চারদিক-বুলেন কোল হাজরা

কালটা ভালোই ছিল, রোদ ছিল, হালকা হাওয়াও ছিল। কিন্তু দুপুর পেরুতেই আবহাওয়া পাল্টে গেল। আকাশটা গোমরামুখো, কালো মেঘে লেপ্টে গেল। এর মধ্যে বের হব কি হব না, এই নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র এলাকায় কিছু কোল আদিবাসীদের বাস। আমাদের উদ্দেশ্য সেসব গ্রামে যাওয়া, ওরা কীভাবে বেঁচে আছে তা দেখা। অবশেষে প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি দিলু ভাই আর আমি বেরিয়ে পড়লাম সে উদ্দেশে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য থামতে


হলো পথেই। পথ থেকে মোটরবাইক ঘুরিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা পাড়ায়, আশ্রয় নিলাম একটা রসুইঘরে।
কী আশ্চর্য! একেই বলে বিধাতার বিধান। আমরা যে কোল আদিবাসীদের সন্ধানে চলেছি, রসুইঘরে বসা একজনের কাছে জানতে পারলাম এটাই একটা কোলপাড়া। গ্রামের নাম বিল বৈলঠা। মাত্র ১২ ঘর কোল আদিবাসীদের নিয়ে পাড়াটা। বৃষ্টির জন্য ওদের কাছে একটু আশ্রয় চাইলাম। ওরা আমাদের দিকে একটা কাঠের পিঁড়ি আর একটা জলচৌকি এগিয়ে দিলেন। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে কালিমেঘের লেপ। মনে হচ্ছে এ বছর বুঝি আর বৃষ্টি ছাড়বে না। রসুইঘরের দুই দিকই খোলা। বৃষ্টির ঝাপটা এসে মাঝেমধ্যে ভিজিয়ে দিচ্ছে। চালের ফুটো টিন দিয়েও জায়গায় জায়গায় জল গড়িয়ে পড়ছে। আমরা সাবধানে সেসব জলপড়া জায়গা থেকে কোনোমতে গা বাঁচিয়ে বসে আছি। বড়জোর ছয় হাত বাই সাত হাত হবে ঘরখানা। তার ভেতর বসে আছি আমরা জনা ছয়েক লোক আর পাঁচ শিশু। আমরা দুজন ছাড়া আর সবাই কোল আদিবাসী। বাকি বড় চারজনের মধ্যে মাত্র একজন পুরুষ, অন্য তিনজনের দুজন নারী ও একজন কিশোরী। নারীদের নাম কল্পনা মুরমু ও রূপালী হাজরা। কোল পুরুষটির বয়স আনুমানিক ৫০। তাঁর কাছে নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘মিন্দি হাজরা।’
দিলু ভাই বলে উঠলেন, ‘শুধু হাজরা বুললেন কেন বে? বুলেন কোল হাজরা। না হৈলে আমার দাদা বুঝবে ক্যামতে রে যে তু কোল?’
মিন্দি হাজরা একটু হেসে বললেন, ‘আমরা আর এখন পদবি বলতে গেলে কোল বলি না।’
দিলু ভাই বলে উঠলেন, ‘তাইলে তু সান্তাল (সাঁওতাল)?’ দিলু ভাই এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘বুঝলেন দাদা, কেউ আর এখন কোল থাকতে চাইছে না। কারও পদবির সঙ্গে আপনি যদি কোল না দেখেন, তাহলে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে সে কোল না সাঁওতাল? সাঁওতালরাও একই পদবি ব্যবহার করে। ওদের মধ্যেও হাজরা, মুরমু আছে।’
মিন্দি হাজরাও স্বীকার করলেন সে কথা। তাই আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘মিন্দি কোল হাজরা। হৈছে?’
আসলে কোল আর সাঁওতালদের চেহারা ও গায়ের রঙের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। গায়ের রং কালো, ঠোঁট দুটো হয়তো সাঁওতালদের একটু পুরু। পোশাকও প্রায় একই রকম, কিশোরীরা পরে সালোয়ার, কামিজ, ওড়না। বড় মেয়েরা পরে শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট। তবে বেশির ভাগ বয়স্ক নারী ব্লাউজ পরে না। মেয়েরা হাতে চুড়ি ও পায়ে রুপার মল পরে। চুলে ফিতে বাঁধে। বিবাহিতদের কপালে সিঁদুরের টিপ ও হাতে সাদা শাঁখাও দেখা যায়। তার মানে, কোলরা এখনো সনাতন ধর্মাবলম্বী। সাঁওতালদের বেশির ভাগই খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। কোলদের দাবি, এখনো তারা নিজ ধর্মে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তবে এখন কেউ কেউ বাঙালি হিন্দু পরিবারে বিয়ে করছে, বিশেষ করে বাঙালি ঘর থেকে তারা মেয়ে আনছে। বাঙালি হিন্দুদের কর্মকার ও রায় গোত্রের সঙ্গেই তাদের বিশেষ মিলমিশ। তারা কোলদের ঘরে এসে কোলদের জীবনধারা গ্রহণ করছে। এমনকি এখন কোলদের সঙ্গে মাহাতো ও পাহান আদিবাসীদেরও বিয়ে হচ্ছে। মিন্দি হাজরা লুঙ্গি ও গায়ে একটা ফুল শার্ট পরে বসেছিলেন। কোল পুরুষেরা সাদা থানকাপড় বা ধুতিও পরে বলে জানালেন।
পাশে বসে এক কিশোরী ও এক কোল নারী চমৎকার নকশি কাঁথা সেলাই করছেন। লাল কাপড়ের ওপর সাদা সুতার কারুকাজ। কোল নারীর নাম জানা গেল কল্পনা মুরমু। এখানেও সেই একই বিভ্রাট। মুরমু পদবির সঙ্গে কোল শব্দটা তিনি এড়িয়ে গেলেন। দেখে মনে হলো, কত আর বয়স হবে? বড়জোড় উনিশ-বিশ। আলাপে আলাপে জানা গেল, তাঁর বাপের বাড়ি রহনপুরের নুনগোলা গ্রামে। সেখানে প্রায় ৩০টি কোল পরিবার থাকে। বাপের বাড়িতে তাঁর লেখাপড়া বেশ ভালোই চলছিল। ক্লাস নাইনে পড়তেন। কিন্তু সে বয়সেই হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর লেখাপড়া চালানো সম্ভব হয়নি।
এ পাড়ায় তিনিই সবচেয়ে শিক্ষিত নারী। এ নিয়ে তিনি একটু গর্ব করতেই পারেন। দিলু ভাই বললেন, ‘কোলরা আসলেই পেছনে পড়ে আছে। কেউ সহজে স্কুলে যেতে চায় না। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে তো স্কুল পাঠায়ই না, মেয়েরা বড় হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা বাপের ঘরে সংসারের কাজেই বেশি সাহায্য করে, মাঠের কাজও করে। কোলদের মধ্যে গত ২০০৮ সালে প্রথম এসএসসি পাস করেছে একটা ছেলে, নাম নির্মল কোল সরেন।’
মৃত্যুঞ্জয় রায়

No comments

Powered by Blogger.