে হাজির হওয়া ব্যক্তির বক্তব্য মনোযোগসহকারে শুনবে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং তা অভিযোগকারীকে জানাবে; (গ) টেলিফোনে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ফৌজদারি আইনে প্রতিকার: কোনো দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করতে হলে থানায় গিয়ে এজাহার দায়ের করতে আইনে বারণ নেই। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থানা কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এজাহার নিতে চায় না। সে ক্ষেত্রে মুখ্য বিচারিক বা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে নালিশি মামলা দায়েরের সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে আদালত জুডিশিয়াল ইনকোয়ারির (বিচারিক অনুসন্ধান) আদেশ দিতে পারেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধ আমলে নিতে পারেন। দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন ক্ষেত্রবিশেষে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। তবে ফৌজদারি আইনে একটু সীমাবদ্ধতা আছে। বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতির প্রয়োজন। কয়েকজন বিচারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কোনো দায়ী পুলিশসদস্যকে দেখতে হবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কি না; যদি দায়িত্বের বাইরে অযথাই সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে সাধারণ আইনেই অপরাধ আমলে নিতে পারেন বিচারক। ক্ষেত্রবিশেষে আদালত যদি থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে তদন্তের নির্দেশ দেন সে ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগতে পারে।
কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কাউকে নির্যাতন করলে দণ্ডবিধির ৩২১ থেকে ৩২৬ ধারা পর্যন্ত প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে। দণ্ডবিধির ৩২৪ ধারায় বলা আছে, কেউ ইচ্ছাপূর্বক বিপজ্জনক উপায়ে আঘাত করলে দায়ী ব্যক্তি তিন বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে কিংবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৩২৫ ধারা অনুযায়ী, যদি ইচ্ছাপূর্বক গুরুতর আঘাত করে তাহলে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান আছে। ৩২৬ ধারা অনুযায়ী, বিপজ্জনক অস্ত্র দ্বারা আঘাত করার দায়ে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান আছে।

পুুলিশ আইনে যা আছে: ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্ব-কর্তব্য বা রেগুলেশন স্বেচ্ছায় অমান্য করেন বা পালনে গাফিলতি করেন—পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে আসামির ওপর অন্যায়ভাবে নির্যাতন বা আঘাত করেন, তাহলে তাঁকে বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সোপর্দ করা যাবে এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে তিন মাসের বেতনের সমপরিমাণ জরিমানা কিংবা তিন মাস পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুযায়ী, পুলিশ কর্মকর্তার অসদাচরণের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে। এ অধ্যাদেশের ৪৮ ধারা অনুযায়ী, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি কাপুরুষতার দোষে দোষী হন কিংবা পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পালনীয় কোনো আইনের বিধান বা কোনো নিয়ম-কানুন বা আদেশ স্বেচ্ছায় লঙ্ঘনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান আছে। এ বিধান সব মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশেই আছে। এ আইনের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এর আওতায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করতে হলে তা সংশ্লিষ্ট অপরাধ সংঘটনের ছয় মাসের মধ্যে দায়ের করতে হবে এবং মামলা দায়েরের এক মাস আগে মামলার কারণ লিপিবদ্ধ করে একটি নোটিশ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মর্কতা ও তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট পাঠাতে হবে।

পুলিশ দ্বারা নারীর শ্লীলতাহানির শাস্তি: কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটলে নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী ২০০৩) অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করা যায়। এ আইনের ১০ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশে শরীরের কোনো অঙ্গ বা কোনা বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌনাঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করে বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করে, তাহলে তার এ কাজ যৌনপীড়ন হিসেবে গণ্য হবে এবং এ জন্য অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.