খোলা হাওয়া-জনমত মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রথম আলো ২০১১ জনমত জরিপে অংশ নিয়েছেন পাঁচ হাজার মানুষ। তাঁরা থাকেন গ্রামে ও শহরে, তাঁরা বিভিন্ন বয়স-শ্রেণীর, কাজ করেন বিভিন্ন পেশায় অথবা তাঁদের কেউ কেউ শিক্ষার্থী, থাকেন নানা জেলায়। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ভোটারের সংখ্যা ঠিক কত আমার জানা নেই, হয়তো নির্বাচন কমিশন জানে—সম্ভবত আট-নয় কোটির ঘরে হবে। এই বিশাল ভোটার সংখ্যার তুলনায় মাত্র পাঁচ হাজারের নমুনা-দল বিশ্বাসযোগ্য কি না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, এটি অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে নির্বাচনের আগে অথবা পরে (যেমন—এক্সিট পল এ) এর চেয়ে কম নমুনা সংখ্যা নিয়ে জনমতের যে আগাম প্রতিফলন পাওয়া যায়, তাতেও মোটামুটি নির্ভুলভাবেই ফল সম্পর্কে একটা ধারণা চলে আসে। প্রথম আলোর একদিন আগে সমকাল নিজেদের উদ্যোগে দেশব্যাপী একটি জরিপ চালিয়ে এর ফলাফল ছাপিয়েছে। ওই জরিপে অংশ নিয়েছেন ১০ হাজার মানুষ। একই সঙ্গে ডেইলি স্টারও এ রকম একটি জরিপ চালায় এবং এ বিষয়টি কাকতালীয় বা অবাক করার মতো নয় যে তিনটি জরিপে জনমতের প্রতিফলন প্রায় কাছাকাছি। আমি নিজে এ তিন জরিপের সঙ্গে একমত; যেহেতু প্রতিদিন আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের থেকে, সহকর্মী, পরিচিতজন, রিকশাচালক, তরকারি বা মাছবিক্রেতা থেকে একই রকম ধারণা পাই।
এরা হয়তো ব্যক্তিগতভাবে কোনো না কোনো দলের অনুসারী। কিন্তু ঢালাওভাবে এদের সরকার বা আওয়ামী লীগবিরোধী বলা যাবে না। তাই এদের মতামতকে মূল্যহীন ভাবা ঠিক নয়। ডেইলি স্টার-এর জরিপে বর্তমান সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন কমে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের অনিয়ন্ত্রিত ও স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড। গত ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে সংগঠনটির ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হলো। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিলেন আর ছাত্রলীগকে সুনাম হারানোর জন্য ভর্ৎসনা করলেন। সেদিন কলাভবনের চারদিকে ও সামনের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে অসংখ্য মাইক লাগিয়ে যে বিকট শব্দোৎপাত হলো, তাতে দুটি ক্লাস নিতে আমার ভীষণ কষ্ট হলো। ছাত্রছাত্রীরা আমার কোনো কথাই শুনতে পারছিল না। আমার পুরো ক্লাস বিষণ্নতা আর কৌতুকের এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে আমাকে সহযোগিতা করল।
যে উদ্যাপন ক্লাসের সময়ে ভাগ বসায়, তা কি শিক্ষাঙ্গনের মাঝখানে পুরোনো একটি ছাত্রসংগঠনের পালন করা উচিত? কিন্তু এ তো বাহ্য। সাতক্ষীরায় ছাত্রলীগের যে দুই নেতা ধর্ষণের অথবা ধর্ষণ-চেষ্টার মতো অপকর্মে লিপ্ত হয়, তাতে সংগঠনের সুনাম কতটা বাড়ে? সরকারের ভাবমূর্তির কী হয়? সাতক্ষীরার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু সারা দেশে বেপরোয়া হয়ে ওঠা নেতা-কর্মীদের কেন সহ্য করা হচ্ছে? গত জোট সরকারের পরাজয়ের একটি কারণ ছিল ছাত্রদলের উদ্ধত ও বেপরোয়া আচরণ। এটি কি ভুলে যাওয়া উচিত?
এ কারণে প্রথম আলোর জরিপের মতামত মেনে নেওয়াই হবে সরকার ও সরকারি দলের জন্য মঙ্গলজনক। তবে শুধু মেনে নেওয়া নয়, এসব মতামতের ওপর ভিত্তি করে আগামী দুই বছর সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। শুধু সরকার নয়, বিরোধী দলকেও সমান গুরুত্ব নিয়ে জরিপের মতামতকে গ্রহণ করতে হবে। দুঃখের বিষয়, সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর জরিপের সঙ্গ দ্বিমত পোষণ করে জানিয়েছেন, সরকারের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্য বেশি। আমরা এ বিষয়ে এখনো সরকারের অন্যান্য নীতিনির্ধারক এবং প্রধানমন্ত্রীর কোনো মন্তব্য শুনিনি। তবে তাঁর সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর টিভি ভাষণ শুনেছি। ওই ভাষণে ‘ব্যর্থতা যে একেবারে নেই তা বলব না’ এ রকম মন্তব্য ছিল। অর্থাৎ সরকার যে প্রথম আলোর জরিপকে খুব মূল্য দেবে, তা মনে হচ্ছে না।
সরকার তা প্রকাশ্যে না দিক, তাতে সমস্যা নেই। পৃথিবীর কোনো সরকার জনসমক্ষে তার ব্যর্থতা স্বীকার করে না। ওবামাকে ইরাক নিয়ে জিজ্ঞেস করুন, তিনি বলবেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে আক্রমণ চালিয়ে ঠিক কাজটিই করেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও তাই বিশ্ব সরকারব্যবস্থায় নতুন একটি নজির স্থাপন করতে হবে, তা বলছিনা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে জরিপের ফল নিয়ে আলাপ করলে, জরিপে যেসব বিষয়ে সরকার ভালো নম্বর পেয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে আরও ভালো করার অভিপ্রায় জন্মালে এবং যেসব ক্ষেত্রে নম্বর খারাপ এসেছে, সেসব ক্ষেত্রে যথাসাধ্য ভালো করার সিদ্ধান্ত নিলে আগামী নির্বাচনে দলটির জয়লাভ অসম্ভব নয়। সকারের অবস্থান সেই শিক্ষার্থীর মতো, যে হাফ ইয়ার্লিতে মোটামুটি ভালো করলেও প্রি-টেস্টে এসে দশটার মধ্যে সাতটা বিষয়েই খারাপ করেছে; এখন তাকে আদাজল খেয়ে না নামলে টেস্টে এবং এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া অসম্ভব।
আমি নিশ্চিত, সরকারের মন্ত্রীরা এবং নীতিনির্ধারকেরাও প্রকাশ্যে না হলেও একান্তে এই জরিপের ফলের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। তাঁরা টেলিভিশনের টক শো, খবরের কাগজের উপসম্পাদকীয়, অনলাইন ব্লগ অথবা বিরোধী দলের অভিযোগ-সমালোচনা উপেক্ষা ও অস্বীকার করতেই পারেন, কিন্তু জনকথাকে এড়িয়ে গেলে, নিজেদের পছন্দমতো হয়নি বলে ‘ভুল’ ও ‘বানোয়াট’ বলে উড়িয়ে দিলে বড় ভুল করবেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আওয়ামী লীগকে এক বিরাট সতর্কবার্তা দিয়েছে। একে শুধু ‘দলীয় কোন্দলের পরিণতি’ হিসেবে না দেখাই ভালো। এ নির্বাচনে সার্বিক জনরায়ের একটা প্রতিফলন পড়েছে—এটি সবাই বুঝতে পারে।
প্রথম আলোর জরিপ সরকারের যা ভালো, তাকে ভালো বলেছে, মন্দকে মন্দ বলেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রগতি ছিল ইতিবাচক এবং বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে বলে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন; কিন্তু এ-ও জানিয়েছেন, উন্নয়ন ও অর্থনীতি, আইনের শাসন, দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক—এসব ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সফলতা ছিল না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচুর ব্যর্থতা ছিল। ‘কেমন চলছে দেশ’—এ প্রশ্নে ৫৭ শতাংশ মানুষ বলছেন, দেশ ভুল পথে চলছে এবং সরকারের তিন বছরের কার্যক্রমে ৫২ শতাংশ মানুষ অসন্তুষ্ট। মোটা দাগে এটিকে সরকারের প্রতি অনাস্থা না হলেও আস্থার অভাব বলেই ধরে নেওয়া যায়। সরকারকে এ আস্থা এখন ফিরিয়ে আনতে হবে।
কিন্তু কীভাবে? জরিপের ফল খুঁটিয়ে পড়লে তা-ও বোঝা যায়। মন্ত্রিসভার অযোগ্য সদস্যদের বাদ দিয়ে যোগ্য লোককে নিয়ে আসতে হবে (যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে ওবায়দুল কাদের ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছেন), দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে হবে (শুধু মানুষের আয় বেড়েছে বলে এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার সাফাই গাইলে চলবে না), যোগাযোগ ও রেল চলাচলে গতিশীলতা আনতে হবে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়ে দুর্নীতিচিত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-অপহরণ—এসব বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে হবে, অঙ্গ-সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আরও গতিশীলতা আনতে হবে, দফায় দফায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান উন্নতি করতে হবে। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে, সেই আন্তরিকতা সব ক্ষেত্রে দেখাতে পারলে আগামী জরিপে ভালো নম্বর পাবে।
বিরোধী দলের প্রতিও মানুষ যে অসন্তুষ্ট, তা জরিপে অত্যন্ত পরিষ্কার। আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং সরকারের দৈনন্দিন সমালোচক, আবার একই সঙ্গে বিরোধী দলের (বা ইংরেজিতে যাকে ‘আন্ডারডগ’ অর্থাৎ ক্ষমতা-বৃত্তের বাইরের মানুষ বা সংগঠন বলে তাদের) প্রতি সহানভূতিশীল। তার পরও বিরোধী দলকে যে কম নম্বর দিয়েছে কোনো কোনো বিষয়ে, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গতবারের তুলনায় চার পয়েন্ট কম দিয়েছে, তাতে বিরোধী দলকেও এখন গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। এখন হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও এবং অন্যান্য ধ্বংসাত্মক কাজ করলে মানুষ তাদের থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেবে।
১৬ কোটির এই সম্পদহীন দেশের যেকোনো সরকারের জন্য দেশ পরিচালনা একটা কঠিন কাজ। বর্তমান সরকার সেই কঠিন কাজটি করছে। সব মানুষই চায়, সব সমস্যার সমাধান সরকার করবে। জনমতে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে। মানুষ সরকারকে সময় দিচ্ছে, কিন্তু তার পতনের ডাক দিচ্ছে না; বিরোধী দল প্রতিনিয়ত দিলেও। এই সময়, অর্থাৎ আগামী দুই বছর সরকারকে তাই ভালো ছাত্রের মতো নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে কাজে নামতে হবে। তাতে সরকার যদি জিপিএ-৫ পায়, সঙ্গে সঙ্গে দেশটাও তা পাবে। এর চেয়ে বড় প্রত্যাশা (এবং আশায় বুকবাঁধা মানুষ বলবে, প্রাপ্তি) আর কী হতে পারে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments