স্লিপগল্প-বেনুবালার ভাই by আরিফ জেবতিক
নাসিরনগর রেলস্টেশনে প্রতিদিন ভোর ৩টার দিকে এসে ঢাকা মেইল মাত্র দুই মিনিটের জন্য থামে। তারপর হুস করে বেরিয়ে চলে যায় পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। প্রতিদিন ভোর ৩টায় ট্রেনটি এসে পেঁঁৗছলেই বেনুবালার ঘুম ভেঙে যায়। সে সন্তর্পণে কান পেতে থাকে পরের একটি ঘণ্টা। স্টেশন থেকে তার বাড়ি আধা কিলোমিটারেরও কম হবে, কিন্তু ট্রেনের শব্দ শোনা গেলেও এর পর কোনো পায়ের শব্দ বেনুবালাদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসে না। এমনিতে ট্রেনের শব্দে স্টেশনের
আশপাশের গ্রামের কারো ঘুম ভাঙে না, জন্মের পর থেকেই তারা ট্রেনের শব্দের সঙ্গেই বড় হয়ে ওঠে, শব্দ তাই সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু বেনুবালার ঘুম ভেঙে যায় প্রতিরাতে এক বছর ধরে। বেনুবালার ভাই বাতেন সৌদি আরবে গিয়েছিল চার বছর আগে। এক বছর ধরে একটা ফোন নেই, চিঠি নেই, কোনো যোগাযোগ নেই। বেনুবালা শুনেছে তার ভাই বাতেনকে নাকি সেখানে পুলিশ ধরেছে, বিচারে ফাঁসির হুকুম হয়েছে। ফাঁসি তো নয়, খচ করে মাথাটা কেটে ফেলবে কোনো একদিন।
বেনুবালার বাবা বাড়িতে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন দুই বছর ধরে। তড়কা রোগে ধরেছিল তাঁকে। বুড়ি মা আর নাইনে পড়ুয়া বেনুবালাদের দিন খুব ভালো যাচ্ছে না এর পর থেকে। কয়েক কানি জমি অবশ্য আছে, বাপ নিজেই চাষবাস করতেন; আর বাতেনের পাঠানো টাকায় সংসার ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু বাতেন গ্রেপ্তার আর বাপটা পঙ্গু হওয়ার পরে জমিটুকু বর্গা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বেনুবালা আর তার মায়ের। বেনুবালা তাই প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকে। ভাই ফিরে এলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ভাইকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে কম ছোটাছুটি করেনি ওরা। ঢাকায় যেতে পারলে হয়তো কাজটা হয়েই যেত, কিন্তু ঢাকায় কার কাছে যাবে_সেটা বেনুবালা আর তার মা জানে না। এমপি সাহেবের কাছে যেতে পেরেছিল একবার, ইউএনও অফিসেও কয়েকবার গেছে তারা, মখলিছ মেম্বার লোক খারাপ না, সে-ই বেনুবালা আর তার মাকে নিয়ে হত্যে দিয়েছে সব জায়গায়। সবাই আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পত্রিকার এক সাংবাদিকের কাছেও গিয়েছিল একবার, সেই লোক খেঁকিয়ে উঠেছে_তোর ভাই ওই খানে আকাম করবে আর কল্লা কাটা যাবে না? কী আকাম করেছে সেটাই তো বেনুবালা জানে না।
আজ ট্রেনটা চলে যাওয়ার অনেক পরও যখন পদশব্দ পাওয়া যায় না তখন সে বোঝে, তার ভাই আজকেও ফেরবে না। দিনে দিনে তার আশায় মরিচা ধরছে, বুকের গভীরে সে কোথাও জেনে গেছে, ভাই আর তার কোনো দিনই ফেরবে না।
মাঝরাতে পাশের ঘরে হঠাৎ করে ফোঁপানোর কান্না শুনতে পায় সে। মায়ের কান্না নিশ্চয়ই। মা-ও কি তার মতোই প্রতিরাতে জেগে ওঠে, বাতেনের অপেক্ষায় থাকে? কই, কোনো দিনই তো টের পায়নি সে।
কথা বলে সে, 'কে কান্দে? মা কি জাগনা?'
ওপাশ থেকে ফোঁপানোর শব্দ আরেকটু বাড়ে শুধু, কোনো কথা শোনা যায় না।
বেনুবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 'ঘুমাও মাইয়ো। তুমি কোনো নেতাফ্যাতা না, তুমার পুলারে ছুডাইয়া আনব কেডা। হইতা যুদি গো মা একটা বড় ন্যাতা, তাইলে তুমার পুলারে বৈদেশ থাইকা পালকি দিয়া ফিরাইয়া আনতা পারতা।'
বেনুবালা স্কুলে যায়, সে দুনিয়ার খবর কোনো না কোনোভাবে পায়। সে জানে তার ভাই আর নেত্রীদের ছেলেরা এক নয়। নেত্রীদের ছেলেরা চুরিচামারি করেও বিদেশ যায়, দেশে থাকে। বিচার হলে প্রেসিডেন্টও মাপ করে দেয়। কিন্তু বেনুবালার ভাই বাতেনের ক্ষেত্রে এসব কিছুই ঘটবে না। দেশে হোক, কি বিদেশে হোক_বাতেনের জন্য কেউই নেই।
বেনুবালার মা এসব রাজনীতির কথা জানেন না। তিনি শুধু সেই গভীর রাতে আরো জোরো ফোঁপান, তাঁর কান্নার শব্দ সেই নিঃশব্দ রাতের ট্রেনের মতোই কেন যেন অনেক দূরের মনে হয়।
বেনুবালার বাবা বাড়িতে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন দুই বছর ধরে। তড়কা রোগে ধরেছিল তাঁকে। বুড়ি মা আর নাইনে পড়ুয়া বেনুবালাদের দিন খুব ভালো যাচ্ছে না এর পর থেকে। কয়েক কানি জমি অবশ্য আছে, বাপ নিজেই চাষবাস করতেন; আর বাতেনের পাঠানো টাকায় সংসার ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু বাতেন গ্রেপ্তার আর বাপটা পঙ্গু হওয়ার পরে জমিটুকু বর্গা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বেনুবালা আর তার মায়ের। বেনুবালা তাই প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকে। ভাই ফিরে এলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ভাইকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে কম ছোটাছুটি করেনি ওরা। ঢাকায় যেতে পারলে হয়তো কাজটা হয়েই যেত, কিন্তু ঢাকায় কার কাছে যাবে_সেটা বেনুবালা আর তার মা জানে না। এমপি সাহেবের কাছে যেতে পেরেছিল একবার, ইউএনও অফিসেও কয়েকবার গেছে তারা, মখলিছ মেম্বার লোক খারাপ না, সে-ই বেনুবালা আর তার মাকে নিয়ে হত্যে দিয়েছে সব জায়গায়। সবাই আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পত্রিকার এক সাংবাদিকের কাছেও গিয়েছিল একবার, সেই লোক খেঁকিয়ে উঠেছে_তোর ভাই ওই খানে আকাম করবে আর কল্লা কাটা যাবে না? কী আকাম করেছে সেটাই তো বেনুবালা জানে না।
আজ ট্রেনটা চলে যাওয়ার অনেক পরও যখন পদশব্দ পাওয়া যায় না তখন সে বোঝে, তার ভাই আজকেও ফেরবে না। দিনে দিনে তার আশায় মরিচা ধরছে, বুকের গভীরে সে কোথাও জেনে গেছে, ভাই আর তার কোনো দিনই ফেরবে না।
মাঝরাতে পাশের ঘরে হঠাৎ করে ফোঁপানোর কান্না শুনতে পায় সে। মায়ের কান্না নিশ্চয়ই। মা-ও কি তার মতোই প্রতিরাতে জেগে ওঠে, বাতেনের অপেক্ষায় থাকে? কই, কোনো দিনই তো টের পায়নি সে।
কথা বলে সে, 'কে কান্দে? মা কি জাগনা?'
ওপাশ থেকে ফোঁপানোর শব্দ আরেকটু বাড়ে শুধু, কোনো কথা শোনা যায় না।
বেনুবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 'ঘুমাও মাইয়ো। তুমি কোনো নেতাফ্যাতা না, তুমার পুলারে ছুডাইয়া আনব কেডা। হইতা যুদি গো মা একটা বড় ন্যাতা, তাইলে তুমার পুলারে বৈদেশ থাইকা পালকি দিয়া ফিরাইয়া আনতা পারতা।'
বেনুবালা স্কুলে যায়, সে দুনিয়ার খবর কোনো না কোনোভাবে পায়। সে জানে তার ভাই আর নেত্রীদের ছেলেরা এক নয়। নেত্রীদের ছেলেরা চুরিচামারি করেও বিদেশ যায়, দেশে থাকে। বিচার হলে প্রেসিডেন্টও মাপ করে দেয়। কিন্তু বেনুবালার ভাই বাতেনের ক্ষেত্রে এসব কিছুই ঘটবে না। দেশে হোক, কি বিদেশে হোক_বাতেনের জন্য কেউই নেই।
বেনুবালার মা এসব রাজনীতির কথা জানেন না। তিনি শুধু সেই গভীর রাতে আরো জোরো ফোঁপান, তাঁর কান্নার শব্দ সেই নিঃশব্দ রাতের ট্রেনের মতোই কেন যেন অনেক দূরের মনে হয়।
No comments