পেশার নতুন ভুবন

রাপা প্লাজার তিন-চার তলা জুড়ে বসেছে নানা পণ্যের মেলা । ১৬৮টি স্টলে নিজেদের হাতে তৈরি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দেশের ৬৪টি জেলার ২০০ প্রান্তিক নারী। মনজুড়ে স্বপ্ন তাদের আত্মনির্ভরশীলতার। শক্তি অর্জনের পাশাপাশি বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা। তাদের এই স্বপ্ন পূরণের পথ তৈরি করার নানা বিষয় জানাচ্ছেন মাশরেখা মনা চোখ বিস্ফারিত হওয়ার মতো ঘটনাই বটে! পুরো তিন-চার তলা জুড়ে যেন এক মহাযজ্ঞ! আমি তো এখনও ভাবতে পারি না


আমার নিজের হাতে তৈরি পণ্য আমি নিজেই বিক্রি করছি, তাও আবার রাপা প্লাজার মত মার্কেটে! এখন সত্যি সত্যি নিজেকে ব্যবসায়ী মনে হয়। মনে হয় আমি এবার ভালো ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারব। উচ্ছ্বাসে আবেগে একটানে কথাগুলো বলে থামলেন শহীদা ইসলাম। বাগেরহাট থেকে এসেছেন তিনি। বললেন আমাদের সৃজনশীল জগৎটাকে সবার কাছে তুলে ধরতে 'জয়িতা'র কাছে কৃতজ্ঞ।
জয়িতার যাত্রা
বাংলার নারীদের সৃজনীশক্তি ও প্রতিভাকে পুঁজি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক সুযোগ্য ক্ষেত্র 'জয়িতা'। নারীর অর্থনৈতিক উন্নতিতে বিশেষ করে তৃণমূল নারীদের উন্নয়নে দূরীভূত হোক সব বৈষম্য, মূল্যায়ন হোক তাদের কাজ_ এ উদ্দেশ্যে জয়িতার যাত্রা। সিও, জেডআই ফারুকের মুখ থেকে জানা যাক জয়িতা সম্পর্কে। জয়িতার যাত্রা শুরু গত বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে। এখানে দেশের ৬৪ জেলার ১৮২টি নারী সমিতির ১৮৪টি স্টল আছে। ২০০ নারী স্টলের মালিক বা সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করছে। জয়িতা প্রকল্পের মাধ্যমে এ দেশের দরিদ্র নারীদের একটা বড় সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে সরকার। এখানে রয়েছে নারীদের হস্তশিল্পজাত পণ্য, প্রত্যেক এলাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার, নকশিকাঁথা, শাড়ি, নানা রকম পোশাক ইত্যাদি। প্রতিটি স্টল থেকে মাসে সব খরচসহ সার্ভিস চার্জ ৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। আর যে মেয়েরা সেলস গার্লের কাজ করবে তাদেরও ৫ হাজার টাকা মাসে দিতে হবে_ স্টল মালিকদের এমনই নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরের মেয়েদের থাকার জন্য মহিলা অধিদফতর থেকে লালমাটিয়া মহিলা হোস্টেল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। হোস্টেলে মাসে থাকা খরচ বাবদ এক হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে এবং খাবার নিজেদের। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জয়িতা খোলা থাকে এবং এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। জয়িতার অবস্থান ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার রাপা প্লাজায়। জেড আই ফারুক জানান, এটি মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের তিন বছরের একটি প্রজেক্ট। তিন বছর পর এ প্রজেক্ট স্থায়ী করে প্রত্যেককে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এখানে উৎসব হবে প্রতিটি দিবসের। স্বাধীনতা উৎসব, পিঠা উৎসব, পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইন্স ডেসহ সব ধরনের উৎসব।এ জন্য একটি গ্যালারিও তৈরি করা হয়েছে। জয়িতা খুব শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলছে। প্রতিটি নারী খুব আনন্দের সঙ্গে কাজ করছে। বিক্রিও হচ্ছে। ক্রেতা আসছেন। তবে প্রচারটা কম। অনেক প্রচারেই প্রসার হবে জয়িতার। সে প্রসারে জয়িতার প্রতিটি নারী পেঁৗছে যাবে সাফল্যের শীর্ষে_ এমনটাই মনে করেন জেডআই ফারুক।
আশার আলো
জয়িতাদের হাতের স্পর্শে, রঙের স্পর্শে জীবন সাজবে এবার আপন সংস্কৃতির সাজে। এভাবে বললেন মাদারীপুর থেকে আসা গোলাবাড়ী মহিলা কল্যাণ সমিতির সেলিনা আকতার। অ-১৪ তার স্টলের নম্বর। অ-১৪তে পাওয়া যাচ্ছে তাদের সমিতির কারচুপির কাজ করা শাড়ি, থ্রিপিসসহ অনেক কিছু। এমব্রয়ডারি, বল্গক, বাটিক, নকশির কাজ, এপলিক ইত্যাদি কাজ করা শাড়ি, থ্রিপিস, ফতোয়া, পাঞ্জাবি, বেড কভার, সোফার কভার ইত্যাদি। সেলিনা আক্তার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, জয়িতাতে আসতে পেরে আমরা খুবই খুশি। ১৬ ডিসেম্বর মেলা ছিল তিনদিন। ওই তিনদিন অনেক বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া মোটামুটি বিক্রি ও লাভ হচ্ছে। সেলিনা আকতার বলেন, আগে পণ্য ঢাকার লোকরা আমাদের কাছ থেকে কম দামে কিনে এনে অনেক দামে বিক্রি করত। এতে আমরা পরিশ্রম অনুযায়ী আমাদের প্রাপ্য পেতাম না। কিন্তু জয়িতাতে স্টল দিয়ে সরাসরি আমাদের নিজের হাতে বানানো পণ্য বিক্রি করতে পারছি। এতে আমরা লাভবান হচ্ছি এবং মনের দিক থেকেও শান্তি পাচ্ছি।
ধানমণ্ডি-২৭-এর রাপা পল্গাজার তৃতীয় ও চতুর্থ ফ্লোর নিয়ে জয়িতা। এখানের যাবতীয় ডেকোরেশন মহিলা অধিদফতর থেকে করা। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জয়িতা খোলা থাকে। স্টল চালাচ্ছেন মালিক নিজে। আবার অনেক স্টল চালাচ্ছেন সেলসম্যানরা। নতুন শুরু হওয়ায় বিক্রি মোটামুটি হচ্ছে। লাভও মোটামুটি। তবে সবাই আশাবাদী, জয়িতা ভালো চলবে।
ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার সুযোগ
বেগম আয়শা বুলবুল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিশারী মহিলা উন্নয়ন সংস্থা থেকে এসেছেন। তার স্টল নম্বর অ-৮৪। আয়শা বুলবুল জানান, এখন তারা জয়িতার মাধ্যমে সরাসরি তাদের পণ্য ক্রেতাদের দিতে পারছেন। এতে তারা তাদের পণ্যের চাহিদা বুঝতে পারছেন, কোথায় ত্রুটি তাও বুঝতে পারছেন। বললেন সরকার যদি এখানে আসার সুযোগ করে না দিত তাহলে রাপা পল্গাজার মতো মার্কেটে দোকান নিয়ে পণ্য বিক্রি করার চিন্তাই করতে পারতাম না। এখন পণ্য বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে অর্ডারও পাচ্ছি। ব্যবসায় অভিজ্ঞতা বাড়ছে আমাদের। তবে জয়িতা প্রকল্প মাত্র তিন বছরের জন্য, এতে তিন বছর পর জয়িতার আত্মনির্ভরশীল নারীরা আবার বেকার হয়ে যাবে এটা চিন্তার বিষয়।
নাটোরের মিসেস হেলেনা। তার স্টল নম্বর ঋ-৪। তিনি হাতের তৈরি আচার, কাঁচা গোল্লা এবং ভর্তা থেকে পোলাও-মাংসসহ সবকিছু দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন। হেলেনা জানান, এখানে অনেক নির্যাতিত নারী কাজ করেন। আর জয়িতার এ অবলম্বনে তারা থাকতে চান। তিন বছর পর তাদের ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই। অনেকেই দেশে তাদের সমিতি থেকে লোন নিয়ে জয়িতাতে স্টল নিয়েছেন এবং এখানের আয় দিয়ে ঋণ শোধ করে নিজে চলবেন ও ভবিষ্যতের সঞ্চয় করবেন। তাই জয়িতার দীর্ঘ-স্থায়িত্ব কামনা করেন তারা।
রাঙামাটির বনশ্রী নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কনকন চাকমার স্টল নম্বর অ-৩। স্টল চালাচ্ছেন বোন মিনিকা চাকমা। তাদের এখানে পাওয়া যাচ্ছে উপজাতীয় সব পণ্য। প্রচার কম থাকায় এখনও ঢাকার অনেকেই জয়িতার খবর জানতে পারেনি, মিনিকা এটা মনে করেন। ক্রেতাদের জয়িতার প্রতি অনেক আকর্ষণ রয়েছে। কারণ জয়িতাতে সব জিনিসের দাম কম। অনেক ক্রেতা বাইরে পণ্যের যাচাই করেই এখানে আসছেন, এটা অনেক ক্রেতাই তাকে বলেছেন।
বাগেরহাটের মহিলা উন্নয়ন সমিতির শাহীদা ইসলাম। পাথর, মেটালসহ যাবতীয় গয়না দিয়ে সাজিয়েছেন তার স্টল। জানালেন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করতে এতটুকু ক্লান্তি বোধ করছেন না তিনি। নিরাপত্তা আছে অনেক বেশি। জয়িতার নারীদের দেখলে মনে হয় না আমাদের দেশে কোনো নির্যাতিত মেয়ে আছে। তবে অনেক মেয়েই আছে, যারা নিজেরা অনেক কষ্টের পর আত্মনির্ভরশীল হওয়ার তাগিদে এখানে এসেছেন। এটি তাদের স্বামী বা পরিবার মেনে নিচ্ছে না। তারপরও তারা এখানে এসেছে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তাই তারা চান জয়িতার আশ্রয়ে সারা জীবন থাকতে এবং নিজেরা পরিশ্রম করে আত্মনির্ভরশীল হতে।
কিছু সমস্যা
অনেক পাওয়ার মধ্যেও রয়েছে নানা হতাশা। অনেকেই জানান, আগে তাদের বলা হয়েছে সবকিছু বিক্রি করতে পারবে, কিন্তু এখন সবকিছু বিক্রি করা যাচ্ছে না। ৫ জন মেয়ে আছেন, যারা সব সময় তদারকি করেন, এটা অনেক সমস্যার। আর স্টলগুলোর জায়গা এত কম যে, স্টলে পণ্য সাজানো যায় না ঠিকভাবে। মাসে ৫ হাজার টাকা দেওয়া একটু সমস্যা হচ্ছে। প্রথম প্রথম, তাই বিক্রি বেশি হচ্ছে না। এক বছর পর থেকে ৫ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ নিলে ভালো হয়_ অনেকেই বলেন। ঢাকার বাইরের সব মেয়ে মহিলা অধিদফতরের হোস্টেলে সিট পায় না। সেলস গার্লদের বেতন যেন মালিকরা পুরোটা দেন_ এটাও তাদের দাবি। জয়িতা তিন বছর মেয়াদে শেষ না হয়ে যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়_ এটা ১৮৪টি স্টলের প্রত্যেকের চাওয়া। কারণ যেসব নির্যাতিত মেয়ে পাহাড় সমান কষ্ট সহ্য করে ঋণ নিয়ে জয়িতাতে স্টল দিয়েছেন তারা জয়িতাতে ব্যবসা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান ।

No comments

Powered by Blogger.