দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

মূল্যসূচক ও লেনদেনের ঊর্ধ্বগতি দিয়েই নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহটি পার করল দেশের শেয়ারবাজার। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল গতি ফিরে পেতে শুরু করেছে। তবে বাজারের ঊর্ধ্বগতি যেন আবারও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কারণ না হয় সে জন্য এখন থেকেই সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার স্বাভাবিক হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে কিছু কিছু


শেয়ারের দাম অযৌক্তিক হারে বাড়ানো হচ্ছে। দাম বাড়তে দেখে ওই সব শেয়ারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ছেন। বাজারের বড় একটি কেলেঙ্কারি ও তাতে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আবারও বিনিয়োগকারীদের গুজবনির্ভর ও হুজুগে বিনিয়োগে বিরত থাকা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা। এর বদলে এখন বিনিয়োগকারীদের উচিত মৌলভিত্তি পর্যালোচনা সাপেক্ষে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পথ বেছে নেওয়া। তা না হলে শেষ পর্যন্ত লোকসানের দায়টি বিনিয়োগকারীদেরই নিতে হবে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত সপ্তাহজুড়ে দরবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল ছোট বা স্বল্প মূলধনের কোম্পানিগুলো। তার বিপরীতে লেনদেনের দিক থেকে এগিয়ে ছিল মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো।
যোগাযোগ করা হলে পুঁজিবাজার-বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান অবস্থায় বাজার স্বাভাবিক আচরণ করছে। তবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কথা বিবেচনায় রেখে এই বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের খুব বেশি কিছু আশা করা ঠিক হবে না। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে দুর্বল ও কম মূলধনের কোম্পানি বা মূলধনী আয়ের পেছনে না ছুটে প্রকৃত অর্থেই বিনিয়োগকারীর মতো আচরণ করা।
জানতে চাইলে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলের শিক্ষক ও পুঁজিবাজার-বিশ্লেষক মোহাম্মদ মূসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বমুখী বাজারে আমরা স্বল্প বা ছোট মূলধনের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম অযৌক্তিক হারে বাড়তে দেখছি। এরই মধ্যে এসব কোম্পানির শেয়ারের বেশ কয়েকটির দাম ৩০-৩৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এটি খুবই উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে এখন থেকেই বিনিয়োগকারী ও বাজারনিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নজর দিতে হবে। তা না হলে কিছু কোম্পানির অযৌক্তিক দরবৃদ্ধি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য আবারও ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
মূসা আরও বলেন, বাজারের ঊর্ধ্বগতির সুযোগে গুজব ছড়িয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট মূলধনের কোম্পানিগুলোর দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। অথচ এখনো বাজারে ভালো মৌলভিত্তির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম অনেক নিচে রয়েছে। যৌক্তিকভাবেই এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সেটি না হয়ে ঘটছে উল্টোটি।
গত সপ্তাহে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় ছিল যথাক্রমে: কে অ্যান্ড কিউ, ফার্স্ট বিএসআরএস, ডেল্টা-ব্র্যাক হাউজিং, রংপুর ডেইরি, ফনিক্স ফিন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং, বেক্মিমকো সিনথেটিকস, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, আইসিবি ও ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স। এর মধ্যে আইসিবি, ডেল্টা-ব্র্যাক হাউজিং, ফিনিক্স ফিন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং ও বেক্মিমকো সিনথেটিকস ছাড়া বাকি সবগুলোরই পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকার কম। দরবৃদ্ধির শীর্ষে থাকা কে অ্যান্ড কিউ কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র চার কোটি ৯০ লাখ টাকা। অথচ এক সপ্তাহের ব্যবধানে কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম ৩৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে আবু আহমেদ বলেন, বাজার যখন একটু স্বাভাবিক আচরণ করে, তখন একশ্রেণীর বিনিয়োগকারী মনে করেন ছোট কোম্পানির শেয়ার থেকে মূলধনী আয় বেশি আসবে। তাই তাঁরা ওই সব কোম্পানির প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। এটি শুধু আমাদের বাজার নয়, বিশ্বের অনেক শেয়ারবাজারে ঘটে থাকে। তবে বিনিয়োগকারীদের মনে রাখতে হবে ছোট মূলধনের কোম্পানিগুলোর দাম যেমন দ্রুত বাড়ে, ঠিক তেমনি দ্রুত কমেও।
বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিতে গিয়ে মোহাম্মদ বলেন, কিছুদিনের মধ্যেই অনেক কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা করা হবে। এটিকে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার উপায় হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন। দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে যাঁরা এখনো লোকসানে রয়েছেন, তাঁদের উচিত হবে দেখেশুনে পোর্টফোলিও বা পত্রকোষকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করা।
সাপ্তাহিক বাজার
নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ শেষে ঢাকার বাজারের দৈনিক গড় লেনদেন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৯২ কোটি টাকায়। আগের সপ্তাহে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬৮ কোটি টাকা। ওই হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে ২২৪ কোটি টাকা বা ৪৮ শতাংশ।
একইভাবে সপ্তাহশেষে মোট লেনদেন ছাড়িয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহে যার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকার বাজারে লেনদেন বেড়েছে প্রায় এক হাজার ৫৯০ কোটি টাকা বা ৮৫ শতাংশ।
ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক আগের সপ্তাহের চেয়ে প্রায় ৪ শতাংশ বা ২০৯ পয়েন্ট বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৬৭ পয়েন্ট। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে ২৭২ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ২২২টির, কমেছে ৪৫টির আর অপরিবর্তিত ছিল দুটির দাম।
মূল্যসূচক ও লেনদেন বাড়লেও অপরিবর্তিত ছিল শেয়ারের মূল্য আয়ের অনুপাত বা পিই রেশিও। সপ্তাহশেষে ডিএসইর পিই রেশিওর গড় ভারিত্ব দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৬৮-এ।

No comments

Powered by Blogger.