কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-১০ মাইল লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস by রণজিৎ বিশ্বাস
:আ পনার মধ্যে কোনো প্রার্থনা ভাব নেই? : থাকবে না কেন! আছে! আমার মতো করে আমি প্রার্থনা করি। আমার স্টাইলে আমি প্রার্থনা করি। প্রার্থনায় আমি ঘড়ি ধরি না, নিয়মে সরি না, প্রথায় মরি না। : আপনার স্টাইলটা কী রকম?: রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় আমি বলি_সংসারে সবাই যেন ভালো থাকে। যারা গেছে, তারাও ভালো থাকুক; যারা আছে, তারাও ভালো থাকুক। সবার পিছে সবার নিচে আমিও যেন ভালো থাকি। : আপনি আপনার মা-বাবার জন্য অথবা আপনার
বন্ধু-বান্ধব, সন্তান, পরিজনের জন্য কিছু চান না? : চাই। যারা গেছে, তাঁদের মধ্যে আমার মা-বাবা আছেন, পুত্র আছে, ছাত্র আছে, আত্মীয় আছে, বান্ধব আছে। ওদের সবার ভালো যদি হয়, আমার ওদেরও ভালো হবে। যারা আছে তাদের মধ্যেও আমার সন্তান আছে, তাদের জননী আছেন, আমার ছাত্র-পুত্র ও তাদের বন্ধু-বান্ধব আছে, যেজন আমার কথার ইঙ্গিতময়তার জবাবে বলে_আমি বড় কনফিউজড, সেও আছে। ওদের সবার যদি ভালো হয়, আমি যাদের ভালো চাই, তাদের কেউই ভালোর স্পর্শ থেকে বাদ যাবে না।
: তাহলে এই হচ্ছে আপনার প্রার্থনার স্টাইল?
: বলতে পারেন।
: তাহলে আপনি কমপ্লিট সারেন্ডার কারো কাছে করছেন না।
: আমার যা করার আমার স্টাইলে করি। আমি কারো ক্ষতি করি না, ক্ষতির শিকার হই।
: আপনি কি মনে করেন আপনার স্টাইলটি ভালো?
: আপনি কি মনে করেন, আমার স্টাইলটি খারাপ?
: আপনি বড় পেঁচান।
: পেঁচাব না। অন্য প্রশ্ন করুন।
: ধর্মভিত্তিক বিভাজন সম্পর্কে কিছু বলুন।
: কয়েক রকমই তো আছে। ধর্মকানা, ধর্মান্ধ, ধর্মোন্মাদ, ধর্মভীরু ইত্যাদি।
: ধর্মকানা চিনি, ধর্মান্ধ চিনি, ধর্মভীরুও চিনি।
: চেনেন না ধর্মোন্মাদ।
: ধরে ফেলেছেন! ওরা কারা?
: নামেই প্রকাশ! ওরা ধর্মের নামে উন্মাদ।
: যেমন?
: একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। এক জিন্দাপাগল একটি বিদেশি ভাষায় ছাপানো কোনো কাগজ পেলেই কুড়িয়ে নিতেন ও পরম মমতায় তাতে চুমু খেতেন।
: তিনি কি ওই ভাষাটি খুব ভালোবাসতেন?
: বাসতেন। উন্মাদের মতো ভালোবাসতেন।
: ভাষাটি কি খুব সুন্দর ও সমৃদ্ধ?
: সংসারের সব ভাষাই সুন্দর, সব ভাষাই সমৃদ্ধ।
: ভাষাটি কি তিনি খুব ভালো জানতেন? তাতে তার জ্ঞান-গম্যির বেড়বহর কি খুব চমৎকার ছিল?
: হরফ দেখে ভাষাটি তিনি চিনতে পারতেন। পড়তে পারতেন না।
: তার পরও তিনি এ ভাষার হরফ পেলেই চুমুতেন কেন?
: তারপর তিনি তেমন করতেন এবং এখনো তেমন করে চলেন, কারণ সেটি তার ধর্মগ্রন্থের ভাষা।
: কোন ধর্মগ্রন্থের?
: সেটি আমার ধর্মগ্রন্থের হতে পারে, আপনার ধর্মগ্রন্থের হতে পারে, ওঁর ধর্মগ্রন্থের হতে পারে, তাঁর ধর্মগ্রন্থের হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমার ধর্মগ্রন্থের। দেবনাগরী হরফে লেখা একটি কাগজ।
: আপনি তা পড়তে পারেন?
: কাজ চালানোর মতো পারি।
: লোকটি কি আপনার পরিচিত?
: খুব নয়।
: তাঁকে কী আপনি জিজ্ঞেস করেছেন, কেন তিনি এমন করেন?
: করেছি। না করে আমি পারিনি!
: তিনি বললেন?
: 'করব না কেন! পবিত্র ভাষা! আমার পবিত্র ধর্মগ্রন্থের ভাষা!' বললেন_'আপনিও মাথায় ছোঁয়াতে পারেন!'
: আপনি করলেন? মাথায় ছোঁয়ালেন?
: বললাম_দিন তো একটু দেখি। পড়ে দেখি একটু।
: তারপর?
: ওতে মাথায় ছোঁয়ানোর মতো কিছু ছিল না।
: কী ছিল ওটি?
: অবসিন লিটারেচারের একটি পাতা। রগরগে রিপুতাড়ক। পড়ে পড়ে ফ্যানটাসাইজ করার মতো।
: কী করলেন আপনি?
: ফেরত নেওয়ার জন্য ব্যগ্রতায় বাড়ানো ওঁর হাতে সেটি ফিরিয়ে দিলাম।
: কিছু বললেন?
: না। ১০ মাইল লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
: বললেন না কেন কিছু? ভুল তাঁর ভাঙালেন না কেন?
: দু-তিনটে কারণে। এক. আমি তাঁর বিশ্বাসে আঘাত করে তাঁকে তপ্ত করতে চাইনি। শরীরটি আমার পর্যাপ্ত অবহেলায় বয়স পার করেছে, তার পরও তা আমার খুব প্রিয়। আমি তার ওপর কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। দুই. ভাবলাম, যারা বলে বিশ্বাসে মেলায় হরি তর্কে বহুদূর, তাদের কথার প্রতি কয়েক মিনিট না হয় আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাশীল থাকিই না কেন! তিন. স্মরণ করলাম এটি চর্চিত বাক্য_'অজ্ঞানতা কখনো কখনো আশীর্বাদ'।
: আর কী বুঝলেন?
: 'মারাত্মক' ও 'জটিল' একটি বিষয় বুঝলাম।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments