লন্ডনের ডিকেন্স ও তাঁর সহমর্মিতার কথা by গাজীউল হাসান খান
লেখক-ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স ছিলেন লন্ডনের একজন গর্বিত বাসিন্দা। তাঁর মতো কোনো লেখক-ঔপন্যাসিকের রচনায়, চরিত্র-চিত্রণে কিংবা সংলাপে কোনো নগরী এতটা উপজীব্য হয়ে উঠতে খুব কমই দেখা গেছে। অবশ্য লন্ডন নগরীই ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র। এক কথায় বলা যায়, বিচরণক্ষেত্র। লন্ডন নগরী চার্লস ডিকেন্সের মিস হ্যাভাশাম কিংবা অলিভার টুইস্টের মতোই একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র। ডিকেন্সের লন্ডন তখন তার কেন্দ্র থেকে টেমস নদীর কূল ধরে
পার্শ্ববর্তী কেন্ট অঞ্চলের গভীর অভ্যন্তর পর্যন্ত কর্মতৎপর ছিল। তার কারণ, সেদিকেই প্রতিবেশী অপর জনপ্রিয় নগরী প্যারিসের অবস্থান। ডিকেন্স তাঁর সাহিত্যকর্মে লন্ডনের উলি্লখিত এলাকার চেনাজানা বসতি, ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন ও কালো পাথুরে রাস্তাঘাটসহ মানুষের যাপিত জীবনের অনেক অজানা দুঃখ-বেদনার কথা তুলে ধরেছেন, যা মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর 'বি্লক হাউস' অথবা 'আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড'-এ। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডিকেন্সের রচিত কোনো উপন্যাসেই লন্ডন নগরীর কোনো বর্ণনা আলাদাভাবে কোথাও দেওয়া হয়নি। এ নগরী বিমূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সৃষ্ট উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে। তারাই সামগ্রিকভাবে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে লন্ডনকে ধরে রেখেছে এবং চিত্রায়িত করেছে বিশদভাবে।
ডিকেন্সের রচিত সাহিত্যকর্মের একটি বিশেষ সময় ছিল ১৮৩০-এর দশক। সে সময় তিনি লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছিলেন এবং রাস্তাঘাটেও প্রচুর ঘোরাফেরা করতেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি অতি দ্রুত এ নগরীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই অন্যান্য শহর-নগরের তুলনায় ২০১২ সালে লন্ডন এ মহান লেখক-ঔপন্যাসিকের দুই শততম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের বিশেষভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, জুরিখ কিংবা ক্যামের তুলনায় লন্ডন মিউজিয়াম ও ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট (বিএফআই) বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট টেমসের দক্ষিণ তীরে দীর্ঘদিন ধরে ডিকেন্সের কাহিনীভিত্তিক নির্মিত বিভিন্ন ছায়াছবি দেখানোর আয়োজন করেছে। তা ছাড়া গত ক্রিসমাসের আগ থেকেই বিবিসি টেলিভিশন শুরু করেছে তাদের নির্মিত ডিকেন্সের বিভিন্ন উপন্যাসের নিজস্ব চিত্ররূপ সম্প্রচার। মিউজিয়াম অব লন্ডন 'ডিকেন্স অ্যান্ড লন্ডন' শিরোনামে ছয় মাসব্যাপী একটি প্রদর্শনীর (ডিসেম্বর ৯, ২০১১-জুন ১০, ২০১২) আয়োজন করেছে, যা চলবে অলিম্পিক গেইমসের আগ পর্যন্ত। তাতে ডিকেন্সের লেখার টেবিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি এবং সে সময়কার লন্ডনের বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্যপট তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ, ডিকেন্স যেমন তাঁর প্রিয় নগরী লন্ডনকে বিভিন্নভাবে চিত্রায়িত করেছেন, তেমনি লন্ডনও ডিকেন্সের সার্বিক মনোজগৎ ও লেখক সত্তাকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে। ডিকেন্স লন্ডনের গৌরব এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক।
চার্লস ডিকেন্স ১৮১২ সালে ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৮১৪ সালে প্রথম লন্ডনে আসেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে। তারপর কেন্টের চ্যাথামে চলে গিয়েছিলেন সাময়িকভাবে। ডিকেন্স ১৮২৩ সালে ১১ বছর বয়সে আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। তখন থেকে ১৮৭০ সালে মৃত্যুর আগে আর সেভাবে লন্ডন ছেড়ে যাননি কোথাও। সে সময়ের মধ্যে প্রচুর মানুষ বিভিন্ন কারণে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস স্থাপন করে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল জীবিকা নির্বাহ কিংবা কর্মসংস্থানের বিষয়টি। ডিকেন্সের দারিদ্র্যপীড়িত বাবাও জীবিকার সন্ধানেই পরিবার-পরিজন নিয়ে লন্ডনে এসেছিলেন। তখন থেকেই বালক ডিকেন্স নিজেকে একজন একনিষ্ঠ লন্ডনবাসী হিসেবে ভাবতে শিখেছিলেন। ডিকেন্সের বাল্য বয়সে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের লন্ডনে আগমন ঘটত। লন্ডনের জনজীবনে তখন দারিদ্র্য ও সম্পদের এক বিশাল বৈপরীত্য ছিল, যা বালক ডিকেন্স অত্যন্ত তিক্তভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ডিকেন্সের বাবার আয়ে কোনোভাবেই সংসারের খরচ কুলাত না। ফলে ১৮২৪ সালে ঋণের দায়ে তাঁকে কারাবাসী হতে হয়েছিল। তখন বালক ডিকেন্স একাকী লন্ডনের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তিনি টেমস নদীর পাড়ে একটি ডিঙি ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়েছিলেন। তা ছাড়া বাবার কারাবাসের কাছেই একটি থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে ডিকেন্সের মধ্যে একটি লেখকের চরিত্র গড়ে উঠেছিল। তাঁর লিখিত 'লিটল ডরিট' এবং 'ডেভিড কপারফিল্ড'-এ ডিকেন্সের কিশোরজীবনের বেশ কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়।
চার্লস ডিকেন্সের হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই। সারা জীবনই তিনি লন্ডনের বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে কভেন্ট গার্ডেনে দিন-রাত ও যখন-তখন ঘুরে বেড়াতেন। রাতের বাস কন্ডাক্টর এবং রাস্তার ছেলেপুলেরা তখন তাঁকে ভালোভাবেই চিনত। র্যাটক্লিফ হাইওয়ে, হেভারস্টক হিল, ক্যাম্বারওয়েল গ্রিন, গ্রেইজ ইন রোড ও ওয়ান্ডস ওয়ার্থ রোড, হেমার স্মিথ ব্রডওয়ে, নর্টন ফলগেইট এবং কেনসাস নিউ টাউনে তিনি বিশেষভাবে ঘুরে বেড়াতেন বলে তাঁর সমসাময়িক জর্জ অগাস্টাস সালা পরে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া লন্ডনের জলাভূমি বেষ্টিত কেনটিশ টাউন ডিকেন্সের উপন্যাসে উলি্লখিত স্থানগুলোর মধ্যে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। দুর্গম বা নিকৃষ্ট স্থানগুলো এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া_কোনোটিই তাঁর চলাফেরার পথে কখনোই বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। ডিকেন্স লন্ডনের অসংখ্য ঠিকানায় বাস করেছেন। ব্লুমসবারির ৪৮ ডাউটি স্ট্রিটে ডিকেন্স মিউজিয়াম করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য। তবে উলি্লখিত স্থানগুলো, লোকালয় ও জনবসতি বৃহত্তর লন্ডন সম্পর্কে ডিকেন্সকে অসামান্য তথ্য, জ্ঞান ও বিশেষ অনুভূতি দিয়েছে। 'এ বিরাট শহর ও তার বাসিন্দাদের আমি চিনি'_একবার গর্ব করে বলেছিলেন ডিকেন্স। এ শহর, তার বাসিন্দা এবং এখানে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনা ডিকেন্সের উপন্যাসে বিশদ এবং অত্যন্ত গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে। মাসিক কিস্তিতে ১৮৩৬ সাল থেকে তিনি লন্ডনের 'দ্য পিকউইক পেপারস'-এ লেখা শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। চার্লস ডিকেন্সের ছবিতুল্য স্মরণশক্তি এবং বিভিন্ন মানুষের মুখের উচ্চারণ শনাক্ত করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। একবার তাঁর এক ছেলের সঙ্গে অঙ্ফোর্ড স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন তিনি। অতীতে অর্থাৎ তাঁর বাল্যকালে সেখানে কোন কোন দোকানপাট ছিল এবং পণ্যসামগ্রী বিক্রি হতো, তা তিনি নির্ভুলভাবে পরে বর্ণনা দিয়েছিলেন বলে জানান 'ডিকেন্স অ্যান্ড লন্ডন'-এর কিউরেটর আলেঙ্ ওয়ার্নার। ডিকেন্সের কান ছিল তাঁর চোখের মতোই শক্তিশালী। তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা, বাচনভঙ্গি এবং শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন। তখন ডিকেন্স ছাড়া সাহিত্যে কেউ সেগুলো ব্যবহার করতেন না। ডিকেন্সের লেখা সচিত্র মাসিক পরিক্রমাগুলো ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
ডিকেন্স লন্ডনে প্রথমে আইনজীবীদের অফিসে করণিকের কাজ নিয়েছিলেন। তারপর ১৮৩৪ সালে লন্ডনের 'মর্নিং ক্রনিকেল'-এ পার্লামেন্টারি বিতর্কের ওপর রিপোর্টিংয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি বিভিন্ন সাময়িকীতে রঙ্গ-ব্যঙ্গ জাতীয় আধুনিক রচনা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস 'অলিভার টুইস্ট' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩৭ সালে। সে উপন্যাসে তিনি ব্রিটিশ সমাজে তৎকালীন শিশুশ্রমের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তারপর তাঁর 'নিকোলাস নিকলবি' ১৮৩৭, 'দি ওল্ড কিউরিসিটিশপ' ১৮৪০-৪১, 'বার্নাবিরাজ' ১৮৪১, তারপর 'ডেভিড কপারফিল্ড', 'বি্লক হাউস', 'এটেল অব টু সিটিজ', 'গ্রেট এঙ্পেক্টেশন্স' এবং 'আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড'সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লেখা একের পর এক প্রকাশিত হয়েছিল। চার্লস ডিকেন্স ইংরেজি সাহিত্যের লেখকের তালিকায় তখন এক নম্বরে উঠে এসেছিলেন। অন্যান্যের মধ্যে তাঁর লিখিত 'গ্রেট এঙ্পেক্টেশন্স'কে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে বিভিন্ন সাহিত্যামোদী মতপ্রকাশ করলেও 'ডেভিড কপারফিল্ড', 'বি্লক হাউস', 'নিকোলাস নিকলবি', 'আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড' এবং 'অলিভার টুইস্ট'কেও অনেকে অনেক কারণে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, ইংল্যান্ডের অশিক্ষিত মানুষও ডিকেন্সের রচনাবলির খবর রাখত। তখন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বিভিন্ন রচনা ধারাবাহিকভাবে শ্রোতাদের পড়ে শোনানোর জন্য বিভিন্ন মজলিসের আয়োজন করা হতো। কেউ সহজে তাঁর লেখার কোনো ধারাবাহিক অংশ থেকে বঞ্চিত হতে চাইত না। ইংল্যান্ডের এবং বিশেষ করে লন্ডনের নাগরিক জীবনে এটি ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। ডিকেন্সের রচনাবলিকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে সেকালে এক অভিনব পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল। শুধু পশ্চিম লন্ডনের ওপরতলা-নিচতলা নয়, লন্ডনের সব এলাকা এবং সমাজজীবনের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ডিকেন্স তাঁর সাহিত্য রচনার ব্যাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।
আর্থসামাজিক বৈষম্য উচ্ছেদ, ন্যায় ও সর্বস্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠার বাসনা ডিকেন্সের সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের সম্পর্ককে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও জোরদার করে তুলেছিল। ডিকেন্স বলেছেন, জনগণের একের প্রতি অন্যের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া কোনো সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। তিনি কার্ল মার্কসের সমসাময়িক হলেও রাজনীতিতে উৎসাহী ছিলেন না। তবে হাউস অব কমন্সের একজন সচেতন তরুণ সাংবাদিক হিসেবে তিনি সামাজিক অবিচার, বৈষম্য দূর করা এবং মানুষের মধ্যে সাম্য ও সব পর্যায়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা লিখেছিলেন। জর্জ অরওয়েসের মতে, তিনি ধনিক শ্রেণীর দয়াবান হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন, যাতে শ্রমজীবীদের বিদ্রোহী হতে না হয়। তাই একটি কল্যাণরাষ্ট্র কিংবা সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠায় ডিকেন্স যতবার নৈতিকতা, বিবেক, সুবিচার, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা বলেছেন, সে তুলনায় একবারও বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লবের কথা উল্লেখ করেননি। তাই ক্রিসমাসের স্পিরিটকে তিনি সমাজের আবেগ ও অনুভূতির কেন্দ্র বলে মনে করতেন।
চার্লস ডিকেন্স ১৮৭০ সালের ৯ জুন মৃত্যুর আগেই শেকসপিয়ারের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ইংরেজ সমাজে ডিকেন্সের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। শেকসপিয়ার কালোত্তীর্ণ সাহিত্যিক হতে পারেন, কিন্তু ডিকেন্স ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সৃষ্টি হিসেবে প্রথম আধুনিক লেখকের মর্যাদা পেয়েছেন। সে কারণেই ব্রিটিশ সমাজ, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মানুষের মনন ও সংস্কৃতিচর্চায় ডিকেন্সের একটি নীরব অথচ দৃশ্যমান উপস্থিতি আজও
অনুভূত হয়।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
ডিকেন্সের রচিত সাহিত্যকর্মের একটি বিশেষ সময় ছিল ১৮৩০-এর দশক। সে সময় তিনি লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছিলেন এবং রাস্তাঘাটেও প্রচুর ঘোরাফেরা করতেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি অতি দ্রুত এ নগরীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই অন্যান্য শহর-নগরের তুলনায় ২০১২ সালে লন্ডন এ মহান লেখক-ঔপন্যাসিকের দুই শততম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের বিশেষভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, জুরিখ কিংবা ক্যামের তুলনায় লন্ডন মিউজিয়াম ও ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট (বিএফআই) বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট টেমসের দক্ষিণ তীরে দীর্ঘদিন ধরে ডিকেন্সের কাহিনীভিত্তিক নির্মিত বিভিন্ন ছায়াছবি দেখানোর আয়োজন করেছে। তা ছাড়া গত ক্রিসমাসের আগ থেকেই বিবিসি টেলিভিশন শুরু করেছে তাদের নির্মিত ডিকেন্সের বিভিন্ন উপন্যাসের নিজস্ব চিত্ররূপ সম্প্রচার। মিউজিয়াম অব লন্ডন 'ডিকেন্স অ্যান্ড লন্ডন' শিরোনামে ছয় মাসব্যাপী একটি প্রদর্শনীর (ডিসেম্বর ৯, ২০১১-জুন ১০, ২০১২) আয়োজন করেছে, যা চলবে অলিম্পিক গেইমসের আগ পর্যন্ত। তাতে ডিকেন্সের লেখার টেবিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি এবং সে সময়কার লন্ডনের বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্যপট তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ, ডিকেন্স যেমন তাঁর প্রিয় নগরী লন্ডনকে বিভিন্নভাবে চিত্রায়িত করেছেন, তেমনি লন্ডনও ডিকেন্সের সার্বিক মনোজগৎ ও লেখক সত্তাকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে। ডিকেন্স লন্ডনের গৌরব এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক।
চার্লস ডিকেন্স ১৮১২ সালে ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৮১৪ সালে প্রথম লন্ডনে আসেন তাঁর পরিবারের সঙ্গে। তারপর কেন্টের চ্যাথামে চলে গিয়েছিলেন সাময়িকভাবে। ডিকেন্স ১৮২৩ সালে ১১ বছর বয়সে আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। তখন থেকে ১৮৭০ সালে মৃত্যুর আগে আর সেভাবে লন্ডন ছেড়ে যাননি কোথাও। সে সময়ের মধ্যে প্রচুর মানুষ বিভিন্ন কারণে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস স্থাপন করে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল জীবিকা নির্বাহ কিংবা কর্মসংস্থানের বিষয়টি। ডিকেন্সের দারিদ্র্যপীড়িত বাবাও জীবিকার সন্ধানেই পরিবার-পরিজন নিয়ে লন্ডনে এসেছিলেন। তখন থেকেই বালক ডিকেন্স নিজেকে একজন একনিষ্ঠ লন্ডনবাসী হিসেবে ভাবতে শিখেছিলেন। ডিকেন্সের বাল্য বয়সে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের লন্ডনে আগমন ঘটত। লন্ডনের জনজীবনে তখন দারিদ্র্য ও সম্পদের এক বিশাল বৈপরীত্য ছিল, যা বালক ডিকেন্স অত্যন্ত তিক্তভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। ডিকেন্সের বাবার আয়ে কোনোভাবেই সংসারের খরচ কুলাত না। ফলে ১৮২৪ সালে ঋণের দায়ে তাঁকে কারাবাসী হতে হয়েছিল। তখন বালক ডিকেন্স একাকী লন্ডনের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তিনি টেমস নদীর পাড়ে একটি ডিঙি ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়েছিলেন। তা ছাড়া বাবার কারাবাসের কাছেই একটি থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে ডিকেন্সের মধ্যে একটি লেখকের চরিত্র গড়ে উঠেছিল। তাঁর লিখিত 'লিটল ডরিট' এবং 'ডেভিড কপারফিল্ড'-এ ডিকেন্সের কিশোরজীবনের বেশ কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়।
চার্লস ডিকেন্সের হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকেই। সারা জীবনই তিনি লন্ডনের বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে কভেন্ট গার্ডেনে দিন-রাত ও যখন-তখন ঘুরে বেড়াতেন। রাতের বাস কন্ডাক্টর এবং রাস্তার ছেলেপুলেরা তখন তাঁকে ভালোভাবেই চিনত। র্যাটক্লিফ হাইওয়ে, হেভারস্টক হিল, ক্যাম্বারওয়েল গ্রিন, গ্রেইজ ইন রোড ও ওয়ান্ডস ওয়ার্থ রোড, হেমার স্মিথ ব্রডওয়ে, নর্টন ফলগেইট এবং কেনসাস নিউ টাউনে তিনি বিশেষভাবে ঘুরে বেড়াতেন বলে তাঁর সমসাময়িক জর্জ অগাস্টাস সালা পরে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া লন্ডনের জলাভূমি বেষ্টিত কেনটিশ টাউন ডিকেন্সের উপন্যাসে উলি্লখিত স্থানগুলোর মধ্যে অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। দুর্গম বা নিকৃষ্ট স্থানগুলো এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া_কোনোটিই তাঁর চলাফেরার পথে কখনোই বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। ডিকেন্স লন্ডনের অসংখ্য ঠিকানায় বাস করেছেন। ব্লুমসবারির ৪৮ ডাউটি স্ট্রিটে ডিকেন্স মিউজিয়াম করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য। তবে উলি্লখিত স্থানগুলো, লোকালয় ও জনবসতি বৃহত্তর লন্ডন সম্পর্কে ডিকেন্সকে অসামান্য তথ্য, জ্ঞান ও বিশেষ অনুভূতি দিয়েছে। 'এ বিরাট শহর ও তার বাসিন্দাদের আমি চিনি'_একবার গর্ব করে বলেছিলেন ডিকেন্স। এ শহর, তার বাসিন্দা এবং এখানে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনা ডিকেন্সের উপন্যাসে বিশদ এবং অত্যন্ত গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে। মাসিক কিস্তিতে ১৮৩৬ সাল থেকে তিনি লন্ডনের 'দ্য পিকউইক পেপারস'-এ লেখা শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। চার্লস ডিকেন্সের ছবিতুল্য স্মরণশক্তি এবং বিভিন্ন মানুষের মুখের উচ্চারণ শনাক্ত করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। একবার তাঁর এক ছেলের সঙ্গে অঙ্ফোর্ড স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন তিনি। অতীতে অর্থাৎ তাঁর বাল্যকালে সেখানে কোন কোন দোকানপাট ছিল এবং পণ্যসামগ্রী বিক্রি হতো, তা তিনি নির্ভুলভাবে পরে বর্ণনা দিয়েছিলেন বলে জানান 'ডিকেন্স অ্যান্ড লন্ডন'-এর কিউরেটর আলেঙ্ ওয়ার্নার। ডিকেন্সের কান ছিল তাঁর চোখের মতোই শক্তিশালী। তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা, বাচনভঙ্গি এবং শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন। তখন ডিকেন্স ছাড়া সাহিত্যে কেউ সেগুলো ব্যবহার করতেন না। ডিকেন্সের লেখা সচিত্র মাসিক পরিক্রমাগুলো ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
ডিকেন্স লন্ডনে প্রথমে আইনজীবীদের অফিসে করণিকের কাজ নিয়েছিলেন। তারপর ১৮৩৪ সালে লন্ডনের 'মর্নিং ক্রনিকেল'-এ পার্লামেন্টারি বিতর্কের ওপর রিপোর্টিংয়ের কাজ শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি বিভিন্ন সাময়িকীতে রঙ্গ-ব্যঙ্গ জাতীয় আধুনিক রচনা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস 'অলিভার টুইস্ট' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩৭ সালে। সে উপন্যাসে তিনি ব্রিটিশ সমাজে তৎকালীন শিশুশ্রমের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তারপর তাঁর 'নিকোলাস নিকলবি' ১৮৩৭, 'দি ওল্ড কিউরিসিটিশপ' ১৮৪০-৪১, 'বার্নাবিরাজ' ১৮৪১, তারপর 'ডেভিড কপারফিল্ড', 'বি্লক হাউস', 'এটেল অব টু সিটিজ', 'গ্রেট এঙ্পেক্টেশন্স' এবং 'আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড'সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লেখা একের পর এক প্রকাশিত হয়েছিল। চার্লস ডিকেন্স ইংরেজি সাহিত্যের লেখকের তালিকায় তখন এক নম্বরে উঠে এসেছিলেন। অন্যান্যের মধ্যে তাঁর লিখিত 'গ্রেট এঙ্পেক্টেশন্স'কে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে বিভিন্ন সাহিত্যামোদী মতপ্রকাশ করলেও 'ডেভিড কপারফিল্ড', 'বি্লক হাউস', 'নিকোলাস নিকলবি', 'আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড' এবং 'অলিভার টুইস্ট'কেও অনেকে অনেক কারণে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, ইংল্যান্ডের অশিক্ষিত মানুষও ডিকেন্সের রচনাবলির খবর রাখত। তখন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বিভিন্ন রচনা ধারাবাহিকভাবে শ্রোতাদের পড়ে শোনানোর জন্য বিভিন্ন মজলিসের আয়োজন করা হতো। কেউ সহজে তাঁর লেখার কোনো ধারাবাহিক অংশ থেকে বঞ্চিত হতে চাইত না। ইংল্যান্ডের এবং বিশেষ করে লন্ডনের নাগরিক জীবনে এটি ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। ডিকেন্সের রচনাবলিকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে সেকালে এক অভিনব পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল। শুধু পশ্চিম লন্ডনের ওপরতলা-নিচতলা নয়, লন্ডনের সব এলাকা এবং সমাজজীবনের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ডিকেন্স তাঁর সাহিত্য রচনার ব্যাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।
আর্থসামাজিক বৈষম্য উচ্ছেদ, ন্যায় ও সর্বস্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠার বাসনা ডিকেন্সের সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের সম্পর্ককে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও জোরদার করে তুলেছিল। ডিকেন্স বলেছেন, জনগণের একের প্রতি অন্যের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া কোনো সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। তিনি কার্ল মার্কসের সমসাময়িক হলেও রাজনীতিতে উৎসাহী ছিলেন না। তবে হাউস অব কমন্সের একজন সচেতন তরুণ সাংবাদিক হিসেবে তিনি সামাজিক অবিচার, বৈষম্য দূর করা এবং মানুষের মধ্যে সাম্য ও সব পর্যায়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা লিখেছিলেন। জর্জ অরওয়েসের মতে, তিনি ধনিক শ্রেণীর দয়াবান হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন, যাতে শ্রমজীবীদের বিদ্রোহী হতে না হয়। তাই একটি কল্যাণরাষ্ট্র কিংবা সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠায় ডিকেন্স যতবার নৈতিকতা, বিবেক, সুবিচার, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা বলেছেন, সে তুলনায় একবারও বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লবের কথা উল্লেখ করেননি। তাই ক্রিসমাসের স্পিরিটকে তিনি সমাজের আবেগ ও অনুভূতির কেন্দ্র বলে মনে করতেন।
চার্লস ডিকেন্স ১৮৭০ সালের ৯ জুন মৃত্যুর আগেই শেকসপিয়ারের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ইংরেজ সমাজে ডিকেন্সের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। শেকসপিয়ার কালোত্তীর্ণ সাহিত্যিক হতে পারেন, কিন্তু ডিকেন্স ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সৃষ্টি হিসেবে প্রথম আধুনিক লেখকের মর্যাদা পেয়েছেন। সে কারণেই ব্রিটিশ সমাজ, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মানুষের মনন ও সংস্কৃতিচর্চায় ডিকেন্সের একটি নীরব অথচ দৃশ্যমান উপস্থিতি আজও
অনুভূত হয়।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com
No comments