আইন ব্যবস্থা ও আসমাদের স্বপ্নভঙ্গ by মোঃ আনোয়ার সোহেল

লোনিয়াল যুগের আইন ব্যবস্থার শিকলে বন্দি আমরা, আজও উদ্ধার হতে পারিনি সে শৃঙ্খল থেকে। এ কথা বহুল প্রচলিত যে, 'জীবনের জন্যই আইন, আইনের জন্য জীবন নয়'। তবু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিলক্ষিত হয় আইনের মারপ্যাঁচ আর যান্ত্রিকধারায় বৃত্তবন্দি জীবন। সমাজ ও সংসার জীবনের প্রপঞ্চ যতটা বৈচিত্র্যময় আইনগত প্রক্রিয়া তথা মামলা ব্যবস্থাপনা আরও জটিল। তাই তো আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে_ সুষ্ঠু সমাজ জীবন ও সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে কোনটি আজ


বেশি প্রয়োজন? যুক্তিসিদ্ধ আইন নাকি আইনসিদ্ধ যুক্তি? তারই প্রশ্ন আমরা সারাক্ষণ খুঁজে বেড়াই।শুক্রবার বিকেলে আমরা কয়েকজন আড্ড দেওয়ার রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে গিয়েছিলাম শেরেবাংলা নগর তথা সংসদ ভবন এবং এর সংলগ্ন জিয়ার সমাধি এলাকায়। সন্ধ্যা ৭টার পর আমরা যখন বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম তখন রাস্তার পাশে বানানো ভাপা পিঠা আমাদের আকর্ষণ করল। পিঠা খাওয়ার ফাঁকে ওই পিঠা বিক্রেতার প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। অভ্যাসবশত আমি তার খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম অর্থাৎ একটা ছোটখাটো ইন্টারভিউ বলা চলে।
ওই বিক্রেতা আসমা খালা জানালেন, তার বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনপুরে। ঢাকায় এসেছেন ২০০৮ সালের নভেম্বরে এক বান্ধবীর হাত ধরে। দু'সন্তানের জননী আসমা খালা (ছদ্মনাম) জানালেন ২০০৩ সালে তাদের পাশের গ্রামের সুস্থ-সবল যুবক আরমান মিয়ার সঙ্গে তার সমারোহে বিয়ে হয়। বিয়েতে আসমা খালার বাবা ১,৪০,০০০ টাকার আসবাব ৫৫,০০০ টাকার গয়নাগাটি এবং ছেলের ব্যবহারের জন্য ৭০,০০০ টাকার একটি চায়না হিরো মোটরবাইক উপঢৌকন দেন।
উল্লেখ্য, বিয়েতে মোহরানা ধার্য হয়েছিল ১,৫০,০০০ টাকা যার পুরোটাই অপরিশোধিত হিসেবে বর্তমান। বিয়ের পর ভালোই চলছিল তার সংসার। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে তার কোলজুড়ে আসে কন্যা যাহেরা এবং ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে তার পুত্রসন্তান আজিম। ২০০৬ সালের শেষ দিকে এসে তার সুখের স্রোতে ভাটার টান দেখা দেয় অর্থাৎ তার স্বামীর ব্যবসার কয়েকটি বড় রকমের চালান ফেরত আসে। ব্যবসায়িক এ ধস বহু চেষ্টা করেও কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হন তিনি। এক সময় তার সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে দেখা দেয় ভাঙন। শুরু হয় পারিবারিক কলহ আর ঝগড়াঝাটি। আসমা খালা মাঝে মাঝে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই সাংসারিক খরচ নির্বাহের জন্য বাবা ও ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে আনতেন। তবুও যেন কিছুতেই কিছু হয়ে উঠছিল না। আরমান মিয়াও হয়ে পড়ছিলেন তার স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি অমনোযোগী। এক পর্যায়ে হয়ে পড়েন নেশাগ্রস্ত।
অবশেষে শোচনীয় অবস্থায় আসমা খালা ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে আশ্রয় নেন তার বাবার বাড়ি। এদিকে দিন যায় মাস আসে_ আরমান মিয়া কোনোভাবেই গুছিয়ে উঠতে পারছিলেন না। গ্রামের মানুষের শলা-পরামর্শে একদিন আসমা খালার বাবা ও ভাইয়েুরা গিয়ে হাজির হলেন নেত্রকোনা আদালতে এবং পরামর্শ করেন একজন আইনজীবীর সঙ্গে। পরে ওই আইনজীবীর মাধ্যমে আসমা খালা বাদী হয়ে তার স্বামী আরমান মিয়ার বিরুদ্ধে নেত্রকোনা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করেন এবং কয়েক মাস পর ঢাকায় এসে পিঠা বানানোর কাজ শুরু করেন। এখনও প্রতি মাসে তিনি আদালতে হাজির হন।
আসমা খালার মতো আরও অনেক ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীর কথা আমাদের অজানা রয়েছে। আমার ছোট এ হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে আসমা খালার এ দুঃখ-বঞ্চনার কাহিনী। আর এভাবেই তিনি স্বপ্ন দেখছেন নতুন একটি সোনালি দিনের।
আসমা খালার প্রতীক্ষার কষ্টগুলো আমাকেও ছুঁয়েছে। তাইতো আমার ভাবনাগুলো নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে_
ষ যৌতুক নিরোধ আইনে আসমা খালা তার অধিকার ফিরে পাবে কি অর্থাৎ তার সোনালি ভোরের প্রত্যাশা পূরণ হবে কি?
ষ তার এই স্বপ্ন কি নিছক একটি কল্পনা বিলাস নাকি যথাযথ পদক্ষেপ?
ষ অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাকে কতদিন প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হবে?
ষ আরমান মিয়ার জন্যই বা আদালতের কী প্রতিকার রয়েছে?

No comments

Powered by Blogger.