বিতরণব্যবস্থা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের উপযোগী নয়-গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়াবে নতুন সংযোগ by অরুণ কর্মকার

চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রেখেই নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত আগামী গ্রীষ্মে সংকট বাড়াবে। তা ছাড়া, বাড়তি চাপে বিতরণব্যবস্থার বিদ্যমান নাজুক অবস্থা প্রকট হয়ে উঠতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানিগুলোর আশঙ্কা। গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বাসাবাড়িতে নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ১৮ হাজার ৮৮৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও সংযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই শিল্পগুলোরই


দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা এক হাজার ৩৯৬ মেগাওয়াট। অবশ্য কোনো কার্যকারিতা না থাকলেও নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসানোর আগের শর্ত বহাল থাকছে। মন্ত্রণালয় ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সরকারি পরিকল্পনা শতভাগ বাস্তবায়িত হলেও আগামী গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান হবে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর সঙ্গে নতুন সংযোগের চাহিদা যুক্ত হলে তা আড়াই হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হতে পারে।
সূত্রগুলো জানায়, বিদ্যুতের বিদ্যমান বিতরণব্যবস্থা বেশ নাজুক। প্রায় সব বিতরণ লাইন ও উপকেন্দ্র স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতায় চলছে (অর্থাৎ এগুলো সবই ওভারলোডেড)। এই বিতরণব্যবস্থার ওপর আরও বাড়তি চাপ পড়লে তা বিদ্যুৎ বিতরণে প্রকট বিভ্রাট সৃষ্টি করবে।
চাহিদা ও সরবরাহ: বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ছিল সাত হাজার ৬১৩ মেগাওয়াট। আর প্রকৃত সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের মধ্যে।
আগামী এপ্রিল মাসে লোডশেডিংয়ের নির্ধারিত কর্মসূচি (ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্ট বা ডিএসএম) কার্যকর করার পরও সর্বোচ্চ চাহিদা হবে সাত হাজার ৫১৮ মেগাওয়াট। এ সময় উৎপাদনক্ষমতা আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সর্বোচ্চ উৎপাদন হবে ছয় হাজার মেগাওয়াট।
এই প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট ঘাটতির সঙ্গে শিল্প ও অন্যান্য গ্রাহকের নতুন সংযোগের ফলে আরও চাহিদা বাড়বে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট।
আরও আবেদন নেওয়া হবে: সরকার বিদ্যমান আবেদনকারী ১৮ হাজার ৮৮৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে যেমন সংযোগ দেবে, তেমনি আরও নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নতুন সংযোগের জন্য আবেদনও নেবে। তাই বিদ্যুতের সরবরাহ ক্রমাগতভাবে বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থাকেও বাড়তি বিদ্যুৎ বিতরণের উপযোগী করে তুলতে হবে।
শিল্পে বিদ্যমান গ্রাহকসংখ্যা দুই লাখ এক হাজার ৬৯৮। এসব শিল্পের জন্য ছয় হাজার ২১০ দশমিক ৩৯ মেগাওয়াট লোড বরাদ্দ রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ ব্যবহূত হয় এর চেয়ে অনেক কম। এর সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নতুন সংযোগ দেওয়ার পর চাহিদা আরও বাড়বে এক হাজার ৩৯৬ মেগাওয়াট।
গ্রামের বিতরণব্যবস্থা বেহাল: বিগত জোট সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে খেয়াল না দিয়ে অপ্রয়োজনে শত শত কিলোমিটার বিতরণ লাইন করেছে বিদ্যুতের খুঁটির ব্যবসার জন্য। আর বর্তমান সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন যে হারে বাড়িয়েছে, বিতরণব্যবস্থার দিকে সেভাবে নজর দেয়নি। ফলে বিতরণব্যবস্থা অনেকটাই নাজুক হয়ে পড়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি আরইবির অবস্থা বেশি নাজুক। বর্তমানে তাদের প্রায় ৯০ লাখ গ্রাহকের সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা তিন হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এই বিদ্যুৎ বিতরণ করাটাই সারা দেশে তাদের ৭০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীন প্রায় সব কটি উপকেন্দ্র ও বিতরণ লাইনের ক্ষমতার বাইরে।
এ প্রসঙ্গে আরইবির নির্বাহী পরিচালক বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ সমিতির বিতরণব্যবস্থা ওভারলোডেড; বিশেষ করে ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ যে সমিতিগুলোর আওতায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং আরও নতুন নতুন শিল্পে বিদ্যুৎ-সংযোগ চাওয়া হচ্ছে, সেগুলো এখনই পূর্ণ ক্ষমতারও ওপর দিয়ে চলছে।
আরইবি ছাড়াও ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ বিতরণ করে পিডিবি এবং পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। এর মধ্যে পিডিবির বিতরণব্যবস্থা যথেষ্ট নাজুক। অনেক স্থানে বিদ্যুতের খুঁটির পরিবর্তে বাঁশের ওপর দিয়ে গেছে তাদের বিতরণ লাইন।
ঢাকার অবস্থাও ভালো নয়: ঢাকার অন্যতম বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সোবহান বলেন, বর্তমানে তাঁদের কোম্পানির আওতাধীন এলাকায় গত প্রায় ২০ বছর ধরে বিতরণব্যবস্থার প্রয়োজনীয় উন্নয়ন হয়নি। অনেক স্থানে বিতরণ লাইন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে তাঁরা পাঁচটি নতুন উপকেন্দ্র স্থাপনসহ কতিপয় কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে এসব কাজ শেষ হবে। ফলে দুই বছর (২০১২ ও ২০১৩ সাল) ডিপিডিসির এলাকায় বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা হবে না।
তবে ডিপিডিসির আওতাধীন অনেক এলাকায় এখনো বৈদ্যুতিক খুঁটির পরিবর্তে বাঁশের খুঁটির ওপর দিয়ে বিতরণ লাইন দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এসব লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে।
ঢাকার অপর বিতরণ কোম্পানি ডেসকোর সমস্যা আবার অন্য রকম। তাদের আর্থিক সামর্থ্য ও উদ্যোগ থাকলেও গুলশান ও বনানী এলাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী উপকেন্দ্র স্থাপনের জন্য জায়গা পাচ্ছে না। এ কারণে বিদ্যমান উপকেন্দ্র ও লাইন ঝুঁকির মধ্য দিয়েই চলছে। এতে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহে বিভ্রাট দেখা দিচ্ছে। ডেসকোর নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কোনো রকমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। এভাবে আর বেশি দিন চালানো সম্ভব হবে না।

No comments

Powered by Blogger.