জোনভিত্তিক ফসল উৎপাদন মানচিত্র ও ভবিষ্যতের শস্যবিন্যাস by এ এম এম শওকত আলী
গত বছর ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ (বাকৃগপ) কোন অঞ্চলে কী ফসল উৎপাদন করা উচিত হবে তার অঞ্চলভিত্তিক মানচিত্র প্রণয়ন করেছে। এ থেকে ভবিষ্যতের শস্যবিন্যাসের কিছু ধারণা পাওয়া যায়। জানা যায়, এসব মানচিত্র প্রণয়নের জন্য কৃষিমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ধরনের মানচিত্র প্রণয়নের পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি রয়েছে। এসব মানচিত্র বাস্তবে ব্যবহার করার সুফলের মধ্যে রয়েছে (এক) উৎপাদন উপযোগী ভূমি ও পানিসম্পদের সুষম ব্যবহার, (দুই)
ভূমি উর্বরতার সুরক্ষা এবং (তিন) পরিবেশ সংরক্ষণ। বাংলাদেশের ভূমির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে : (ক) পানিসম্পদের অসম উৎস, (খ) আবহাওয়ার ভিন্নতা এবং বন্যা, খরা, সাইক্লোন, জলাবদ্ধতাসহ জমি ও পানির লবণাক্ততা। এ ছাড়া আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবের তীব্রতা অঞ্চলভেদে ভিন্নতর হওয়ার আশঙ্কা, যা বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ করেছেন।
উপযুক্ত ফসল উৎপাদনের জোনভিত্তিক মানচিত্র প্রণয়নের অন্তর্নিহিত ধারণা হলো বিদ্যমান ফসল বিন্যাস অবৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানসম্মত নয়। বাস্তবেই তাই। একই সঙ্গে এ কথাও বলা সম্ভব যে কৃষকরা বাধ্য হয়ে এ ধরনের উৎপাদনে লিপ্ত হয়। অর্থাৎ তারা যা বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, সে পথটাই বেছে নেয়। অবশ্য বিভিন্ন সময়ের সরকারও এ জন্য দায়ী, সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না। সব সরকারই চেষ্টা করে অধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। অতীতের সেই গোলা ভরা ধানের বিষয়টি আর সত্য নয়। এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত করাও যাবে না। কারণ বর্তমানে দেশে প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা দিন আনে দিন খায় শ্রেণীভুক্ত। বাসস্থানের আয়তন এতই ক্ষুদ্র যে গোলা করা সম্ভব নয়। সব সরকারের বাধ্যবাধকতা ছিল অধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। বের হবে ভুখা মিছিল। সরকারের পতন হবে। এটা হয়েও ছিল পঞ্চাশের দশকে। এ ধরনের আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে হয়তো যে অঞ্চল বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমন ফসলের উপযোগী, সেখানে গভীর নলকূল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কৃষকদের বাধ্যবাধকতা হলো_তাদের বাঁচতে হবে। বসতবাড়ি পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য তারা যেকোনো জায়গায় ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করে।
ষাটের দশকে ঠাকুরগাঁও গভীর নলকূপ প্রকল্প ওই সময়ের সরকার চালু করে। দাতারা এর জন্য সাহায্য করে। বাস্তবায়িত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ওয়াটার এবং পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ইপিওয়াপদা)। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বসূরি। ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত ব্যবহারের কুপ্রভাব পরবর্তী সময়ে তীব্রতর হয়। কারণ যেখানে সেখানে অগভীর নলকূপের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। যত দিন এ বিষয়টি বিএডিসির নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল তত দিন এর জন্য নির্ধারিত দূরত্ব পালিত হতো। অর্থাৎ বিভিন্ন নলকূপের দূরত্বসহ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য কী ধরনের নলকূপ উপযোগী হবে সে বিষয়টি দেখা হতো। গভীর ও অগভীর নলকূপের বেসরকারিকরণের মাধ্যমে সমস্যা অধিকতর ঘনীভূত হয়। আশির দশকে এ নিয়ে বিএডিসিসহ অন্যরাও সরকারকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৯৮৫ সালে এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনও প্রণীত হয়। কিন্তু কিছু অনভিজ্ঞ নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে দাতাদের চাপের মুখে ওই সময়ের সরকার নতিস্বীকার করে। এ কারণেই ওই সময়ের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। বর্তমানে পানি বিশেষজ্ঞরা ফের সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। সরকার কী করছে?
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর কিছু প্রতিফলন পাওয়া যায় ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। এ পরিকল্পনায় ভূ-উপরিস্থিত পানির অধিকতর ব্যবহারসহ উত্তরাঞ্চলের জমিতে ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর বোরো ফসলের পরিবর্তে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমন ফসল উৎপাদনের কৌশল অবলম্বন করার কথা রয়েছে। বাকৃগপের জোনভিত্তিক উপযোগী ফসল বাস্তবায়নের প্রথম সোপান। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী বাস্তবায়ন পন্থা বলা না হলেও জোনভিত্তিক উপযোগী ফসল মানচিত্রে কিছু নির্দেশনা দেখা যায়। এসব নির্দেশনা আলোচনার দাবি রাখে।
প্রথমে কৃষি উপকরণে ভর্তুকির কৌশলের কথা রয়েছে। সুপারিশ রয়েছে যে ভর্তুকির সেসব কৃষককেই দিতে হবে, যারা জোনভিত্তিক মানচিত্র অনুসরণ করে উপযোগী ফসল উৎপাদন করবে। যারা করবে না তারা ভর্তুকি পাবে না। এটা খু্বই সাধারণ গোছের সুপারিশ। এ সুপারিশ বাস্তবায়নে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এক. রাজনৈতিক ঝুঁকি। যেসব কৃষক প্রণীত ফসল মানচিত্র অনুসরণ না করে ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি হবে বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় আচরণ। এটা সংবিধানসম্মত হবে না। দ্বিতীয়, সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি হবে। কারণ এর ফলে উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পাবে, যা হবে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। উৎপাদন ঘাটতি পূরণে সরকার খাদ্যশস্য আমদানি করতে বাধ্য হবে। তৃতীয়, সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাবে, যা ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষরা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। সার্বিক বিবেচনায় এ ধরনের সুপারিশ রাজনৈতিক বা সামাজিক দৃষ্টিকোণে গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রতিবেদনের দ্বিতীয় নীতি-সংক্রান্ত কৌশল হলো কৃষি ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি। এর ফলে কৃষকরা সহজেই কৃষি উপকরণ ক্রয় করতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে বর্তমানে কৃষি উপকরণের জন্য ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টিরও গবেষকরা সমালোচনা করছেন। তাঁদের মতে, প্রকৃত কৃষকরা ভর্তুকি পাচ্ছে না। অর্থাৎ সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। তৃতীয় বিষয়টি কৃষকদের উপকরণ সহায়তা কার্ডসংক্রান্ত। এ কার্ড কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০০৯ সালে প্রণয়ন ও বিতরণ করেছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিল। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত কৃষক যেন ভর্তুকি সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। ওই সময়ের কোনো একসময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেকোনো কৃষক মাত্র ১০ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে নিজ নামে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। জানা যায়, ২০০৯ সালে ডিজেল ভর্তুকি এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কৃষকদের দেওয়া হয়েছিল। ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টির সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি মূল্যায়নে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা সরকারের জন্য বিব্রতকর।
বাকৃগপের জোনভিত্তিক মানচিত্রের প্রতিবেদনে ফলাফল-সংক্রান্ত বিষয়ের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করা হয়। এটা না করে দাবি পরিত্যাগ বা Disclaimer করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত কথাবার্তা প্রতিবেদনের গুণাগুণ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বলা হয়েছে যে প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত ১৯৬৫-৭৩ সালের। অর্থাৎ চার দশকেরও বেশি পুরনো, এর মধ্যে কৃষিজমির বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হওয়াই স্বাভাবিক। এককথায় স্বীকার করা হয়েছে যে গবেষণালব্ধ ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আরো একটি সীমাবদ্ধতা যোগ করা যায়। তা হলো, ভূমি সম্পদ উর্বরতা প্রতিষ্ঠান বা এসআরডিআই সম্প্রতি ২০০টি উপজেলার কৃষিজমিসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি হালনাগাদ করেছে। এ তথ্যাদি প্রতিবেদনে স্থান পায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা অন্য একটি সীমাবদ্ধতার বিষয় অকপটে উল্লেখ করেছেন। তা হলো, প্রতিবেদনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলি বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে এটা করা হবে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ভবিষ্যতে কৃষকদের জোনভিত্তিক মানচিত্র অনুযায়ী ফসল উৎপাদনে আগ্রহী করার জন্য সম্প্রসারণমূলক উদ্বুদ্ধকরণে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা প্রয়োজন, প্রতিবেদনের আসল গুণ হলো, এই সর্বপ্রথম জোনভিত্তিক উপযুক্ত ফসল উৎপাদনের রূপরেখার বিষয়টি। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা না করে ফলাফল বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সাবধানবাণী দিয়েছে।
উপযুক্ত সীমাবদ্ধতার বিষয় ছাড়াও এর গ্রহণযোগ্যতার জন্য আরো কিছু তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ প্রয়োজন হবে। এক. ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার রোধে বিএডিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের এ-সংক্রান্ত জোনভিত্তিক তথ্যের ব্যবহার। এর ফলে পানিসম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এ ছাড়া রয়েছে সরকারের দক্ষিণাঞ্চলে অধিক ফসল উৎপাদনের কিছু প্রকল্প। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক সার উন্নয়ন কেন্দ্র (আইএফডিসি) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। অন্য একটি প্রকল্প ময়মনসিংহসহ ২২টি উপকূলীয় জেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার সম্প্রসারিত হবে। এর ফলাফল কী?
গুটি ইউরিয়া একটি সফল ও স্বীকৃত প্রযুক্তি। আলোচ্য প্রতিবেদনে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। পক্ষান্তরে সদ্য অনুমোদিত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গুটি ইউরিয়া ব্যবহার অধিকতর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার ব্যবহার করে সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টিও পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। জোনভিত্তিক উপযোগী ফসল চিহ্নিত করার জন্য একটি বৃহত্তর চিত্র (Larger Picture) প্রয়োজন। এ বিষয়ে আরো মাঠভিত্তিক তথ্য প্রয়োজন। কিভাবে করা হবে, কত দিন প্রয়োজন_এসব বিষয় নির্ধারণ করাই হবে এখন প্রথম কাজ। তবে মাঠ পর্যায়ের প্রকল্পভিত্তিক তথ্যাদির ব্যবহার করাও প্রয়োজন হবে, অন্যথায় পরবর্তী নিরীক্ষা হবে সময়ক্ষেপণ।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments