মৃদুল-গৌতমের কাছে খোলা চিঠিঃ বন্ধু নাকি শত্রু ভারত? by সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
প্রিয় মৃদুল, প্রিয় গৌতম,
বঙ্গদেশ থেকে তেরো হাজার মাইল দূরে বসবাস করেও কখনোই এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, তোরা অনেক দূরে! তোরা আমার প্রাণের বন্ধু। সব সময় প্রাণ দিয়ে, হৃদয় দিয়ে তোদেরকে বুকের ভেতর অনুভব করি। তোদের সাথে আমাদের কত যে সৌহার্দ্য, স্মৃতি, মাতামাতি আছে! দুই বাংলার ঢাকা-কলকাতা কিংবা দুই বাংলার সম্পর্ক নিয়ে আমার অনেক আবেগী কবিতা আছে।
বঙ্গদেশ থেকে তেরো হাজার মাইল দূরে বসবাস করেও কখনোই এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, তোরা অনেক দূরে! তোরা আমার প্রাণের বন্ধু। সব সময় প্রাণ দিয়ে, হৃদয় দিয়ে তোদেরকে বুকের ভেতর অনুভব করি। তোদের সাথে আমাদের কত যে সৌহার্দ্য, স্মৃতি, মাতামাতি আছে! দুই বাংলার ঢাকা-কলকাতা কিংবা দুই বাংলার সম্পর্ক নিয়ে আমার অনেক আবেগী কবিতা আছে।
সহোদর, যুক্তাক্ষর, সমান্তরাল রেললাইন, বাদাম, দুই নয়ন, জলপানি ইত্যাদি কতভাবে যে তোদেরকে উপমায় টেনেছি। একটি উদাহরণ দিই-
সমবেত পাখি নিজেদের মন মণদরে
বিনিময় করে হাত হলদিয়া বন্দরে
বেলুন ফুলের মতো উৎসব-মুখরিত
পাখিপ্রেম আর অমৃত রচনা চা, শীত ও
সহোদর হি.মু যুক্তাক্ষরে গ্রন্থিত
করে জলপানি পরস্পরকে মন দিত!
সেসব স্মৃতিপাঠ আর এক আগুনের,
এক আকাশের সুনীল, শামসু বা গুণের
মন বিভাগের পানি ও জলের বাঘ দেখা,
ভাগ-বিভাজন কে সে মুছে দিবে দাগরেখা?
শুধু আমিই নই; আমাদের লেখক, শিল্পীদের গল্প-গানে-কবিতায় এ ভালোবাসার শেষ নেই। মৃদুল, তুই তোর পিতৃভূমি বরিশালের এক মুঠো মাটি কী আবেগেই না নিয়ে যাস মাতৃভূমিতে শ্রীরামপুরে!
শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ হক, সুনীল গাঙ্গুলী, রফিক আজাদ, জয় গোস্বামী, শ্যামল কান্তি দাশ, হাসান হাফিজ এদের সম্পাদিত দুই বাংলার ভালোবাসার কবিতা, দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা, মাকে নিয়ে কবিতা, বিরহের কবিতায় মিলেমিশে বাংলা ভাষা আর বাঙালি দুই মলাটে বন্দী। ২০০৩-এর ডিসেম্বরে নন্দনের বাংলা আকাডেমীতে দুই বাংলার কবিদের জমজমাট অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। অতিথি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তিনজন সম্মানিত মন্ত্রী। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জনের জন্য বাংলাদেদশিদের শ্রদ্ধা জানালেন। সেদিন গর্বে বুক ফেটে যাচ্ছিল। আমিও মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজয়ের মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধে তোদের অবদানের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি।
তোদের সাথে আমাদের নানান সম্পর্ক। হাজার বছরের সম্পর্ক! আর গাঢ় বন্ধন, ৪০ বছরের! কারণ, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রক্তের সম্পর্কও রয়েছে। একাত্তরের দু’দেশের সৈন্যের রক্ত একই সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে’। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিত্র বাহিনীর ১৪/১৫ হাজার সৈন্যও আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যে জন্য বাংলাদেশ চিরঋণী!
তোরা, (তথা ভারতবাসী) দীর্ঘ নয়টি মাস আমাদের এক কোটি উদ্বাস্তু-শরণার্থীকে আদরে আগলে রেখেছিলি। আমরা কোনোদিন সেই ঋণ শোধ করতে পারবো না।
প্রিয় বন্ধু মৃ. গৌ
তোদের সেই ঐতিহাসিক ঋণ কী এখন আমাদের রক্ত দিয়ে শোধ করতে হবে? তোরাও কী বর্বর বাহিনীর(পাকিবাহিনী) ভূমিকায় ? পাখির মতো গুলি করে মারবি আমার ছোটবোন ফেলানীকে?
এক কিশোরী ফেলানী নয়, গত বছর তোদের ক্ষমতাধর সীমান্তবাহিনী ৭৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। আর এক দশকে ২০০৭-এ এক সাথে ১১জন বিডিআরকেও গুলি করে মেরেছে। হিসেবে প্রায় হত্যা হাজার খানেক। অর্থ্যাৎ ৯২২ জন!
মৃদুল তুই তো সাংবাদিক। নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিস্ গত ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের সীমান্তে আমাদের ফুলবাড়ির নিরীহ কিশোরী ফেলানীকে তোদের বিএসএফ গুলি করে চার/পাঁচ ঘন্টা কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছে। তারপর হাত পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে লাশ নিয়ে গেছে!
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর ফেলানীর হাতে মেহেদী মেখে, লাল শাড়ির ঘোমটা টেনে শ্বশুরবাড়ি যাবার কথা ছিলো। সেই ১৫ বছরের কিশোরীর রঙিন স্বপ্ন ছারখার করে দিলো মাত্র একটি গুলি! গুলির পরের দৃশ্য দুটিও কী সহনীয়, বন্ধু!
হে ভারতীয় বন্ধু আমার
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ২১৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার। কিন্তু আমরা মনে করি, আমাদের সম্পর্কের দৈর্ঘ্য-দূরত্ব অসীম। সেই অসীমের মাঝে কেন সীমারেখা: অশনি সঙ্কেত শুনতে পাই? কেন বেজে ওঠে বন্দুক!
বাংলাদেশ সরকার তীব্র কোনো প্রতিবাদ জানায়নি! তবে মিডিয়াগুলো সেই দুঃখজনক সংবাদ তুলে ধরেছে, আর আমাদের মতো কলমজীবীরা কষ্ট পেয়ে কলম ধরেছে।
১৫ আগস্ট ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রতিবাদে আমাদের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ভারত দীর্ঘ ১৬ বছর তাঁকে আশ্রয়-আদর দিয়েছিলো। ভারতের প্রতি তাঁর দুর্বলতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার শেষ নেই। তিনিও লিখেছেন- `ভারত মানবের দেশ, দানবের নয়। পৌরাণিক যুগে সুর-অসুরের, দেব-দানবের লড়াইয়ের অনেক উপাখ্যানে এমন চরম নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রে সদা সর্বদা অসুরের নয়, সুরের জয়জয়কার দেখা যায়। সে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রেই হোক, আর সীতা হরণে লঙ্কাপতি রাবণই হোক। কোথাও কোনো দানবের জয় হয়নি। সর্বত্রই মানবের আর মানবতার জয়জয়কার। কিন্তু হায়, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ইদানীং একি দেখি! ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দিনের পর দিন পাখি শিকারের মতো সীমান্তে নিরীহ মানুষকে গুলি করে মারছে। কোনো প্রতিকার নেই। কেন এই নিষ্ঠুরতা?` ( দ্র. দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জানুয়ারী ২০১১ ঢাকা।)
ফেলানী কী ফেলানীই হয়ে যাবে? নাহ। তাই এরই মধ্যে ৭ জানুয়ারি ‘ফালানি দিবস’ পালনের দাবি জানিয়েছেন কানাডা প্রবাসী শাহীন সিদ্দিকী।
হ্যাঁ, এই বৈমানবিক আচরণ এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতিবিরোধী হত্যাকাণ্ডের খবর তোদের কলকাতার দৈনিকগুলো তুলে ধরেছে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার নোট পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। তারপর ভারত ‘গভীর’ অনুশোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর (আরটিএনএন, ১৯ জানুয়ারি, ২০১১)। ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় সফরত ভারতীয় স্বরাষ্ট্রসচিব গোপাল কৃষ্ণ পিল্লাই, আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেন। এ সময়ের জন্য ধন্যবাদ। দু’দেশের নো-ম্যান্সল্যান্ডের পতাকা বৈঠকে তো বহুবার এ ধরনের ‘আশ্বাস’ পেয়েছি! কিন্তু বিএসএফের গুলিতো থেমে থাকেনি!
তোদের বিএসএফের প্রধান রমণ শ্রীবাস্তব ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে বলেছেন, অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশকারী বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বৈধ! এজন্য অনুতপ্ত হবার প্রয়োজন নেই !!
হে কবি বন্ধুদ্বয়,
আজ কবিতার কথা নয়, সাহিত্যের বিষয় নয়; আজ শুধু আমার ছোটবোন ফেলানীর জন্যেই এই বেদনা ভরা বক্তব্য, আক্ষেপ।
গত ১৫ জানুয়ারি ফেইসবুকে মৃদুল দাশগুপ্তের লেখা সেই কবিতা পড়ে থ মেরে গিয়েছিলাম। তা পাঠকদের সাথে শেয়ার করছিঃ
শোক গাঁথা: নেতাই গ্রাম, লালগড় / মৃদুল দাশগুপ্ত
বাতাসে বারুদ, তাও প্রজাপতি ওড়ে,
ফুলগাছ ভাবে, বধুটি আসে না ভোরে।
গীতালি আদক, পেটে দুটো গুলি
গতকাল গেছে মরে।
শূন্য সাজটি উঠানে রয়েছে পড়ে।
মৃদুলের সেই কবিতার গীতালির সাথে ফেলানীর মৃত্যুর মিল-অমিল দ্রবীভূত হয়ে যায়। যা হৃদয়কে স্পর্শ করবে, নাড়া দেবে মর্মমূলে।
গৌতম-মৃদুল বন্ধু আমার,
তোরা হয়তঃ জানিস্ গত ২০১০-এ ৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের এবং মেক্সিকোর সীমান্তে অনুরূপভাবে মার্কিনবাহিনী ‘বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট গুলিতে ১৫ বছরের মেক্সিকান কিশোর সোয়ারেস’কে হত্যা করেছিল! অবশ্য এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ধন্যবাদ সেই সংগঠনটিকে। কিন্তু প্রশ্ন, ভারত-মার্কিন রুই কাতলার কাছে পৃথিবীর পুঁটিমাছ তুল্য ফেলানী-সোয়ারেসরা কী এভাবেই পাখির মতো গুলি খেয়ে প্রাণ দেবে?
সমবেত পাখি নিজেদের মন মণদরে
বিনিময় করে হাত হলদিয়া বন্দরে
বেলুন ফুলের মতো উৎসব-মুখরিত
পাখিপ্রেম আর অমৃত রচনা চা, শীত ও
সহোদর হি.মু যুক্তাক্ষরে গ্রন্থিত
করে জলপানি পরস্পরকে মন দিত!
সেসব স্মৃতিপাঠ আর এক আগুনের,
এক আকাশের সুনীল, শামসু বা গুণের
মন বিভাগের পানি ও জলের বাঘ দেখা,
ভাগ-বিভাজন কে সে মুছে দিবে দাগরেখা?
শুধু আমিই নই; আমাদের লেখক, শিল্পীদের গল্প-গানে-কবিতায় এ ভালোবাসার শেষ নেই। মৃদুল, তুই তোর পিতৃভূমি বরিশালের এক মুঠো মাটি কী আবেগেই না নিয়ে যাস মাতৃভূমিতে শ্রীরামপুরে!
শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ হক, সুনীল গাঙ্গুলী, রফিক আজাদ, জয় গোস্বামী, শ্যামল কান্তি দাশ, হাসান হাফিজ এদের সম্পাদিত দুই বাংলার ভালোবাসার কবিতা, দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা, মাকে নিয়ে কবিতা, বিরহের কবিতায় মিলেমিশে বাংলা ভাষা আর বাঙালি দুই মলাটে বন্দী। ২০০৩-এর ডিসেম্বরে নন্দনের বাংলা আকাডেমীতে দুই বাংলার কবিদের জমজমাট অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। অতিথি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তিনজন সম্মানিত মন্ত্রী। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অর্জনের জন্য বাংলাদেদশিদের শ্রদ্ধা জানালেন। সেদিন গর্বে বুক ফেটে যাচ্ছিল। আমিও মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজয়ের মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধে তোদের অবদানের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি।
তোদের সাথে আমাদের নানান সম্পর্ক। হাজার বছরের সম্পর্ক! আর গাঢ় বন্ধন, ৪০ বছরের! কারণ, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রক্তের সম্পর্কও রয়েছে। একাত্তরের দু’দেশের সৈন্যের রক্ত একই সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে’। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিত্র বাহিনীর ১৪/১৫ হাজার সৈন্যও আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যে জন্য বাংলাদেশ চিরঋণী!
তোরা, (তথা ভারতবাসী) দীর্ঘ নয়টি মাস আমাদের এক কোটি উদ্বাস্তু-শরণার্থীকে আদরে আগলে রেখেছিলি। আমরা কোনোদিন সেই ঋণ শোধ করতে পারবো না।
প্রিয় বন্ধু মৃ. গৌ
তোদের সেই ঐতিহাসিক ঋণ কী এখন আমাদের রক্ত দিয়ে শোধ করতে হবে? তোরাও কী বর্বর বাহিনীর(পাকিবাহিনী) ভূমিকায় ? পাখির মতো গুলি করে মারবি আমার ছোটবোন ফেলানীকে?
এক কিশোরী ফেলানী নয়, গত বছর তোদের ক্ষমতাধর সীমান্তবাহিনী ৭৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। আর এক দশকে ২০০৭-এ এক সাথে ১১জন বিডিআরকেও গুলি করে মেরেছে। হিসেবে প্রায় হত্যা হাজার খানেক। অর্থ্যাৎ ৯২২ জন!
মৃদুল তুই তো সাংবাদিক। নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিস্ গত ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের সীমান্তে আমাদের ফুলবাড়ির নিরীহ কিশোরী ফেলানীকে তোদের বিএসএফ গুলি করে চার/পাঁচ ঘন্টা কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছে। তারপর হাত পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে লাশ নিয়ে গেছে!
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর ফেলানীর হাতে মেহেদী মেখে, লাল শাড়ির ঘোমটা টেনে শ্বশুরবাড়ি যাবার কথা ছিলো। সেই ১৫ বছরের কিশোরীর রঙিন স্বপ্ন ছারখার করে দিলো মাত্র একটি গুলি! গুলির পরের দৃশ্য দুটিও কী সহনীয়, বন্ধু!
হে ভারতীয় বন্ধু আমার
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ২১৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার। কিন্তু আমরা মনে করি, আমাদের সম্পর্কের দৈর্ঘ্য-দূরত্ব অসীম। সেই অসীমের মাঝে কেন সীমারেখা: অশনি সঙ্কেত শুনতে পাই? কেন বেজে ওঠে বন্দুক!
বাংলাদেশ সরকার তীব্র কোনো প্রতিবাদ জানায়নি! তবে মিডিয়াগুলো সেই দুঃখজনক সংবাদ তুলে ধরেছে, আর আমাদের মতো কলমজীবীরা কষ্ট পেয়ে কলম ধরেছে।
১৫ আগস্ট ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রতিবাদে আমাদের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ভারত দীর্ঘ ১৬ বছর তাঁকে আশ্রয়-আদর দিয়েছিলো। ভারতের প্রতি তাঁর দুর্বলতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার শেষ নেই। তিনিও লিখেছেন- `ভারত মানবের দেশ, দানবের নয়। পৌরাণিক যুগে সুর-অসুরের, দেব-দানবের লড়াইয়ের অনেক উপাখ্যানে এমন চরম নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রে সদা সর্বদা অসুরের নয়, সুরের জয়জয়কার দেখা যায়। সে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রেই হোক, আর সীতা হরণে লঙ্কাপতি রাবণই হোক। কোথাও কোনো দানবের জয় হয়নি। সর্বত্রই মানবের আর মানবতার জয়জয়কার। কিন্তু হায়, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ইদানীং একি দেখি! ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দিনের পর দিন পাখি শিকারের মতো সীমান্তে নিরীহ মানুষকে গুলি করে মারছে। কোনো প্রতিকার নেই। কেন এই নিষ্ঠুরতা?` ( দ্র. দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জানুয়ারী ২০১১ ঢাকা।)
ফেলানী কী ফেলানীই হয়ে যাবে? নাহ। তাই এরই মধ্যে ৭ জানুয়ারি ‘ফালানি দিবস’ পালনের দাবি জানিয়েছেন কানাডা প্রবাসী শাহীন সিদ্দিকী।
হ্যাঁ, এই বৈমানবিক আচরণ এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতিবিরোধী হত্যাকাণ্ডের খবর তোদের কলকাতার দৈনিকগুলো তুলে ধরেছে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার নোট পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। তারপর ভারত ‘গভীর’ অনুশোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর (আরটিএনএন, ১৯ জানুয়ারি, ২০১১)। ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় সফরত ভারতীয় স্বরাষ্ট্রসচিব গোপাল কৃষ্ণ পিল্লাই, আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেন। এ সময়ের জন্য ধন্যবাদ। দু’দেশের নো-ম্যান্সল্যান্ডের পতাকা বৈঠকে তো বহুবার এ ধরনের ‘আশ্বাস’ পেয়েছি! কিন্তু বিএসএফের গুলিতো থেমে থাকেনি!
তোদের বিএসএফের প্রধান রমণ শ্রীবাস্তব ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে বলেছেন, অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশকারী বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বৈধ! এজন্য অনুতপ্ত হবার প্রয়োজন নেই !!
হে কবি বন্ধুদ্বয়,
আজ কবিতার কথা নয়, সাহিত্যের বিষয় নয়; আজ শুধু আমার ছোটবোন ফেলানীর জন্যেই এই বেদনা ভরা বক্তব্য, আক্ষেপ।
গত ১৫ জানুয়ারি ফেইসবুকে মৃদুল দাশগুপ্তের লেখা সেই কবিতা পড়ে থ মেরে গিয়েছিলাম। তা পাঠকদের সাথে শেয়ার করছিঃ
শোক গাঁথা: নেতাই গ্রাম, লালগড় / মৃদুল দাশগুপ্ত
বাতাসে বারুদ, তাও প্রজাপতি ওড়ে,
ফুলগাছ ভাবে, বধুটি আসে না ভোরে।
গীতালি আদক, পেটে দুটো গুলি
গতকাল গেছে মরে।
শূন্য সাজটি উঠানে রয়েছে পড়ে।
মৃদুলের সেই কবিতার গীতালির সাথে ফেলানীর মৃত্যুর মিল-অমিল দ্রবীভূত হয়ে যায়। যা হৃদয়কে স্পর্শ করবে, নাড়া দেবে মর্মমূলে।
গৌতম-মৃদুল বন্ধু আমার,
তোরা হয়তঃ জানিস্ গত ২০১০-এ ৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের এবং মেক্সিকোর সীমান্তে অনুরূপভাবে মার্কিনবাহিনী ‘বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট গুলিতে ১৫ বছরের মেক্সিকান কিশোর সোয়ারেস’কে হত্যা করেছিল! অবশ্য এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ধন্যবাদ সেই সংগঠনটিকে। কিন্তু প্রশ্ন, ভারত-মার্কিন রুই কাতলার কাছে পৃথিবীর পুঁটিমাছ তুল্য ফেলানী-সোয়ারেসরা কী এভাবেই পাখির মতো গুলি খেয়ে প্রাণ দেবে?
No comments