বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-আসকের প্রতিবেদন : যেসব কারণে কাটে না আঁধার by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
২০১২ সালের প্রথম দিন ২০১১ সালের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের গবেষণা কিংবা পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর (২০১১) দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন না করে সামাজিকভাবে শক্তিশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে
আরো বলা হয়েছে, নিখোঁজ হওয়া কিংবা গুপ্তহত্যা এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন মাত্রা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কৌশল পাল্টে গেছে। আগে ক্রসফায়ার হতো, এখন গুম হচ্ছে। অভিযোগগুলো বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
আসক তাদের প্রতিবেদনে যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছে, এসব নিয়ে বেশ কিছু দিন থেকেই নানা মহলে কথা হচ্ছে। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিশেষ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার অভিযোগগুলো আমলে না নিয়ে উল্টো তাদেরই পক্ষাবলম্বন করে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল ওঠে। এই চিত্র পুরনো। এই বৃত্ত থেকে এ দেশের কোনো সরকারই এ যাবৎ বেরিয়ে আসতে পারেনি বিধায় আইনি সংস্থাগুলোর বেআইনি তৎপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশ, পুলিশ মারাত্মকভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। চেকপোস্ট বসিয়ে নতুন করে রাস্তায় মানুষকে হয়রানি শুরু করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির নামে স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে তারা। একটি দেশের আইনি সংস্থার লোকজন যদি বেআইনি তৎপরতায় লিপ্ত হয়, তাহলে সে দেশে মানবাধিকারের সূত্র ছিন্নবিচ্ছিন্ন হবে_এটাই তো স্বাভাবিক। আইনি সংস্থার লোকজনের বেআইনি তৎপরতা কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা শুধু দেশের সাধারণ মানুষের জন্যই বিপজ্জনক নয়, সরকারের জন্যও তা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে এর বিস্তর নজির আছে। স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের প্রতিটি সরকার নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে এবং তারা এ কারণেই জনবান্ধব না হয়ে সরকারবান্ধব হয়েছে। যারা এ দেশের সাধারণ মানুষের করের অর্থে প্রতিপালিত, তারা সরকারের হীনস্বার্থ হাসিলের কাজে যুক্ত হয়ে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা এ ব্যাপারে উৎসাহও বোধ করে আসছে। এর পেছনের কারণ বহুবিধ, যা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন বা বোঝেন।
আসকের প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে র্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার ও হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১০০ জনের। গণপিটুনিতে মারা গেছে ১৩৪ জন, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪১৭টি এবং এর ফলে আহত হয়েছে সাত হাজার ২৩৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। ৫১ জন নিখোঁজ বা অপহরণের পর লাশ মিলেছে ১৫ জনের। কারা হেফাজতে মারা গেছে ১১৬ জন, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে অনেকে বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। এই সভ্যতা, মানবতাবিরোধী অপকর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়েও প্রাণ ঝরেছে কয়েকজনের। এর পাশাপাশি ধর্ষণ, ধর্ষণোত্তর হত্যা, গৃহপরিচারিকা নির্যাতন ও হত্যা, এসিড-সন্ত্রাস, ফতোয়া ও সালিসের নামে নির্যাতন, সাংবাদিক হয়রানি ইত্যাদি ঘটনাও কম ঘটেনি। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এসব প্রচণ্ডভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। মহাজোট সরকারকে দেশের মানুষ বিপুল জনরায়ে ক্ষমতারোহণের পথ মসৃণ করে দিয়েছিল মুখ্যত এসব কারণেই। কিন্তু বিগত তিন বছরে তাদের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চিত্র সামনে রয়েছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে, সেসব ক্ষেত্রেও মানবাধিকারের লঙ্ঘনচিত্রটি পুষ্ট, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে যে বিস্ময়কর চিত্র পরিস্ফুটিত হয়, এর মুখ্য উপাদান স্ববিরোধিতা। এই স্ববিরোধিতা মানুষের অধিকার হরণ করছে, ফলে মানবাধিকার পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশন নামে দেশে যে সংস্থাটির অস্তিত্ব রয়েছে, এর সব কার্যক্রমও যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাঁধা। দায়িত্বশীলরা একটা কথা কেন ভুলে থাকতে চান তা আমরা জানি না। কথাটি হলো, সব কিছুর শেষ আছে, কিন্তু মানুষের অধিকারের কোনো শেষ নেই। এই সত্য যে পর্যন্ত না রাষ্ট্র পরিচালক, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক কিংবা প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা আমলে নেবেন, সে পর্যন্ত বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা দুরাশারই নামান্তর।
এ দেশে উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার কিংবা প্রতিশ্রুতির কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু এমনটি কোনোভাবেই প্রকৃত অর্থে কোনো সমাজের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, যদি দায়িত্বশীলরা আন্তরিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি আমলে নিয়ে প্রতিকারে নিষ্ঠ না হন। এখানে দায় এড়ানোর প্রবণতাও খুব প্রকট। কিন্তু এও মনে রাখা দরকার, দায় এড়িয়ে দায়ভার শেষ করা যায় না, বরং তা আরো বাড়ে। বাংলাদেশের বিদ্যমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে শুধু আসকই নয়, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও। কিন্তু সরকারের তরফে এগুলো আমলে নেওয়ার যথেষ্ট উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এর ফলে অভিযুক্তরা এমনি এমনিই দায় মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। বিচারব্যবস্থার সংস্কার কিংবা দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে না পারার কারণেও দেশের সাধারণ মানুষ অধিকারবঞ্চিত রয়েছে। অনস্বীকার্য যে সীমিত সম্পদের ওপর জনসংখ্যাধিক্যের চাপ জন্ম দেয় অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের। কিন্তু তার পরও কথা থাকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব, যদি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করা সম্ভব হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে এখনো ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। মানুষকে এখন যেনতেনভাবে কোনো কিছুই বোঝানো সম্ভব নয়। মানুষকে অচেতন করে রাখার সব রকম অপচেষ্টা সত্ত্বেও মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন এবং এর সত্যতা মিলছে অহরহ। শত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এখানেই আশাটা খুব পুষ্ট। সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের বিষয়টি বোধগম্য হলেই মঙ্গল।
বৈচিত্র্য গ্রহণ, বৈষম্য বর্জন_আজকের দুনিয়ায় এই স্লোগান সংগত কারণেই মুখে মুখে। কিন্তু তার পরও বৈষম্য থেকে মুক্তি মেলেনি। এখনো সমাজে মারাত্মক সব বৈষম্য বিদ্যমান। সরকারের অঙ্গীকার এবং প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মানবাধিকার কমিশন কাঙ্ক্ষিত রূপ পায়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে অবশ্যই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু এই সংস্থাটি যেন 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার'। এটা সত্য, মানবাধিকার রক্ষা পেলে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়। এটা কাজ করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসেবেও। যে দেশে জনগণের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়, সে দেশে আইনের শাসনও দুর্বল। এ অবস্থা গণতন্ত্রেরও পরিপন্থী। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। একে সমুন্নত রাখার প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু সরকার যদি অভিযোগই আমলে না নেয়, উপরন্তু অভিযোগ উঠলে 'গোস্বা' করে, তাহলে তো তা আরো বেশি বিপদ। 'আমার সমালোচক আমার বন্ধু'_এ দেশে কোনো সরকারই এ সত্যটি আমলে নিতে চায় না। গঠনমূলক সমালোচনা শুধু আত্মশুদ্ধির পথই প্রশস্ত করে না, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারেও মনোযোগী কিংবা আগ্রহী করে তোলে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রকৃত অর্থেই তাঁদের দূরদৃষ্টির প্রতিফলন ঘটিয়ে আঁধার কাটিয়ে আলোর দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। মানবাধিকারের চিত্র উজ্জ্বল না হলে এর মাসুল গুনতে হবে নানাভাবে, যা কোনোভাবে কারো জন্যই প্রীতিকর হবে না।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
আসক তাদের প্রতিবেদনে যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছে, এসব নিয়ে বেশ কিছু দিন থেকেই নানা মহলে কথা হচ্ছে। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিশেষ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার অভিযোগগুলো আমলে না নিয়ে উল্টো তাদেরই পক্ষাবলম্বন করে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল ওঠে। এই চিত্র পুরনো। এই বৃত্ত থেকে এ দেশের কোনো সরকারই এ যাবৎ বেরিয়ে আসতে পারেনি বিধায় আইনি সংস্থাগুলোর বেআইনি তৎপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশ, পুলিশ মারাত্মকভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। চেকপোস্ট বসিয়ে নতুন করে রাস্তায় মানুষকে হয়রানি শুরু করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির নামে স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে তারা। একটি দেশের আইনি সংস্থার লোকজন যদি বেআইনি তৎপরতায় লিপ্ত হয়, তাহলে সে দেশে মানবাধিকারের সূত্র ছিন্নবিচ্ছিন্ন হবে_এটাই তো স্বাভাবিক। আইনি সংস্থার লোকজনের বেআইনি তৎপরতা কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা শুধু দেশের সাধারণ মানুষের জন্যই বিপজ্জনক নয়, সরকারের জন্যও তা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে এর বিস্তর নজির আছে। স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের প্রতিটি সরকার নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে এবং তারা এ কারণেই জনবান্ধব না হয়ে সরকারবান্ধব হয়েছে। যারা এ দেশের সাধারণ মানুষের করের অর্থে প্রতিপালিত, তারা সরকারের হীনস্বার্থ হাসিলের কাজে যুক্ত হয়ে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা এ ব্যাপারে উৎসাহও বোধ করে আসছে। এর পেছনের কারণ বহুবিধ, যা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন বা বোঝেন।
আসকের প্রতিবেদনে পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে র্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার ও হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১০০ জনের। গণপিটুনিতে মারা গেছে ১৩৪ জন, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪১৭টি এবং এর ফলে আহত হয়েছে সাত হাজার ২৩৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। ৫১ জন নিখোঁজ বা অপহরণের পর লাশ মিলেছে ১৫ জনের। কারা হেফাজতে মারা গেছে ১১৬ জন, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে অনেকে বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। এই সভ্যতা, মানবতাবিরোধী অপকর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়েও প্রাণ ঝরেছে কয়েকজনের। এর পাশাপাশি ধর্ষণ, ধর্ষণোত্তর হত্যা, গৃহপরিচারিকা নির্যাতন ও হত্যা, এসিড-সন্ত্রাস, ফতোয়া ও সালিসের নামে নির্যাতন, সাংবাদিক হয়রানি ইত্যাদি ঘটনাও কম ঘটেনি। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এসব প্রচণ্ডভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। মহাজোট সরকারকে দেশের মানুষ বিপুল জনরায়ে ক্ষমতারোহণের পথ মসৃণ করে দিয়েছিল মুখ্যত এসব কারণেই। কিন্তু বিগত তিন বছরে তাদের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চিত্র সামনে রয়েছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে, সেসব ক্ষেত্রেও মানবাধিকারের লঙ্ঘনচিত্রটি পুষ্ট, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে যে বিস্ময়কর চিত্র পরিস্ফুটিত হয়, এর মুখ্য উপাদান স্ববিরোধিতা। এই স্ববিরোধিতা মানুষের অধিকার হরণ করছে, ফলে মানবাধিকার পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশন নামে দেশে যে সংস্থাটির অস্তিত্ব রয়েছে, এর সব কার্যক্রমও যেন অদৃশ্য এক সুতায় বাঁধা। দায়িত্বশীলরা একটা কথা কেন ভুলে থাকতে চান তা আমরা জানি না। কথাটি হলো, সব কিছুর শেষ আছে, কিন্তু মানুষের অধিকারের কোনো শেষ নেই। এই সত্য যে পর্যন্ত না রাষ্ট্র পরিচালক, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক কিংবা প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা আমলে নেবেন, সে পর্যন্ত বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা দুরাশারই নামান্তর।
এ দেশে উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার কিংবা প্রতিশ্রুতির কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু এমনটি কোনোভাবেই প্রকৃত অর্থে কোনো সমাজের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, যদি দায়িত্বশীলরা আন্তরিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি আমলে নিয়ে প্রতিকারে নিষ্ঠ না হন। এখানে দায় এড়ানোর প্রবণতাও খুব প্রকট। কিন্তু এও মনে রাখা দরকার, দায় এড়িয়ে দায়ভার শেষ করা যায় না, বরং তা আরো বাড়ে। বাংলাদেশের বিদ্যমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে শুধু আসকই নয়, উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও। কিন্তু সরকারের তরফে এগুলো আমলে নেওয়ার যথেষ্ট উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এর ফলে অভিযুক্তরা এমনি এমনিই দায় মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। বিচারব্যবস্থার সংস্কার কিংবা দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে না পারার কারণেও দেশের সাধারণ মানুষ অধিকারবঞ্চিত রয়েছে। অনস্বীকার্য যে সীমিত সম্পদের ওপর জনসংখ্যাধিক্যের চাপ জন্ম দেয় অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের। কিন্তু তার পরও কথা থাকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব, যদি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করা সম্ভব হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে এখনো ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। মানুষকে এখন যেনতেনভাবে কোনো কিছুই বোঝানো সম্ভব নয়। মানুষকে অচেতন করে রাখার সব রকম অপচেষ্টা সত্ত্বেও মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন এবং এর সত্যতা মিলছে অহরহ। শত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এখানেই আশাটা খুব পুষ্ট। সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের বিষয়টি বোধগম্য হলেই মঙ্গল।
বৈচিত্র্য গ্রহণ, বৈষম্য বর্জন_আজকের দুনিয়ায় এই স্লোগান সংগত কারণেই মুখে মুখে। কিন্তু তার পরও বৈষম্য থেকে মুক্তি মেলেনি। এখনো সমাজে মারাত্মক সব বৈষম্য বিদ্যমান। সরকারের অঙ্গীকার এবং প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মানবাধিকার কমিশন কাঙ্ক্ষিত রূপ পায়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে অবশ্যই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু এই সংস্থাটি যেন 'ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার'। এটা সত্য, মানবাধিকার রক্ষা পেলে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়। এটা কাজ করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসেবেও। যে দেশে জনগণের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়, সে দেশে আইনের শাসনও দুর্বল। এ অবস্থা গণতন্ত্রেরও পরিপন্থী। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। একে সমুন্নত রাখার প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু সরকার যদি অভিযোগই আমলে না নেয়, উপরন্তু অভিযোগ উঠলে 'গোস্বা' করে, তাহলে তো তা আরো বেশি বিপদ। 'আমার সমালোচক আমার বন্ধু'_এ দেশে কোনো সরকারই এ সত্যটি আমলে নিতে চায় না। গঠনমূলক সমালোচনা শুধু আত্মশুদ্ধির পথই প্রশস্ত করে না, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারেও মনোযোগী কিংবা আগ্রহী করে তোলে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রকৃত অর্থেই তাঁদের দূরদৃষ্টির প্রতিফলন ঘটিয়ে আঁধার কাটিয়ে আলোর দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। মানবাধিকারের চিত্র উজ্জ্বল না হলে এর মাসুল গুনতে হবে নানাভাবে, যা কোনোভাবে কারো জন্যই প্রীতিকর হবে না।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments