নির্বাসিত জীবন

দুই মেধাবী মুখ। দুজন বন্ধু। বয়স সমান—৩০। প্রতিবাদী চরিত্রেও আবদুল্লাহ আল রাকিব, এনামুল হোসেন রাজীব একই রকম। দাবা ফেডারেশনে সরকারের চাপিয়ে দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে ‘নির্বাসনে’ আছেন প্রায় আড়াই বছর ধরে। খেলাবিহীন জীবন নিয়ে দুই গ্র্যান্ডমাস্টারকে একসঙ্গে বসিয়ে কথা বলেছেন মাসুদ আলম
আবদুল্লাহ আল রাকিব বইপত্র পড়েন অনেক। শিল্প, সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই। এনামুল হোসেন রাজীবও


অনেকটা সে রকম। সেবা প্রকাশনীর বই থেকে শুরু করে রাশান বইও পড়তেন ছোটবেলায়। পরিবারে বই পড়ার সংস্কৃতিতেই বেড়ে ওঠা। ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। এক পা এগিয়ে দাবা বিশ্বকাপে গিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলেছেন রাজীব। বিশ্বকাপে তাঁর দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা ছিল বাংলাদেশের দাবায় আলোড়ন ফেলার মতো ঘটনা। সেই রাজীব এখন নিজেকে আড়ালে ঢেকে ফেলেছেন। রাকিবও তা-ই।
দাবা ফেডারেশনের সরকার মনোনীত বিতর্কিত কমিটি পছন্দ হয়নি—এরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নিজেদের সব ইচ্ছা মাটিচাপা দিয়েছেন দুই তরুণ। প্রায় আড়াই বছর ধরেই তাঁরা খেলার বাইরে!
রাকিব আর রাজীব তাহলে হারিয়ে যাচ্ছেন? প্রতিযোগিতার মঞ্চে কবে আবার দুজনকে দেখা যাবে? রাজীব তবু সম্প্রতি বিচ্ছিন্নভাবে ভারতে দুটি টুর্নামেন্টে খেলেছেন, যদিও সেটি তাঁর ভাষায় ‘না খেলার মতোই’। রাকিব তা-ও নয়। দাবা থেকে রাজীবের চেয়েও বেশি বিচ্ছিন্ন রাকিব।
এটা দেশের দাবার জন্য বড় ক্ষতি। দুই গ্র্যান্ডমাস্টার কী ভাবছেন? প্রথম আলোর কার্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে এসে দুজনই অভিন্ন সুরে বললেন, ‘আর দাবা খেলবই না, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’ তবে ফেরার প্রতিশ্রুতিও দিতে পারছেন না। ‘ফেরার পরিবেশই’ যে নেই!
রাকিব বলছিলেন, ‘খেলা নিয়ে ভাবনা অনেক কমে এসেছে। এখন পুরো সময়টা বই পড়েই কাটাই। আগেও এই অভ্যাসটা ছিল। দর্শন, ইতিহাস, বক্তৃতা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তুলনামূলক সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য...। সক্রেটিস থেকেও ধরলে অনেক ইতিহাস। এগুলো না পড়লে জানব কীভাবে? খেলাবিহীন জীবনে তাই বই পড়ার মাত্রাটা বেড়েছে।’
রাজীবের কথা, ‘পড়াশোনার জন্য আমিও অনেক সময় পাই। আমরা দাবা খেলছি না নৈতিক কারণে। ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। রাকিবও হচ্ছে। নিজের ক্ষতি মেনে বড় কিছু করার উদ্যোগ এ দেশে বিরল। ভালো না লাগলে এই কমিটির অধীনে কেন খেলব, বলুন?’
যৌক্তিক কথা এবং না খেলার অধিকার তাঁদের আছে। তবে একটা প্রশ্ন, দুজন ফিরলে আগের মতো খেলতে পারবেন? রাজীবের উত্তর, ‘বড় বিরতি পড়েছে। আগের মতো খেলতে চাইলে দ্বিগুণ শ্রম দিতে হবে।’ পরক্ষণেই প্রশ্ন, “কিন্তু ফিরব কিসের হাতছানিতে?” দাবার বর্তমান ছবিটা বদলালে হয়তো খেলব। তবে খেললেও আমার কাছে আর বেশি কিছু আশা করা ঠিক হবে না।’
সম্প্রতি অবশ্য সিলেট প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবা অলিম্পিয়াডে আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তারের সঙ্গী হয়েছিলেন রাজীব। ‘না খেললেও দাবা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নই। সিলেটে দাবা অলিম্পিয়াডে যাওয়া তারই প্রমাণ’—বললেন গেন্ডারিয়ায় বড় হওয়া পিরোজপুরের ছেলে।
আর রাকিব? ‘আড়াই বছর খেলছি না। ফেরার জন্য ইতিবাচক কিছু নেই-ও। যে লোকগুলোর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আমরা সরে দাঁড়িয়েছি, তাঁরা এখনো আছেন। ছোটবেলা থেকে দাবা নিয়ে একটা পথ তৈরি করেছি, তাতে হঠাৎ বড় বিরতি। ভবিষ্যতে কী হবে, এখনই উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া কঠিন’—নারায়ণগঞ্জের তরুণও অনেকটা অদৃষ্টবাদী।
না খেলার কষ্ট দুজনকেই পোড়ায়। একজন কবি কবিতা না লিখলে, একজন চিত্রকর ছবি না আঁকলে তাঁর কেমন লাগবে? দুই গ্র্যান্ডমাস্টারেরও সে রকমই লাগছে। রাকিব বলছিলেন, ‘খেলার প্রবল ইচ্ছা জাগে। কিন্তু খেলব না। নিজের অবস্থানে অনড়ই থাকতে চাই। একজন লেখক যেমন নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন, আমিও অনেকটা সে রকম জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। সেটা বইয়ের জগৎ।’
রাজীবের কথা, ‘খেলার নেশা ছোটবেলা থেকেই। ফল নিয়ে কখনোই ভাবতাম না। ছোট টুর্নামেন্ট হলেও খেলেছি। রাকিব যেটা বলল, “আমি আর খেলব না”, এটা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। আমরা জেনেবুঝেই কমিটির প্রতি অনাস্থা জানিয়েছি। তাই খারাপ লাগলেও সেভাবে কষ্ট পাই না। কেউ চাপিয়ে দিলে হয়তো কষ্ট পেতাম।’
খেলাটা নিশ্চয়ই মিস করেন? দুজনই একসঙ্গেই বললেন, ‘তা তো করিই।’ পরক্ষণেই রাজীব যোগ করলেন, ‘দেশে খেলছি না। তবে সম্প্রতি ভারতে হালকা মেজাজে দুটি টুর্নামেন্ট খেলে মনে হয়েছে, সবকিছুই যেন নতুন। প্রথম ম্যাচে দুর্বল প্রতিপক্ষ পেয়েও মনে হয়েছে, আমি কি পারব? না খেলার কারণে এটা হয়েছে।’
রাকিবও সমস্যাটা টের পান, ‘পরিবার চায়, খেলি। তবে পরিবার থেকেই শিখেছি, মন থেকে ভালো না লাগলে কিছু করবে না। এ কারণেই পরিবারের কেউ জোর করে না। সিদ্ধান্তটা আমার নিজের। একজন কবিকে চাকু ধরে যেমন কবিতা লেখাতে পারবেন না, তেমনি এখন আমাকে বসিয়ে দাবা খেলতে বললে ঘুঁটি চালা হবে, খেলা হবে না। এটা তো আমার পরিবার বোঝে।’
অনেকেই বলেন, তাঁরা দুজন ব্যবসায় ঢুকেছেন। এই কথায় রাজীবের ঘোর আপত্তি, ‘নিজের টাকা কেউ ব্যাংকে রাখে, কেউ অন্য কাজে। আমরা ঘটনাক্রমে শেয়ারবাজারে কিছু বিনিয়োগ করেছি। এটা ব্যবসা নয়। গ্যারি কাসপারভ রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করেন। নিজের টাকা দিয়ে কে কী করবেন, একান্তই তার ব্যাপার। এ নিয়ে কারও কথা বলা অনুচিত।’ রাকিবের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, ‘না জেনে বলা ঠিক নয়—অমুক কারণে ওরা খেলছে না। এমন কথা শুনে ভীষণ খারাপ লাগে।’
পরক্ষণেই রাজীব চলে গেলেন পেছনে, ‘দাবার এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোকাদ্দেস হোসাইন, যুগ্ম সম্পাদক মাসুদুর রহমান দীপু ও সদস্য রণদেব দাসের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে আমরা খেলছি না। নিয়াজ ভাই, জিয়া ভাইরা এই কমিটিকে সমর্থন দিয়েছেন। কেন দিয়েছেন, তাঁদের ব্যাপার। আমাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা শুনি, “আমরা ব্যবসা করি, ভুল করেছি।” বিদেশে গিয়েও এসব শুনেছি। এখন কে ভুল, কে সঠিক—এটা কে ঠিক করবে?’
রাকিবেরও একই প্রশ্ন, ‘নিয়াজ ভাইকে অনুসরণ করলে আমি একজন নিয়াজ মোরশেদই হব। রাকিব হব না। ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ পল সাত্রে নোবেল পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিয়াজ ভাই কি বলতে পারেন, সাত্রের নোবেল প্রাইজটা নেওয়া উচিত ছিল? এটা কি হয়?’
রাজীবের উদাহরণ, ‘বর্তমান শীর্ষ রেটিংধারী নরওয়ের দাবাড়ু কার্লসেনকে যদি বলি, তুমি আমার চেয়ে ছোট, কিছু বোঝো না—এটা হাস্যকর। কাসপারভ আর কারপভ পুরো আলাদা সত্তা ছিলেন। কাসপারভ কি কখনো বলেছেন, কারপভের স্টাইল ভুল ছিল! ১৯ বছর বয়সে কার্লসেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেননি ফিদের নিয়ম পছন্দ না হওয়ায়। ব্যক্তিগত পছন্দই আসল।’
রাকিবের মুখে আক্ষেপ শোনা যায়, ‘আমরা তো কারও অপকার করছি না। অনেকে এটা বুঝতে চায় না। এসব কারণেই যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন থাকি।’ এরপর বলে যান, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর, হাসান আজিজুল হক, কহিলল জিবরান, বোর্হেস...তাঁরা সবাই কথাশিল্পী। অথচ এ দেশে কেউ একটা গল্প লিখেই কথাশিল্লী হয়ে যাচ্ছে। ইবসেনের বিখ্যাত নাটক এনিমি অব দ্য পিপল। ১০০ বছর আগের সমাজব্যবস্থা নিয়ে। একজন মানুষ সমাজ পরিবর্তনের কথা বলায় তাঁকে সবাই ঢিল ছুড়ছে। দাবাতেও একই অবস্থা হয়েছে।’
রাজীব কথা এগিয়ে নেন, ‘দাবা ফেডারেশনে কিছুদিনের জন্য দায়িত্ব নেওয়া এক সাধারণ সম্পাদকের সময়ও আমরা প্রতিবাদ করেছি। দাবার উন্নয়ন তাঁর লক্ষ্য ছিল না। অলিম্পিয়াডে যেতে চেয়েছেন। আমরা বললাম, আপনার এই অভিজ্ঞতা দাবার কাজে লাগবে না। আপনি এখানে থাকবেন না। দাবায় অধঃপতনের শুরুটা তাঁর সময় থেকে। তখন তরুণদের বলেছি, কিছু হলে দায় নেব আমরা। সে থেকেই তো আমরা প্রতিবাদী।’
দুজনের হাতে এখন অনেক সময়। ব্যক্তিগত ইচ্ছাগুলো পূরণে কাজে লাগাচ্ছেন সময়। রাকিব শুধু বইয়ে ডুবে থাকেন না, ফিরোজা বেগমের গানও খুব ভালোবাসেন। গজলভক্ত এই তরুণের মুখে আবার আক্ষেপ, ‘দাবার পরিবেশ খারাপ। রফিক আজাদের একটা কবিতা আছে, এ কেমন কাল এল...।...সবকিছু কেমন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
খেলাবিহীন জীবনটা কেমন কাটছে? রাকিব বলছেন, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় বাসে যাতায়াত করার সময় প্রচুর পড়েছি। এখনো তা অব্যাহত। এখন পড়ছি আড়াই হাজার বছর আগে চীনের মূল দার্শনিক ভিত্তির একটা অংশ নিয়ে লেখা বই বুক অব চুয়াং জু। চুয়াং জু নিজেই এর অংশ। রেনেসাঁ সময়ের শিল্লী মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, রাফায়েলদের ওপরও পড়ছি।’
রাজীবের সুপ্ত ইচ্ছা, ‘৩০টির বেশি দেশে গিয়েছি। তাদের সংস্কৃতি দেখেছি। এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লেখার ইচ্ছা আছে। তবে সবকিছুর আগে চাই দাবার বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন।’
যত দিন এই দাবি পূরণ না হয়, রাকিব আর রাজীব বাংলাদেশের দাবা থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.