সিটি করপোরেশনের গাড়ি ও জনবল বিএনপির প্রচারণায়! by একরামুল হক
বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চার দলের রোডমার্চ ও জনসভার কাজে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গাড়ি ও জনবল ব্যবহার করা হচ্ছে। নগরে সিটি করপোরেশনের গাড়িতে করে করপোরেশনের কর্মীদের বিএনপির ব্যানার টানাতে দেখা গেছে। করপোরেশনের বিলবোর্ডগুলোর বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ঢেকে দিয়ে তার ওপর বিএনপির পোস্টার-ব্যানার টানানো হয়েছে। কয়েক জায়গায় রাতে আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে আজ বিএনপির
নেতৃত্বাধীন চার দলের রোডমার্চ শুরু হচ্ছে। কাল চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে জনসভার মাধ্যমে সরকারবিরোধী এ কর্মসূচি শেষ হবে। রাজনৈতিক কাজে সিটি করপোরেশনের সম্পদ ব্যবহারের ব্যাপারে জানতে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকাল কয়েক দফা ফোন করলেও তিনি বারবার তা কেটে দেন। দুপুরের পর থেকে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থন নিয়ে মন্জুর আলম মেয়র নির্বাচিত হন।
গত দুই দিনে নগরের বিভিন্ন এলাকায় সিটি করপোরেশনের গাড়িগুলো দিয়ে বিএনপির বোডমার্চ ও জনসভার ব্যানার টানানো হয়েছে। গত শুক্রবার করপোরেশন বন্ধ থাকলেও দুপুর ১২টায় আন্দরকিল্লায় দেখা যায়, করপোরেশনের একটি গাড়ি দিয়ে রাস্তার ওপর বড় ব্যানার টানানো হচ্ছে। ছবি তুলতে গেলে তাঁরা গাড়ি নিয়ে দ্রুত চলে যান। ঘণ্টা খানেক পর গাড়ি নিয়ে আবার ফিরে এসে ব্যানার টানানো হয়। তখন কথা বলতে চাইলে গাড়িচালক ও ব্যানার টানানোর কাজে নিয়োজিত করপোরেশনের কর্মী—দুজনের কেউই কথা বলতে রাজি হননি। ব্যানার টানিয়ে তাঁরা দ্রুত চলে যান।
জানতে চাইলে করপোরেশনের চতুর্থ শ্রেণীর এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে রাজনৈতিক দলের এই কাজ করতে হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এর আগে এ ধরনের কাজে করপোরেশনের গাড়ি বা জনবল ব্যবহারের কোনো ঘটনা তাঁর মনে পড়ছে না। কয়টি গাড়ি এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি কোনো সংখ্যা বলতে রাজি হননি।
সূত্র জানায়, নগরে সিটি করপোরেশনের দুই শতাধিক বিলবোর্ড আছে। রেলওয়েরও রয়েছে এমন অনেক বিলবোর্ড। এগুলো বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাড়া নিয়েছে নিজেদের পণ্যের প্রচারের জন্য। বিলবোর্ডগুলোর অধিকাংশ এখন বিএনপির ব্যানারের নিচে। এসব ব্যানারে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছবি শোভা পাচ্ছে। সন্ধ্যার পর সিটি করপোরেশনের সড়কবাতির সংযোগ থেকে এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
বিলবোর্ডের বাইরেও শহরজুড়ে ব্যানার টানানো হয়েছে। এগুলোর একটা বড় অংশেও রাতে বিদ্যুৎবাতির মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরের ইপিজেড মোড় থেকে কালুরঘাট, শাহ আমানত সেতু থেকে ইস্পাহানী মোড় পর্যন্ত কয়েক শ ব্যানারে ঢাকা পড়েছে ছোট ও বড় আকৃতির বিলবোর্ডগুলো।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব মো. সামসুদ্দোহা প্রথম আলোকে বলেন, চার দলের প্রচারকাজে সিটি করপোরেশনের গাড়ি বা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভিযোগ সত্য নয়।
বিলবোর্ডে রাজনৈতিক দলের ব্যানার টানানোর বিষয়টি সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারের মধ্যে নেই বলে দাবি করেন সচিব। তিনি বলেন, বিলবোর্ডগুলো একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে এক থেকে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছে করপোরেশন। ওই সংস্থার মালিক এ বিষয়ে বলতে পারেন।
অ্যাড ফ্রেম নামের ওই বিজ্ঞাপনী সংস্থার অন্যতম অংশীদার আরশেদুল আলম বলেন, ‘বিলবোর্ডে ব্যানার টানানোর আগে কেউ আমাদের অনুমতি নেয়নি। আমরা যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিলবোর্ড ভাড়া দিয়েছি, এসব ব্যানারের কারণে তাদের পণ্যের প্রচার ঢাকা পড়ে গেছে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এখন কর্মসূচি শেষে এসব ব্যানার কে সরাবে, সে প্রশ্নও থাকছে। যা হয়েছে তা আসলে অন্যায় ও অনৈতিক।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল ব্যানারে বাতির ব্যবস্থা তদারক করেন মেয়রের এক ছেলে, অথচ মাস শেষে বিদ্যুৎ বিভাগকে বাড়তি বিলের টাকা করপোরেশনকে দিতে হবে।
মেয়রপুত্র নিজামুল আলম অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কেউ আপনাকে ভুল বার্তা দিতে পারে। আমি পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আছি। রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ মেয়রের আরেক ছেলে সরওয়ার আলমের সঙ্গে গতকাল রাতে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোর পরিচয় জানার পর তিনি ফোন কেটে দেন।
সিটি করপোরেশনের বিলবোর্ডের ইজারাগ্রহীতা এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চার বছর ধরে বিলবোর্ডে বিদ্যুৎ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু কদিন ধরে নগরের বিভিন্ন বিলবোর্ডে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের সড়কবাতির সংযোগ থেকে সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারে, কিংবা সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়ে কেউ এ কাজ করতে পারে।
সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘মেয়র মহোদয় পিডিবি থেকে আটটি মিটার ভাড়া নিয়ে ব্যানার টানানো বিলবোর্ডগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। করপোরেশন থেকে আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ দিচ্ছি না।’
পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রইস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিলবোর্ডের জন্য কেউ মিটার ভাড়া করেনি। সিটি করপোরেশনের সড়কবাতির জন্য আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়ে থাকি। সেখান থেকে হয়তো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতে পারে।’
রেলওয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুধু বিলবোর্ড ভাড়া দিয়েছি। সেখানে বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই।’
এসব বিষয়ে মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলমের বক্তব্য নিতে গতকাল রাতে আবার কাট্টলীর বাড়িসহ তাঁর যাতায়াত আছে, এমন কয়েকটি জায়গায় সরাসরি গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। বাড়িতে গেলে বলা হয়, তিনি বাড়িতে নেই। তাঁর ছেলেদের মাধ্যমেও মেয়রের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়নি। তাই তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘মেয়র সাহেব আমাদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। এ কারণে বেগম খালেদা জিয়ার জনসভার জন্য তিনি আমাদের যথেষ্ট সমর্থন দিচ্ছেন।’
নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলমের অভিযোগ, ‘সিটি করপোরেশনকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করতে ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী দায়িত্ব পালনের সময়ে আমাদের দলের নেত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম আগমন উপলক্ষে এ ধরনের কোনো কাজ করেননি। এখন দলীয় কাজে নগ্নভাবে করপোরেশনকে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
খোরশেদ আলম দাবি করেন, সিটি করপোরেশনের সেবার মান নিচে নেমে গেছে। এর আগে নগরের পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা—এ তিনটি বিষয় শুধু দেশে নয়, বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছিল। এসব এখন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত।’
No comments