স্বচ্ছতা নৈতিকতা বজায় রেখেই শিখরে by মাহবুবুর রহমান
এ ধরনের প্রাজ্ঞজনদের কাছ থেকে আরও কিছু পাওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। তার চেষ্টাও লক্ষণীয় নয়। তিনি দেশের জন্য, দশের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ উদ্যোগী হলে তার কাছ থেকে আরও অনেক কিছু গ্রহণ করতে পারত এমন বড়মাপের মানুষ ছিলেন, এত বড় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের অধিপতি; কিন্তু আচরণে, কথায়, ব্যবহারে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। অহমিকা নেই, আত্মপ্রচারে বিমুখ, বিনয়ী_ স্যামসন চৌধুরী
সম্পর্কে এ সবই বলা যায়। এখন যারা বিভিন্ন চেম্বারের দায়িত্বে রয়েছেন, যারা শিল্প-বাণিজ্যের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত, তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে তার বয়সের অনেক পার্থক্য। কিন্তু সবার সঙ্গে মিশতেন এমনভাবে, যেন বহু পুরনো সহকর্মী কিংবা সমবয়সী। আমি আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের সভাপতি। এ সংগঠনে তিনি ছিলেন বোর্ড সদস্য। আমাদের কাজকর্মে তার সহযোগিতা-উপদেশ সর্বদা নিয়েছি। প্রতিটি সভা-সেমিনারে উপস্থিত থাকতেন। পরামর্শ মিলত প্রতিটি কাজে। সহ-সভাপতির একটি পদ শূন্য হলে কাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনাদের আপত্তি না হলে আমাকে নিতে পারেন। আমি তো বিস্ময়ে হতবাক। তাকে বলি, আমি যে সংগঠনের সভাপতি, সেখানে আপনি কী করে সহ-সভাপতি হবেন! সেই চিরপরিচিত হাসিমুখে তিনি বলেন, আপনি সংগঠন ভালো চালাচ্ছেন, সময় দিচ্ছেন। আমি তা পারব না।
তিনি সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। যাদের সঙ্গে কথা বলতেন তাদের হৃদয়-মন ছুঁয়ে যেতেন। মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন ঠিক তাই।
আমাদের দেশে স্যামসন এইচ চৌধুুরীর মতো আরও অনেক উদ্যোক্তার নাম করা যায়। কারও কারও অর্থর্-সম্পদ হয়তো তার চেয়েও বেশি। কিন্তু তিনি যে উচ্চ নৈতিক মান বজায় রেখেছেন দশকের পর দশক, তা ব্যতিক্রম। তিনি তিলে তিলে যেমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তেমনি সযত্নে তৈরি করেছেন নিজের ভাবমূর্তি। আমি অনেককে দেখেছি, সামান্য অবস্থা থেকে যারা বড় হয়েছেন তাদের অতিমাত্রায় হিসেবি স্বভাব থাকে। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তাই বলে ১০ টাকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়লে ১০০ টাকা দিতেন না। কিন্তু যদি ১ লাখ টাকা দেওয়ার দরকার হতো, তাতেও কার্পণ্য ছিল না। তিনি মেথোডিক্যাল ছিলেন; একই সঙ্গে ছিলেন উদার হৃদয়ের।
তার সঙ্গে অনেকবার সপরিবারে বিদেশ গিয়েছি। লতিফুর রহমান একাধিকবার ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এ ধরনের সফরে গল্পে-আড্ডায় মানুষ চেনা যায়। স্যামসন চৌধুরীর ছবি তোলার খুব শখ ছিল। নিজেও ভালো ছুবি তুলতেন। কুয়ালালামপুরে ওয়ার্ল্ড চেম্বার কংগ্রেসে তিনি ও বৌদি এবং আমি ও আমার স্ত্রীর ছবি তোলা হয়েছিল তারই আগ্রহে। এই বড়দিনে এ ছবি দিয়ে কেক পাঠিয়েছিলাম তার কাছে। চীনে আইসিসি কংগ্রেস থেকে হংকং হয়ে ফেরার সময় শপিং মলে বেড়াতে গেলে আমাদের কয়েকজনকে দামি ব্র্যান্ড জুতা কিনে দিয়েছিলেন। তিনি রুচিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন এবং সর্বদা তা বজায় রাখতেন।
তিনি শুধু শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েননি, সমাজকেও নাড়া দিতে পেরেছিলেন। তার সমকক্ষ কাউকে এখন দেখি না। অনেকের হয়তো তার চেয়ে বেশি অর্থ আছে। কিন্তু নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি, আন্তরিকতা, নৈতিক মানে তিনি অনন্য। প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের সময়ের লিজেন্ড। তার কাছে শুনেছি এগিয়ে যাওয়ার গল্প। কীভাবে বাধা জয় করেছেন, বলতেন। এ জন্য কখনও হীনম্মন্যতায় ভুগতেন না। কীভাবে নিজের কারখানার সিরাপ বিক্রি করেছেন সে গল্প শুনেছি তার কাছেই। শিল্প স্থাপনের উদ্যোগে অনেক সময় কষ্ট পেয়েছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সহায়তা মেলেনি। সরকার ও প্রশাসনের কেউ কথা দিয়ে কথা না রাখলে কষ্ট পেতেন। রাজনীতি নিয়ে কখনও আলোচনা করতেন না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে চাইতেন স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নতুন কী নীতি দরকার, কোথায় সংস্কার করতে হবে, বলতেন নির্ভয়ে। সরকারের কাছে তার প্রত্যাশা ছিল_ সহায়ক নীতি ও কৌশল ঠিক করে দাও, যেন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারে। সরকার অযথা ব্যবসায়িক কাজে হস্তক্ষেপ করলে কী সমস্যা তৈরি হয় সেটা জানতেন। তিনি সংগ্রাম করে সামনে এগিয়েছেন। সর্বদা চাইতেন, নতুন যারা এগিয়ে আসবে তাদের যেন বাধা কম মোকাবেলা করতে হয়। এতেই দেশের উন্নতি ঘটতে পারে। তার একটি বড় সাফল্য, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিজের মহৎ গুণাবলি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তাদের কাছে নিজের জীবনের কঠিন সময়ের কথা বলতেন। আমরা যেমন বন্ধুবৎসল একজন বড় ভাই পেয়েছি, যে কোনো প্রয়োজনে তার কাছে ছুটে যেতে পেরেছি, তেমনি তার সন্তানেরা সর্বদা পেয়েছে একজন আদর্শ পিতাকে। তাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। কাজ শিখিয়েছেন। মানুষকে সম্মান দিতে বলেছেন। মৃত্যুর আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে স্ত্রী কাছে গেলে সন্তানরা বলেন_ বাবা, মা এসেছেন তোমার কাছে। তিনি বলেছিলেন, তোমাদের মা সারাক্ষণ আমার সঙ্গে আছেন। পারিবারিক বন্ধনে তার ছিল গভীর আস্থা। এক ভবনে ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে থাকতেন। সকালে উঠতেন। অনেক সময় সন্তানেরা অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে শুনতেন, চেয়ারম্যান আগেই অফিসে চলে গেছেন।
তাকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ দায়িত্ব প্রদান ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি ২০টির মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাতেন। এর কোনো একটিতে কর ফাঁকির ঘটনা ঘটলে, কেউ ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে কিংবা ব্যবসায়িক অসততা ধরা পড়লে টিআইবি নিজেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। কিন্তু আমাদের সবার জন্য সৌভাগ্যের কথা যে, তিনি কখনও স্বচ্ছতার গণ্ডির বাইরে যাননি। তিনি বছরের পর বছর সর্বোচ্চ করদাতাদের তালিকায় ছিলেন। কারখানা করার জন্য তাকে কখনও ভূমিদস্যুতা করতে হয়নি। তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পণ্যের মান নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলার অবকাশ পায়নি। আমাদের চারপাশে অনেক প্রলোভনের ফাঁদ রয়েছে। কলুষিত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। এ কাজ সহজ ছিল না। কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছেন_ স্বচ্ছতা, নৈতিকতা বজায় রেখেই উন্নতির শিখরে পেঁৗছানো সম্ভব। তার বিকল্প আপাতত দেখি না।
মাহবুবুর রহমান :আইসিসি, বাংলাদেশ সভাপতি
তিনি সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন। যাদের সঙ্গে কথা বলতেন তাদের হৃদয়-মন ছুঁয়ে যেতেন। মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন ঠিক তাই।
আমাদের দেশে স্যামসন এইচ চৌধুুরীর মতো আরও অনেক উদ্যোক্তার নাম করা যায়। কারও কারও অর্থর্-সম্পদ হয়তো তার চেয়েও বেশি। কিন্তু তিনি যে উচ্চ নৈতিক মান বজায় রেখেছেন দশকের পর দশক, তা ব্যতিক্রম। তিনি তিলে তিলে যেমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তেমনি সযত্নে তৈরি করেছেন নিজের ভাবমূর্তি। আমি অনেককে দেখেছি, সামান্য অবস্থা থেকে যারা বড় হয়েছেন তাদের অতিমাত্রায় হিসেবি স্বভাব থাকে। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তাই বলে ১০ টাকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়লে ১০০ টাকা দিতেন না। কিন্তু যদি ১ লাখ টাকা দেওয়ার দরকার হতো, তাতেও কার্পণ্য ছিল না। তিনি মেথোডিক্যাল ছিলেন; একই সঙ্গে ছিলেন উদার হৃদয়ের।
তার সঙ্গে অনেকবার সপরিবারে বিদেশ গিয়েছি। লতিফুর রহমান একাধিকবার ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এ ধরনের সফরে গল্পে-আড্ডায় মানুষ চেনা যায়। স্যামসন চৌধুরীর ছবি তোলার খুব শখ ছিল। নিজেও ভালো ছুবি তুলতেন। কুয়ালালামপুরে ওয়ার্ল্ড চেম্বার কংগ্রেসে তিনি ও বৌদি এবং আমি ও আমার স্ত্রীর ছবি তোলা হয়েছিল তারই আগ্রহে। এই বড়দিনে এ ছবি দিয়ে কেক পাঠিয়েছিলাম তার কাছে। চীনে আইসিসি কংগ্রেস থেকে হংকং হয়ে ফেরার সময় শপিং মলে বেড়াতে গেলে আমাদের কয়েকজনকে দামি ব্র্যান্ড জুতা কিনে দিয়েছিলেন। তিনি রুচিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন এবং সর্বদা তা বজায় রাখতেন।
তিনি শুধু শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েননি, সমাজকেও নাড়া দিতে পেরেছিলেন। তার সমকক্ষ কাউকে এখন দেখি না। অনেকের হয়তো তার চেয়ে বেশি অর্থ আছে। কিন্তু নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি, আন্তরিকতা, নৈতিক মানে তিনি অনন্য। প্রকৃতপক্ষে তিনি আমাদের সময়ের লিজেন্ড। তার কাছে শুনেছি এগিয়ে যাওয়ার গল্প। কীভাবে বাধা জয় করেছেন, বলতেন। এ জন্য কখনও হীনম্মন্যতায় ভুগতেন না। কীভাবে নিজের কারখানার সিরাপ বিক্রি করেছেন সে গল্প শুনেছি তার কাছেই। শিল্প স্থাপনের উদ্যোগে অনেক সময় কষ্ট পেয়েছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সহায়তা মেলেনি। সরকার ও প্রশাসনের কেউ কথা দিয়ে কথা না রাখলে কষ্ট পেতেন। রাজনীতি নিয়ে কখনও আলোচনা করতেন না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে চাইতেন স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নতুন কী নীতি দরকার, কোথায় সংস্কার করতে হবে, বলতেন নির্ভয়ে। সরকারের কাছে তার প্রত্যাশা ছিল_ সহায়ক নীতি ও কৌশল ঠিক করে দাও, যেন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারে। সরকার অযথা ব্যবসায়িক কাজে হস্তক্ষেপ করলে কী সমস্যা তৈরি হয় সেটা জানতেন। তিনি সংগ্রাম করে সামনে এগিয়েছেন। সর্বদা চাইতেন, নতুন যারা এগিয়ে আসবে তাদের যেন বাধা কম মোকাবেলা করতে হয়। এতেই দেশের উন্নতি ঘটতে পারে। তার একটি বড় সাফল্য, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিজের মহৎ গুণাবলি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তাদের কাছে নিজের জীবনের কঠিন সময়ের কথা বলতেন। আমরা যেমন বন্ধুবৎসল একজন বড় ভাই পেয়েছি, যে কোনো প্রয়োজনে তার কাছে ছুটে যেতে পেরেছি, তেমনি তার সন্তানেরা সর্বদা পেয়েছে একজন আদর্শ পিতাকে। তাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। কাজ শিখিয়েছেন। মানুষকে সম্মান দিতে বলেছেন। মৃত্যুর আগে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে স্ত্রী কাছে গেলে সন্তানরা বলেন_ বাবা, মা এসেছেন তোমার কাছে। তিনি বলেছিলেন, তোমাদের মা সারাক্ষণ আমার সঙ্গে আছেন। পারিবারিক বন্ধনে তার ছিল গভীর আস্থা। এক ভবনে ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে থাকতেন। সকালে উঠতেন। অনেক সময় সন্তানেরা অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে শুনতেন, চেয়ারম্যান আগেই অফিসে চলে গেছেন।
তাকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ দায়িত্ব প্রদান ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি ২০টির মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাতেন। এর কোনো একটিতে কর ফাঁকির ঘটনা ঘটলে, কেউ ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে কিংবা ব্যবসায়িক অসততা ধরা পড়লে টিআইবি নিজেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। কিন্তু আমাদের সবার জন্য সৌভাগ্যের কথা যে, তিনি কখনও স্বচ্ছতার গণ্ডির বাইরে যাননি। তিনি বছরের পর বছর সর্বোচ্চ করদাতাদের তালিকায় ছিলেন। কারখানা করার জন্য তাকে কখনও ভূমিদস্যুতা করতে হয়নি। তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পণ্যের মান নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলার অবকাশ পায়নি। আমাদের চারপাশে অনেক প্রলোভনের ফাঁদ রয়েছে। কলুষিত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। এ কাজ সহজ ছিল না। কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছেন_ স্বচ্ছতা, নৈতিকতা বজায় রেখেই উন্নতির শিখরে পেঁৗছানো সম্ভব। তার বিকল্প আপাতত দেখি না।
মাহবুবুর রহমান :আইসিসি, বাংলাদেশ সভাপতি
No comments