পাট রফতানি-নতুন বাজার খুঁজতে হবে

পাটের বাজারে মন্দার খবরটি নতুন নয়। ফসল তোলার মৌসুমে উৎপাদিত পাট নিয়ে বাজারে গিয়ে প্রত্যাশিত দাম না পাওয়া কৃষকের আহাজারির কথা ইতিপূর্বে বিভিন্নভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তখন অবশ্য কৃষকের সমস্যার সমাধান হয়নি। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষকরা আবারও পাটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন বলেই আলামত পাওয়া যাচ্ছে। কৃষকের পর এবার সংকটে পড়েছেন পাট ব্যবসায়ীরাও। রফতানির উদ্দেশ্যে পাট কিনে গুদামজাত করলেও


ক্রেতাদের প্রত্যাশিত সাড়া মিলছে না। ৩০ লাখ বেল পাট নিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা নন, সরকারি উদ্যোগে কেনা পাটও রফতানির অপেক্ষায় গুদামে পড়ে আছে। এ বছর উৎপাদিত পাটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত বছরের বাড়তি পাট। কিন্তু বাজারের যে গতি তাতে সহসা রফতানির শিকে ছিঁড়বে বলে মনে হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিপুল ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাট নিয়ে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা মহলে বিশেষ আশার সঞ্চার হয়েছিল। আশাবাদের পেছনে যথার্থ কারণও ছিল। পাট নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বাংলাদেশ যেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছিল তেমনি বিশ্ববাজারে সিন্থেটিক পণ্যের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের সমাদর বাড়ছিল। এ বাস্তবতায় অনেকেই মনে করছিলেন, পাটের হৃতগৌরব আবারও ফিরে আসতে পারে। কিন্তু দু'বছর মোটামুটি ব্যবসার পর এবার হতাশার খবরই মিলছে। এর পেছনে বৈশ্বিক মন্দা বড় কারণ বটে, কিন্তু আমাদের ব্যবসায়িক নীতি ও কৌশলও পাটের দুর্দশার জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের পাটের মূল আমদানিকারক ছিল ভারত। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে পাট কেনার আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশ তখন সাড়া দেয়নি। ২০১০ সালে ১২টি দেশ বাংলাদেশকে পাট রফতানির প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের দিক থেকে সাড়া না পেয়ে ক্রেতারা ভারতের দিকেই ঝুঁকেছে। ভারতও পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি অর্জন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পাট কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে, মুখ্যত ভারতে রফতানিনির্ভর পাট ব্যবসায় ধস নামার উপক্রম হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক কৌশল হিসেবে একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির খেসারত বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের এখন মূল করণীয় হলো, নতুন বাজার অনুসন্ধান। অতীতে যেসব দেশ আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছিল তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে রফতানির সুযোগ নেওয়া যেতে পারে। ইউরোপীয় দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা চলছে, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সংকট। পাটের সবচেয়ে বড় বাজার থাইল্যান্ডকে পিছিয়ে দিয়েছে বন্যা। এ অবস্থায় ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাজার প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাজার খোঁজার তৎপরতা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে চালাতে হবে। আর সে অনুসন্ধানের লক্ষ্য হওয়া উচিত সুদূরপ্রসারী বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এ বছরের সংকট থেকে উত্তরণ শুধু নয়, দেশে কৃষক থেকে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তা পর্যন্ত একটি লাভজনক ও স্থায়ী পাট অর্থনীতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বাড়াতে হবে। ভারত উৎপাদিত পাটপণ্যের ১৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহার করে। পরিবেশবান্ধব পাটপণ্য ব্যবহারকে তারা বাধ্যতামূলক করতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের দেশে পাটপণ্য ব্যবহার প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যকর হয়নি। এ জন্য সচেতনতামূলক নতুন উদ্যোগ দরকার। দেশের ভেতরে-বাইরে পাটের নতুন বাজার সৃষ্টির মধ্যদিয়েই পাট সংশ্লিষ্ট কৃষি, ব্যবসা ও শিল্প খাতে গতি আসতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.