বেড়া ও সাঁথিয়ায় এক বছরে ২৮ জন খুন-অনেক পরিবার হারিয়েছে একমাত্র উপার্জনক্ষমকে

বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে ছিল মোয়াজ্জেম হোসেনের (৩৪) সংসার। বেড়া পৌর এলাকার বনগ্রাম মহল্লার এ ট্রাকচালক ছিলেন হতদরিদ্র পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। গত বছর ১০ নভেম্বর সন্ত্রাসীদের হাতে তিনি নিহত হওয়ার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের দিন কাটছে খেয়ে না-খেয়ে। মোয়াজ্জেমের বাবা আবদুল আজিজ (৬৫) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার দুই নাতি স্কুলে পড়ে। এখন ওগরে লেখাপড়া কী করাব, খাওয়াই তো ঠিকমতো দিব্যার পারি ন্যা!


কয়েকজন সন্ত্রাসীর জন্য আমার সোনার সংসারডা ছারখার হয়া গেল।’ ২০১১ সালে পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় এমন অনেক সংসার ছারখার হয়েছে হত্যাকাণ্ডের কারণে। সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের হাতে এ বছরে বেড়ায় নয়জন ও সাঁথিয়ায় ১৯ জন খুন হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্কুলছাত্র, গৃহবধূ ও শিক্ষক। যেসব পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি খুন হয়েছে, সেসব পরিবারের এখন পথে বসার অবস্থা।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বেড়ার নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে ডাকাতের হাতে নিজ বাড়িতে খুন হন আবদুল বাতেন (৫০)। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চরকান্দি গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত আজিমউদ্দিন (৩৫) গত ১ মার্চ মারা যান। গত ৬ মার্চ মেয়ের জামাই ও তাঁর লোকজনের হাতে নিহত হন জাতসাকিনী গ্রামের আলম মোল্লা (৫৫)। গত ১৫ মার্চ বেড়া পৌর এলাকার শম্ভুপুর মহল্লায় জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে খুন হন আশরাফুল আলম (৩৫)। গত ৩০ এপ্রিল পায়না মহল্লায় খুন হয় বেড়া উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র মিজানুর রহমান। গত ৩ মে শ্যামপুরচর থেকে আলোচিত তিন পুলিশ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ও চরমপন্থী নেতা চালাক রফিকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ৩১ মে রাতে ইউপি নির্বাচনের ফল প্রকাশ নিয়ে হাটুরিয়ায় পুলিশ ও একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে ওসমান গণি ওরফে গামা (৩৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। গত ১০ জুন চর নতিবপুর গ্রাম থেকে অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবতীর (২৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১০ নভেম্বর স্থানীয় সন্ত্রাসীরা বনগ্রাম মহল্লায় হত্যা করে ট্রাকচালক মোয়াজ্জেম হোসেনকে।
সাঁথিয়া উপজেলায় প্রথম হত্যাকাণ্ড ঘটে গত ২৯ জানুয়ারি মধ্যরাতে। ডাকাতেরা ইলা রানী সরকার (৪৫) নামের এক গৃহবধূকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি আফড়া গ্রামের আল মামুন (১৮) বেড়ার হাটুরিয়া গ্রামে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভায়নাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আরিফা খাতুন (২৮) নিজ বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে এবং গত ৩১ মার্চ রসুলপুর গ্রামে স্বামীর হাতে রেখা খাতুন (৩০) খুন হন।
নিজ বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে আরিফা খাতুন ও যুবদলের নেতা শফিকুলের হত্যাকাণ্ড ছিল ২০১১ সালে সাঁথিয়া উপজেলায় সবচেয়ে আলোচিত। আরিফা খাতুনের হত্যাকারীর গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে সে সময় এলাকাবাসী এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছিলেন।
সাঁথিয়ার ভিটাপাড়া গ্রামে হত্যাকাণ্ডের শিকার আইয়ুব নবীর স্ত্রী সুলাতানা বেগম জানান, তাঁর দুই মেয়ে এক ছেলে। স্বামীই ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুর পর সংসারের আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় খুব কষ্টে দিন কাটছে তাঁদের। সুলতানা বলেন, ‘আমাগরে যারা এত বড় ক্ষতি করল, তাগরে কি কুনু বিচ্যার হবি ন্যা?’
বেড়া-সাঁথিয়া-আতাইকুলা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আবু নাসের খান বলেন, খুনের ঘটনাগুলো নিতান্তই বিচ্ছিন্ন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের পুরো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে পুলিশ তৎপর। আর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ যথেষ্ট আন্তরিক। ইতিমধ্যেই বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.