প্রচ্ছদ রচনা : জীবনের রেলগাড়ি-জসীমউদ্দিন মণ্ডল মজদুর থেকে জননেতা
পলেস্তারা খসে পড়া একটি অতি পুরনো বাড়ি। একেবারে চাকচিক্যহীন। বারান্দাবিহীন বাড়িটির দরজা দিয়ে প্রবেশ করে চৌকি ও একটি চেয়ার। চৌকিতে তখনো মশারির তিন কোনা দড়ি দিয়ে বাঁধা। বোঝাই যায়, এখানেই কেউ একজন শুয়েছিলেন, উঠে গেছেন; মশারি খোলা হয়নি। সেখানেই শুয়েছিলেন জসীমউদ্দিন মণ্ডল। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু জিনিসপত্র। কিছু বই, দু-একটা ছবি। একটি ছবিতে যুবক জসীম ও আরো একজন সাথী। আছে লেনিনের ছবি। সিলিংয়ে একটি ফ্যান
আছে বটে, তবে তা ঘোরে না। শুরু হয় আদ্যোপান্ত মানুষের ভাবনায় পার করা একজন মানুষের সারা জীবনের কথামালা। ব্রিটিশ শাসনের অন্তিমলগ্ন, পাকিস্তান পর্বের গোটা সময় এবং বাংলাদেশের প্রায় অর্ধশতকজুড়ে তিনি নিজেকে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছেন। সাধারণ মানুষের মঙ্গল চিন্তায় নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। জীবন শুরু করেছিলেন রেলের বয়লারে কয়লা দেওয়া মজুর হিসেবে, পরবর্তী সময়ে হয়েছেন জননেতা। এখনো দর্শনে ও নিজের বিশ্বাসে অটল। এই মানুষটি আর কেউ নন; জীবন্ত কিংবদন্তি জসীমউদ্দিন মণ্ডল। জসীম মণ্ডলের বাড়িতে আলাপচারিতার পর খুলনায় ফিরে গিয়ে এবারের প্রচ্ছদ করেছেন কালের কণ্ঠের খুলনা অফিসের ব্যুরো চিফ গৌরাঙ্গ নন্দী
আজকের কুষ্টিয়া জেলার কালিদাশপুর গ্রামে এক অতিসাধারণ পরিবারে জসীমউদ্দিন মণ্ডলের জন্ম। তখন কুষ্টিয়া জেলা ছিল নদীয়া জেলার মধ্যে। কবে জন্ম হয়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ তিনি বলতে পারেননি। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, "মা বলতেন, 'সেই যে দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ শুরু হলো, তার ঠিক ১০ বছর পর তোর জন্ম।' এর থেকে আন্দাজ করতে পারি, ১৯১৪ সাল থেকে ১০ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৪ সালে এই পৃথিবীর আলোর মুখ আমি প্রথম দেখি।" (পৃ. ৯, সংগ্রামী স্মৃতিকথা, জীবনের রেলগাড়ি_জসীমউদ্দিন মণ্ডল)। অবশ্য, জন্মদিন সম্পর্কে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'মায়ের কাছে শুনে, আর দাদির হিসাব মতে আমার মনে হয় জন্মদিনটি হবে ১২ আশ্বিন।'
তাঁর বাবা চাকরি করতেন রেলে। বেতন পেতেন মাত্র ১৩ টাকা। তবে মাত্র এক টাকা দুই আনাতেই তখন এক মণ ভালো চাল পাওয়া যেত। বাবার রেলের চাকরির সুবাদে সেই ছোটবেলায় তিনি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
নানাবাড়ির গ্রামের এক পাঠশালায় জসীমউদ্দিন মণ্ডলের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। খড়ের চালা আর বাঁশের বাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া পাঠশালা। পাঠশালার হেডপণ্ডিত মহিম মুখুজ্জে (মুখোপাধ্যায়) তাঁর মামাকে একদিন বলেছিলেন, 'বুঝলে হে, ছেলেটা কালে একজন কেউকেটা গোছের কিছু হবে, আমি বলে দিলুম।' মহিম বাবুর কথা মনে পড়ায় তিনি যেন আনমনেই বলে ওঠেন, 'কেউকেটা আর হতে পারলাম কোথায়!'
১৯৩২ সালে তাঁর বাবা পদোন্নতি পেয়ে টালি ক্লার্কের পদ পান। আসেন সিরাজগঞ্জে। ১৯৩৪-এ বদলি হয়ে যান রানাঘাট। সেখান থেকে পার্বতীপুর। ক্রমাগত বদলি এবং স্থান বদলের ধাক্কায় পড়াশোনা তাঁর আর হয়ে ওঠেনি। পার্বতীপুর থাকার সময় তাঁর বাবার এক সহকর্মী তাঁকে পড়ানোর চেষ্টা করেন। তিনি পড়াশোনায় উৎসাহ জোগাতে নানা গল্প বলতেন। এই গল্পের একটি অংশজুড়ে থাকত স্বদেশিদের গল্প। দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে যেসব তরুণ-তরুণী জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করে চলেছে তাদের গল্প। তাঁর মুখে শুনেছেন মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের সাহসী জীবনসংগ্রাম এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে আ@ে@@@াৎসর্গের কাহিনী।
জসীম মণ্ডল বলেন, 'আসলে লোকটি ছিল স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বলার ধরনে আমার চোখের সামনে যেন সেসব ঘটনা দেখতে পেতাম, মনে হতো আমার কাছে যদি অস্ত্র থাকত তাহলে আমিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতাম।' এ ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বদেশিদের প্রতি প্রবল আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় জসীম মণ্ডলের। স্বদেশি দেখার জন্য উন্মুখ হন তিনি। স্বদেশি দেখার বাসনায় তিনি একদিন কয়েক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান পার্সেল ট্রেনে করে পার্বতীপুর থেকে কলকাতায়। যাহোক, স্বদেশি দেখার সাধ তখনো মেটেনি। এরপর তাঁর বাবা বদলি হয়ে আসেন ঈশ্বরদী।
পৃথিবীর পাঠশালায়
ঈশ্বরদী থাকতে তিনি হরহামেশা কলকাতা যেতেন। এই ট্রেনে যাওয়া তো আবার ফিরতি ট্রেনে চলে আসা। তাঁর ভাষায়, 'ঈশ্বরদীর দিনগুলো (পরে অবশ্য তিনি সেই ঈশ্বরদীতে থিতু হন। এখনো আছেন সেখানে।) সত্যিই রোমাঞ্চে ভরা। সেই সময় কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে ডাল-ভাতের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন কলকাতায় জোরেশোরে লাল ঝাণ্ডার মিছিল হতো। শ্রমিক আন্দোলন চলছিল। লাল ঝাণ্ডা, মিছিল, শ্রমিকদের আন্দোলন_এগুলো আমাকে ভয়ানকভাবে টানত। আমি বারবার যেতাম এর খবর আনতে।' পরে আর কলকাতায় গিয়ে আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে হয়নি। একদিন তাঁর বাবা কলকাতায় বদলি হয়ে যান। আর জসীমউদ্দিন মণ্ডলও পেয়ে যান এক নতুন জীবন।
কলকাতা তখন স্বাধিকার আন্দোলনে টগবগ করছে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় মিছিল আর স্লোগান। জসীমদের বাসা ছিল নারকেলডাঙ্গা কলোনিতে। কলোনির চারপাশে উঁচু দেয়াল। এর পাশ দিয়ে গেছে বড়বাজারের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে মিছিল যেত। মিছিলের আগে থাকতেন শ্রমিকরা। মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে বজ্রকঠিনভাবে তাঁরা আওয়াজ দিতেন, 'ইংরেজ বেনিয়া এ দেশ ছাড়ো, ভারত মাতাকে মুক্ত করো', 'লাল ঝাণ্ডা কি জয়, ভারত মাতা কি জয়', 'পুকার তা হায় ইনসান রোটি কাপড়া আউর মোকাম' প্রভৃতি। এসব স্লোগান শুনে আনমনা হয়ে পড়েন কিশোর জসীম। নিজের অজান্তেই একদিন নিজেকে আবিষ্কার করেন মিছিলের সারিতে।
মিছিল দেখতে দেখতে তিনি হয়ে যান মিছিলের একজন। স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগান দেওয়া, দেশকে দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করা, গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষাকারীদের ক্ষমতায় বসানোর আকাঙ্ক্ষায় টগবগ করতে করতে কিশোর জসীম এগোতে থাকেন। মিছিল যেত ধর্মতলা আর বউবাজার ঘুরে মনুমেন্টের দিকে। মনুমেন্টে এসে মিছিল থামত। নেতারা বক্তব্য দিতেন। অনেক দিন পর ১৯৮৯ সালে কলকাতায় সিপিআইয়ের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) কংগ্রেসে সেই মনুমেন্টের পাদদেশে জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
মনুমেন্টের সভা-সমাবেশ শেষে বিলাতি কাপড় পোড়ানোর ধুম পড়ে যেত। জসীমের মতো অল্প বয়সীদের দায়িত্ব ছিল বিলাতি কাপড় জোগাড় করা। তাঁরা হাওড়া ঘাটে স্নান করতে আসা নারীদের বিলাতি কাপড় চুরি করে নিয়ে এসে নেতাদের হাতে তুলে দিতেন। বিলাতি কাপড় চুরির ধান্ধায় জসীমের মতো কিশোরের দল হাওড়া ঘাটে ঘুরঘুর করতেন। আর নেতারা সেই কাপড় পুড়িয়ে দিতেন। তাঁদের আনন্দ আর দেখে কে!
নারকেলডাঙ্গার রেল কলোনিতে জসীমউদ্দিন মণ্ডলের নেতৃত্বে তখন সমবয়সীদের একটি দলের নিত্যদিনকার কাজ হয়ে দাঁড়ায় মিটিং-মিছিলে যোগ দেওয়া। তখন তাঁরা কলকাতা বলতে বুঝতেন গড়ের মাঠকে। কেউ হয়তো খবর আনতেন আজ মিটিং হবে। চল, সবাই মিটিং শুনতে। আর হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়া। যেমন ছিল মিটিং-মিছিল, তেমনি ছিল পুলিশের আক্রমণ। লাল পাগড়িধারী পুলিশরা মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দিত। এ ছাড়া ছিল লাঠিপেটা। জসীমউদ্দিন বলেন, 'ব্রিটিশরা তো একবার এক গোরা সার্জেন্টকে নিয়ে আসে মিছিল-মিটিং প্রতিরোধ করতে। তার নাম ছিল এন্ডারসন। একটা বিরাট কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুলিশ ফোর্স নিয়ে সদর্পে সে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। মিছিল কিংবা পথসভা দেখলেই তার কালো গোড়া দাবড়ে দিত জনতার ওপর। ঘোড়ার পায়ের আঘাতে-চাপে মানুষজন পিষ্ট তো হতোই। তার ওপর নৃশংসভাবে সে লাঠিচার্জ করত।'
দেশমাতৃকার লড়াইয়ে আগুয়ান বিপ্লবীরা সেই সার্জেন্টকে শায়েস্তাও করেছিল। একদিন পরিকল্পিতভাবে বিপ্লবীরা অলিগলিতে লুকিয়ে থেকে সাহেবের আসার অপেক্ষায় ছিল। একসময় দেখা গেল কিছু পার্শ্বচর নিয়ে সার্জেন্ট সাহেব আসছে। ধর্মতলার চৌমাথায় এসে পেঁৗছলে অলিগলি থেকে বন্দে মাতরম স্লোগান ওঠে। সার্জেন্ট স্লোগানের উৎস সন্ধানে এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। এমন সময় গলির মধ্য থেকে সাহেবকে লক্ষ্য করে একযোগে বোমা পড়তে শুরু করে। একের পর এক বোমার বিস্ফোরণে গোটা এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সাহেবের পার্শ্বচররা যে যার মতো ছুটে পালায়। কেউ কেউ বোমার আঘাতে রাস্তায় পড়ে কোঁকাতে থাকে। সার্জেন্টের ঘোড়াটাও মুখ থুবড়ে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সবাই ভেবেছিল সার্জেন্ট সাহেবও অক্কা পেয়েছে। কিন্তু পরে জানা যায়, সে বেঁচে গেছে। তবে আর কোনো দিন সে মিছিল-মিটিং ছত্রভঙ্গ করতে আসেনি।
দেশোদ্ধারে যুবা-তরুণদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বিপরীতে শুরু হয়েছিল ব্রতচারী আন্দোলন। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, তরুণ-যুবাদের সংগঠিত করে খেলাধুলা আর শরীরচর্চার মধ্যে আটকে রাখা। জসীমউদ্দিন মণ্ডলের মতে, এই আন্দোলনটি ছিল ইংরেজদের একটি চাল। শাসকরা সব সময় তাদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য জনগণের মাঝে তাদের আস্থাভাজন একটি গোষ্ঠী গড়ে তুলতে চায়। ইংরেজরাও তখন স্বাধীনতার নেশায় পেয়ে বসা হাজার হাজার বিপ্লবী যুবা-তরুণদের বিপরীতে একদল স্বাস্থ্যবান যুবা-তরুণ গড়ে তুলতে চাইছিল, যাতে তারা বিপ্লবীদের সংস্পর্শে না যেতে পারে এবং নিজেরা স্বাস্থ্যবান দালাল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে।
রেলের চাকরি ও রাজনীতির মাঠ
তখন ১৯৩৯ সাল। দুনিয়াজুড়ে আরো একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। জসীমউদ্দিন মণ্ডলদের পরিবারে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ভাড়ারে টান পড়তে শুরু করে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ফলে প্রয়োজনের তাগিদে জসীমউদ্দিনের মাথায় চাকরির চিন্তা উঁকি দেয়। মাথায় ভাবনা এলেই তো আর হবে না, চাকরিটা তো পেতেও হবে।
অবশ্য তখন চাকরির বাজারে এত আকাল পড়েনি। মোটামুটি গায়ে-গতরে ভালো থাকলে লাইনে দাঁড়াতে পারলে চাকরি একটি জুটে যেত। প্রয়োজন ছিল চাকরির লাইনটি। একদিন সেই লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগও এসে যায়। যুদ্ধের প্রয়োজনে সেনা সংগ্রহ করা হচ্ছিল। বাড়ির কাউকে না বলে জসীমউদ্দিন মণ্ডল লাইনে দাঁড়িয়ে যান। মিলে যায় চাকরি। সংগৃহীত 'নতুন সেনাদের' নিয়ে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল খিদিরপুরে। সেখান থেকে জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হবে কোচিন বন্দরে। কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনাদলে নাম লিখিয়েই অনেক দূর যেতে হবে ভেবেই মনটা কেমন যেন হয়ে যায় তাঁর। এ কারণে সুযোগ বুঝেই ট্রাক থেকে নেমে পালিয়ে চলে আসেন জসীমউদ্দিন মণ্ডল।
আবারও চাকরির লাইন। এবার সেনাদলে নয়; রেলের চাকরিতে লাইন। যথারীতি গোরা সাহেবের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে মন জয় করা। বয়স জিজ্ঞেস করাতে প্রয়োজনের খাতিরে ষোলো বছর বয়সকে আঠারো বলে তিনি চাকরিটি বাগিয়ে নেন। রেল বিভাগে তাঁর চাকরি হয়। কাজটি রেলের ইঞ্জিনে কয়লা দেওয়া। ফায়ারম্যানের সহকারী। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রেলে গিয়ে ওঠেন। ডিউটি করে ফিরে আসেন। মাস শেষে বেতন পেলেন ১৫ টাকা। তাঁর লাল ঝাণ্ডার দলে চাঁদা দেন চার আনা। কয়েক মাসের ব্যবধানেই সেই চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় এক টাকায়।
তখন তিনি নিয়মিত পার্টির অফিসে যাতায়াত শুরু করেছেন। পার্টির নেতাদের সঙ্গে তখনো পরিচয় হয়নি। ভালো করে চেনেন শ্রমিক নেতা ইসমাইল হোসেনকে। পরিচিত হয়েছেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ ও কমরেড আবদুল হালিমের সঙ্গে। একদিন দেখেন এক মাথা ঝাঁকড়া চুলো বাউণ্ডুলে গোছের এক লোক কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের সঙ্গে বকবক করে চলেছেন, আর হো হো করে হাসছেন। দৃশ্যটি মোটেই ভালো লাগেনি জসীমউদ্দিন মণ্ডলের। পরে জানতে পারেন সেই ঝাঁকড়া চুলো ব্যক্তিটি আর কেউ নন, আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। জানতে পারেন কবি কাজী নজরুলও পার্টির কাজেকর্মে সহযোগিতা করেন।
ছিলেন আরো একজন লাজুক স্বভাবের কবি। কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি দলের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করতেন। অফিসে আরো আসতেন পি সি যোশী, এস এ ডাঙ্গে। আরো পরে আসতে থাকেন জ্যোতি বসু। কমিউনিস্ট মানেই সোনার মানুষ। ত্যাগ, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতায় অনন্য ব্যক্তিত্ব। জসীমউদ্দিন মণ্ডলের তখনকার লক্ষ্য সোনার মানুষ হওয়া, কমিউনিস্ট হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। সে কারণে রেলের ডিউটির সময়টুকু বাদে বাকি সময়টা দলের কাজে, দলের প্রয়োজনে ব্যয় করতে থাকেন। উৎসাহভরে নিজে যেচে কাজ করেন। অল্প দিনেই নেতাদের নজরে পড়ে যান। প্রস্তাব আসে ক্যাডার করে নেওয়ার। এতে উৎসাহী হয়ে আরো বেশি বেশি করে দলের কাজ করতে থাকেন। অবশেষে ১৯৪০ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'সেদিন আমার বুক গর্বে ভরে ওঠে। আমি শোষিত মানুষের পার্টি, সর্বহারা শ্রেণীর সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য।'
১৯৪১-৪২ সালের কথা। এরই মধ্যে চাকরিতে তাঁর প্রমোশন হয়েছে। হয়েছেন সেকেন্ড ফায়ারম্যান। ইঞ্জিনে কয়লা না মারলে আর রেল চলবে না। রেল চালনায় এই বিশেষ ভূমিকা থাকার কারণে তখন ফায়ারম্যানরা আচমকা এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। তখন হরহামেশাই বার্মা রণাঙ্গনে ব্রিটিশের অস্ত্রবোঝাই ট্রেন চলত। এগুলো যেত চিৎপুর হয়ে। একদিন ড্রাইভার ও ফায়ারম্যানরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে বললেন, তাঁরা আর ট্রেনে উঠবেন না। বন্ধ হয়ে গেল ট্রেন চলাচল। খবর পেয়ে রেলের গোরা সাহেবরা ছুটে এলেন। প্রথমে হুমকি ধমকি, পরে অনুরোধ-উপরোধ। একপর্যায়ে ট্রেন চলল বটে, তবে এই অপরাধে (!) কয়েকজনকে বদলি করা হলো। জসীমউদ্দিন মণ্ডলকেও বদলি করে দেওয়া হয় কাঠিহার লোকোইয়ার্ডে।
১৯৪২-এর আগস্টে শুরু হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সবার মুখে তখন একই ধ্বনি : কুইট ইন্ডিয়া, ডু অর ডাই, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। বুকভরা বেদনা নিয়ে জসীমউদ্দিন বলেন, 'সর্বাত্মক এই আন্দোলনে কতজনের যে প্রাণ যায়, তার হিসাব নেই।' প্রাণ দেন গান্ধীবুড়ি নামে খ্যাত মাতঙ্গিনী হাজরাও। সে বছরই অসুখে মারা যান জসীমউদ্দিন মণ্ডলের বাবা। এরপর পুরো সংসারের দায় চাপে তাঁর মাথায়।
ভাগ হয়ে গেল বাংলার হৃদয়
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল এই ভূখণ্ডের রাজনীতির জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলে চলেন তাঁর দেখা সেই সময়ের নানামুখী তৎপরতার কথা। ইংরেজদের কবল থেকে দেশ মুক্ত করার সংগ্রাম প্রবলভাবে এগিয়ে চলে, পাশাপাশি শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বিরোধ। অবশ্য ১৯০৫ সালে বাংলা দুই ভাগ (বঙ্গভঙ্গ) হওয়ার পর থেকেই হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি শুরু। পরবর্তী সময়ে এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগের রাজনীতি বেশ পোক্ত হয়। দাবি ওঠে হিন্দুদের জন্য একটি দেশ, মুসলমানদের জন্য আরেকটি দেশ। জসীমউদ্দিনের ভাষায়, 'এই বিভক্তির রাজনীতি করে ধনীগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ। এরা দুটি দল হলেও একই শ্রেণী-স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিপরীতে কমিউনিস্টরা, লাল ঝাণ্ডার প্রতিনিধিরা গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে। কিন্তু সেদিন এই কমিউনিস্টরা (এমনকি আজও) বেশি মানুষকে তাদের আদর্শে আকৃষ্ট করতে পারেনি। যে কারণে বিভেদ নামক একটি স্থায়ী ক্ষত দানা বাঁধতে শুরু করে (যার প্রকোপে-প্রভাবে আমরা আজও জ্বলে-পুড়ে মরছি)।'
১৯৪৭-এর আগস্টে উপমহাদেশ স্বাধীন হলো। রক্তের হোলি উৎসবের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের জন্ম হলো ভারত ও পাকিস্তান নামে। পাকিস্তান নামের দেশটির দুটি অংশ। এক অংশ পুবে এবং অন্য অংশ পশ্চিমে। এখানে বাংলা ভাগ হয়ে পুবের অংশ তথা পূর্ববাংলা হলো পাকিস্তানের অংশ।
কলকাতা ছেড়ে জসীম আসতে চাননি। কিন্তু তাঁকে বলা হলো, তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে হবে। জসীম মণ্ডল বলেন, 'আমার মুসলমানি নাম দেখে দরখাস্ত গ্রহণকারী হিন্দু কর্মকর্তাটি মনে করে থাকতে পারেন আমি ভুল করে ভারতে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছি: অথবা সেই সময়ে ধর্মীয় হিংসার কারণে ওই হিন্দু কর্মকর্তাটিও চাননি একজন মুসলমান ভারতে থেকে যাক।'
সাধারণ শ্রমিক থেকে নন্দিত নেতা
একজন কমিউনিস্ট হিসেবে জসীমউদ্দিন মণ্ডল নিজে কখনো চাননি ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হোক। যে কারণে তিনি নিজে যেখানে ছিলেন, সেই কলকাতায়ই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। মুসলিম_এই পরিচয় নিয়ে পাকিস্তানে আসতে চাননি। কিন্তু কী আর করা! চলে আসতে হলো। চলে আসেন ঈশ্বরদীতে। চেনা জায়গা। কাছেই নিজের জন্মস্থান। ঈশ্বরদীতে শ্বশুরবাড়ি। আর এর রেলস্টেশন, লোকোশেড সব কিছু তাঁর আপন। এখানেও তাঁর সেই কাজ। রেলে চড়া, বয়লারে কয়লা মারা। আর বাড়তি দলের কাজ।
দেশবিভাগের পরও কিছুদিন কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়নি। ১৯৪৮-এর শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি আলাদাভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করে। জ্যোতি বসু, বীরেন দাশগুপ্ত, মনসুর হাবিবের মতো নেতারা ভারতের অংশে আটকে পড়েন। দেশবিভাগের আগে রেল শ্রমিকদের নেতা হিসেবে জ্যোতি বসু শিলিগুড়ি, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, ঈশ্বরদী, শান্তাহার, রানাঘাট প্রভৃতি জায়গায় চষে বেড়িয়েছেন। পাকিস্তান পর্বে রেল শ্রমিকদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করতে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থাৎ রেলের পশ্চিমাঞ্চল জোনে জসীমউদ্দিন মণ্ডলও চরকির মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন।
কিন্তু দলীয় কর্মকাণ্ডে ঝক্কি অনেক। নতুন দেশ। মুসলমানের দেশ। পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবিরা রাজা। শরণার্থীদের চাপ অনেক। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। চালের দামও বেশ। ১৯৪৯ সালের কথা। এক জেলার চাল যাতে আরেক জেলায় না যায়, তা প্রতিরোধে সরকারের তৈরি করা মিলিশিয়ারা রেলে চেকিং করত। একদিন এভাবে চেক করে ইঞ্জিন বগিতে করে নিয়ে আসা জসীম মণ্ডলের তিন বস্তা চালও তারা রাজশাহী স্টেশনে নামিয়ে নেয়। এতে তাঁর নেতৃত্বে রেল স্ট্রাইক হয়। নিয়ে যাওয়া চাল ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে আর কোনো রেল চলাচল করেনি। সরকারের পক্ষে একজন ম্যাজিস্ট্রেট রেল কর্মচারীদের চাল আর মিলিশিয়ারা নামাবে না এমন লিখিত অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ট্রেন আবারও চালু হয়। এর ফল হিসেবে জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে সাসপেন্ড করা হয়।
রেল শ্রমিক নেতা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালনকারী আন্দোলনটি হলো খুদবিরোধী আন্দোলন। সেই সময়ে রেল শ্রমিকদের দেওয়া হতো চালের বদলে খুদ। মুরগির খাবার খুদ শ্রমিকদের দিয়ে কর্মকর্তাদের ভালো চাল দেওয়া হতো। জসীমউদ্দিন মণ্ডলের নেতৃত্বে শুরু হয় এই খুদবিরোধী আন্দোলন। একটাই দাবি, সবাইকে চাল দিতে হবে। কোনো শ্রমিককে খুদ দেওয়া চলবে না। সমস্যা বর্ণনা করে জসীমউদ্দিনের দেওয়া বক্তব্যে সব রেল শ্রমিক একমত হন। গর্জে ওঠেন লোকোশেডের শ্রমিকরা। শেড খালাসিরা হাতের গাঁইতি-শাবল-কোদাল ফেলে দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান। পোর্টার, সান্টার, ফায়ারম্যান, ড্রাইভার সবাই কাজ বন্ধ করে দিয়ে শরিক হন মিছিলে। ঈশ্বরদীতে তখন ট্রেন এসে আটকা পড়ে। কোনো ট্রেন নড়ছে না। শ্রমিকরা কাজ করবেন না। আগে তাঁদের দাবির ব্যাপারে সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে, তবেই রেল চলবে।
বিকেল ৫টার দিকে পাবনা থেকে কয়েক লরি রিজার্ভ ফোর্স এসে পেঁৗছায়। তারা একদিকে রেল চালানোর উদ্যোগ নেয়; অন্যদিকে এই আন্দোলনের নেতাদের খুঁজতে থাকে। জসীমউদ্দিন তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী দেলওয়ারের সহায়তায় রেল কলোনিতে পালিয়ে যান। পরে রাতের একটি ট্রেনে জসীম মণ্ডল আর বিজন সেন পেঁৗছান আবদুলপুর স্টেশনে। সেখান থেকে হাঁটাপথে নাটোর হয়ে বাসুদেবপুর গ্রামের হালদারপাড়ায় গিয়ে ওঠেন গভীর রাতে। সেখানে ছিল পার্টির শক্তিশালী সংগঠন। দিন দুয়েকের মধ্যে জানা যায়, খুদবিরোধী আন্দোলন করায় জসীম মণ্ডলসহ মোট ছয়জনের নামে হুলিয়া জারি হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি মাস ছয়েকের মতো সেখানকার সাঁওতালপাড়ায় থাকেন। সাঁওতালদের সঙ্গে ক্ষেতে-খামারে কাজ করতেন। গায়ের রং ও শরীর খানিকটা তাঁদের মতো হওয়ায় কেউই কখনো তাঁকে সন্দেহ করেনি।
মাস ছয়েকের মাথায় একদিন ঈশ্বরদীতে এসে ওঠেন লোকোশেডের কমরেড সাহাবুদ্দিনের বাসায়। ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সেখান থেকেই তাঁকে এবং দেলওয়ারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। একসময় অতিপরিচিত রেলস্টেশন থেকে সবার সামনে দিয়ে স্কর্ট করে নিয়ে যায় তাঁদের। জসীমউদ্দিনকে পাঠানো হয় পাবনা জেলে, আর দেলওয়ারকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী জেলে। এরপর আর দেলওয়ারের সঙ্গে জসীমউদ্দিনের দেখা হয়নি। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে অন্যান্য কমিউনিস্ট বিপ্লবীর সঙ্গে দেলওয়ার শহীদী মৃত্যুবরণ করেন, যা ইতিহাসে খাপড়া বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
রেল শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে আন্দোলন ছাড়াও জসীমউদ্দিন মণ্ডল সে সময় উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের সঙ্গেও কাজ করেছেন। দিন, রাত তাঁরা সাঁওতালপাড়ায় অনেক মিটিং করেছেন। দিনে চলাফেরা করতে হতো লুকিয়ে, রাতেও সাবধানে। কারণ তখন মুসলিম লীগের পাকিস্তানি সরকার কমিউনিস্টদের ওপর বেজায় খেপা ছিল। তবে সাধারণের মাঝে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে একটি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। লীগ-কংগ্রেস দলের নেতা-কর্মীদের বিপরীতে কমিউনিস্টরা গরিব মানুষের উন্নয়নের কথা বলে, তারা সৎ, নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না, তাদের কাছে সমষ্টির স্বার্থবোধ অনেক বড় প্রভৃতি। জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'এ কারণে যেখানে গিয়েছি, মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি। কিছু পাওয়ার আশায় মানুষ আমাদের যত্ন-খাতির করেনি। তবে তারা জানত, আমরা ক্ষমতায় গেলে তাদের ভালো হবে।'
মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মানসিকতা জসীমউদ্দিন মণ্ডলের জেলজীবনেও অব্যাহত ছিল। পাবনা জেলে কয়েদি-হাজতিদের দিয়ে ঘানি (সরিষা, তিল, তিসি প্রভৃতি থেকে তেল তৈরির দেশীয় যন্ত্রবিশেষ, যা এখন প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে) টানানো হতো। জসীমউদ্দিন মণ্ডলকেও ঘানি টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বিদ্রোহ করে বসেন। না, ঘানি টানা হবে না। ঘানি টানে পশু। আমরা পশু নই যে ঘানি টানব। শুধু নিজে নয়, অন্যদেরও ঘানি টানা থেকে তিনি বিরত থাকার আহ্বান জানান। এই বিরোধে ঘানি টানার তদারককারী কয়েদিকে তিনি মারতে উদ্যত হন এবং দুটি ঘানি গাছ ভেঙে ফেলেন। এর জের ধরে জেলখানায় পাগলা ঘণ্টা বাজানো হয়। বেদম পিটুনি দিয়ে তাঁকে একটি সেলে নিয়ে উদোম শরীরে মেঝেতে পানি ঢেলে রাখা হয়। শীতের সময় শরীরে কাপড়বিহীন অবস্থা এবং মেঝের পানিতে তিনি সিঁটিয়ে যাওয়ার দশায় পড়েন। রাত ২টায় ডিউটিতে আসা প্রহরী তাঁর এই অবস্থা দেখে বিচলিত হন। তাঁকে কাপড়চোপড় দিতে চান। কিন্তু ওই প্রহরী বিপদে পড়তে পারেন এই বিবেচনা থেকে তিনি সেই সুযোগ নেননি।
কারা কর্তাদের এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে তিনি অনশন শুরু করেন। খাবার দিয়ে যাওয়া হয়; তিনি তা গ্রহণ করেন না। এভাবে কেটে যায় দুই দিন। জেলার তাঁকে ভয়-ভীতি দেখান। জসীম মণ্ডলের এক রা। অনশন ভাঙবেন না। তিনি বলেন, ডিসি (ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর, যাঁদের এখন ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার বা জেলা প্রশাসক বলা হয়) সাহেবকে জেলে আসতে হবে। খবর পেয়ে জেলখানায় ডিসি আসেন। ডিসি তো উদোম অবস্থায় একটি মানুষকে দেখেই মুখ লুকান। বলেন, 'একি, কাপড় পরুন।' সুযোগ পেয়ে জসীমউদ্দিন বলেন, 'কাপড় তো আপনার জেলার খুলে নিয়ে গেছে, আমার কাছে তো কোনো কাপড় নেই।' এই শুনে তিনি হতবাক বনে যান। এই অমানবিক আচরণের জন্য জেলারকে শাস্তি দেওয়া হবে বলে শাসিয়ে জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে কাপড় পরান। অনশন ভাঙার অনুরোধ করেন। এ সময় তিনি ডিসি সাহেবকে দিয়ে জেলখানায় আর মানুষ দিয়ে ঘানি না চালানো, খাবারের মান উন্নত করা প্রভৃতি দাবি আদায় করে নেন। ডিসি সাহেব অনশন ভাঙিয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে তবে ফেরেন।
এর পর তাঁকে পাঠানো হয় রাজশাহী জেলে। সেখানে গিয়েও আরেক ধরনের অশান্তি। এবার তাঁকে গম পিষতে বলা হলো। যথারীতি তিনি গম পিষতে অস্বীকার করলেন। জেল-জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তাঁকে কঠোরতর শাস্তি ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হলো। ডাণ্ডাবেড়ি পরানো থাকলে হাঁটতে-চলতে অসুবিধা হয়। পা ফুলে গিয়ে একসময় দগদগে ঘা হয়ে গেল। ডাণ্ডাবেড়ির ঘায়ের ক্ষতচিহ্ন এখনো জসীমউদ্দিন মণ্ডল বয়ে নিয়ে চলেছেন। পরে তাঁকে এই শাস্তি থেকে কেন যেন মাফ করে দেওয়া হয়। তবে বদলি করে দেওয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে।
সেই সময় ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে অনেক গুণী রাজনীতিক বন্দি ছিলেন। ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিক সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, নগেন সরকারসহ আরো অনেকে। এমনি এক সময় স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে তাঁর তিন দিনের প্যারোলে মুক্তি মেলে। তাঁকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ, জগন্নাথগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ হয়ে ঈশ্বরদীতে নিয়ে আসে। পথে পথে অসংখ্য মানুষ তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে। কেউ কেউ নিয়ে আসে ফুলের তোড়া, কেউ আনে খাবার। পথিমধ্যে নেতাকে দেখতে পাওয়া আর তাঁকে একটু যত্ন করার সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চায়নি। মানুষের এই ভালোবাসায় বিমুগ্ধ জসীমউদ্দিন। ১৯৫৫ সালের দিকে জেল থেকে ছাড়া পান জসীমউদ্দিন মণ্ডল।
মুক্তিযুদ্ধের আগে, মুক্তিযুদ্ধকালে
পাকিস্তান পর্বে দুই দফায় মোট আট বছরের মতো তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। আর রেল শ্রমিকদের পক্ষে খুদবিরোধী আন্দোলন করার অপরাধে (!) তাঁর রেলের চাকরি চলে যায়। চাকরিবিহীন রেল শ্রমিক নেতা জসীমউদ্দিন মণ্ডল তখন পুরো সময়টি রাজনীতির জন্য ব্যয় করেন। তিনি তখনো জেলে। ১৯৬৩ সালের দিকে জেলের মধ্যেই কমিউনিস্ট রাজনীতির মতাদর্শগত বিভেদ চাঙ্গা হয়। মাও সে তুংয়ের চিন্তা ও তাঁর গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে অনেকেই আকৃষ্ট হন। নতুন কমরেডরা দলে ভেড়েন, আর তাঁরা নতুন তত্ত্বের জয়গান করতে থাকেন। আলাউদ্দিন, মতিন, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আবদুল হক, তোয়াহা প্রমুখ নেতা তখন মাও অনুসারী। মাও সে তুংয়ের বই তখন তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান। পূর্ব বাংলায় বিপ্লবের পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে তাঁরা তখনই সশস্ত্র লড়াই শুরু করার আহ্বান জানান।
জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'এ ধারার বিপরীতে আমরা যাঁরা অবস্থান করছিলাম, তাঁদের তারা সংশোধনবাদী হিসেবে আখ্যা দেয়। বলতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ।' তখন থেকেই গোপন কমিউনিস্ট দলের রাজনীতিতে চীন ও সোভিয়েত তথা মস্কো অনুসারী নামের দুটো ধারা তৈরি হয়।
কিছুদিন পর পূর্ব বাংলায় শুরু হয়ে যায় আরেক বিপর্যয়। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। তখন আইয়ুব খানের প্রচারযন্ত্র অন্ধভাবে ভারতবিরোধিতা শুরু করে। স্লোগান ওঠে, 'কাফের ধ্বংস করো।' চীনা রেডিওতেও ভারতবিরোধী প্রচারণা ঠাঁই করে নেয়। এ অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে জসীমউদ্দিন মণ্ডল লিখেছেন, 'এই উগ্র যুদ্ধংদেহী প্রচারণা পূর্ব বাংলার মানুষকে সাময়িকভাবে হলেও বিভ্রান্ত করে তুলল। এ সময় ন্যাপের কিছু কর্মী, এমনকি পার্টির কিছু কর্মীও যুদ্ধ উন্মাদনায় মেতে উঠল। কমিউনিস্ট পার্টি অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রচার করল।' (পৃ. ৮৪, সংগ্রামী স্মৃতিকথা জীবনের রেলগাড়ি_জসীমউদ্দিন মণ্ডল)।
সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারীদের একটি অংশ ন্যাপের সঙ্গে কাজ করত। তখন ন্যাপ নেতা মওলানা আবদুুল হামিদ খান ভাসানী। এই ভাসানীর সঙ্গে জসীমউদ্দিন মণ্ডল দেশের উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রচারণা সভা করেছেন। এসব প্রচারণা সভায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধের ভয়াবহ দিকগুলো তুলে ধরা হতো। যুদ্ধের উন্মাদনা থাকলেও অতি দ্রুত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে এর প্রতিক্রিয়া পড়ায় মানুষ এর বীভৎসতা সম্পর্কে আঁচ করতে পারছিল। তাঁরা দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বোদা, নবাবগঞ্জ, শিবপুর, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক সভা করে আইয়ুবী শাসনের কৌশল এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। মানুষও তাঁদের কথা অনুধাবন করতে শুরু করে।
পরবর্তী সময়ে ন্যাপ দুই ভাগ হয়ে যায়। রিকুইজিশন ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ। তখন জসীমউদ্দিন মণ্ডল ন্যাপের এই অংশের সঙ্গে মিশে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে কমিউনিস্ট পার্টিতে দ্বিধা-বিভক্তি আসে। তখনো দলের কর্মকাণ্ড গোপনে পরিচালিত হতো। একটি অংশ সশস্ত্র সংগ্রামের সমর্থক, যারা মাও অনুসারী; অন্য অংশ সোভিয়েত অনুসারী।
১৯৬৮ সালে আইয়ুব শাহী তাঁর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচারের জন্য উন্নয়ন দশক উদ্যাপন করেন। বিপরীতে ফুঁসে থাকা মানুষ আইয়ুব শাহীর পতন, বিডি সিস্টেম বাতিল ও সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে গণ-আন্দোলন শুরু করে। ঈশ্বরদীতেও তখন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি (ডাক) গঠিত হয়। যা গড়ে তোলার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন জসীমউদ্দিন মণ্ডল এবং কমিউনিস্ট পার্টির মস্কোপন্থী অনুসারীরা। আইয়ুববিরোধী এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাও অনুসারী কমিউনিস্টরা অংশ না নিয়ে বরং তারা একটি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ার ১৬ দিন পর নগরবাড়ী ঘাট থেকে রাস্তার দুই ধারের বাড়িঘর জ্বালাতে জ্বালাতে ঈশ্বরদীতে এসে পেঁৗছায় তারা। জসীমউদ্দিন মণ্ডল তখন ছিলেন তাঁদের তৈরি করা কন্ট্রোল রুমে। সেখানে খবর এল দ্রুত এলাকা ত্যাগ করার। তিনি দ্রুত বাড়ি এসে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাস্তায় চার দিন কাটিয়ে গোড়ালি সীমান্তের ফিঙ্গিতলায় পেঁৗছান। সেখান থেকে করিমপুর হয়ে কৃষ্ণনগর এবং পরে কলকাতায় পেঁৗছান। কলকাতায় তিনি ওঠেন তাঁর পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী নাচোলের রানিমা ইলা মিত্রের বাড়িতে। ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র খুবই সাদরে তাঁদের গ্রহণ করেন। তাঁরাই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। একে একে রাজনৈতিক সহকর্মী মণি সিং, রতন সেন, রণেশ মৈত্র প্রমুখের সঙ্গে দেখা হয়। শুরু হয় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সঙ্গে তখন সভা-সমাবেশে জসীমউদ্দিন মণ্ডল বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতাযুদ্ধের অনিবার্যতা এবং এতে দুনিয়ার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যে সমর্থন করা উচিত, সেই যুক্তি তুলে ধরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ান।
স্বাধীন দেশে
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই তিনি দেশে ফেরেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রীর তিল তিল শ্রমে গড়ে তোলা দোচালা ঘর দুটো বিহারিরা পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীন দেশে সংসার চালানোর জন্যে সেই ১০ কাঠা জমিও বিক্রি করে দিতে হয়। থাকার জায়গার জন্য ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের পাশে ছয় শতক পরিত্যক্ত সম্পত্তি বরাদ্দ নেন। বরাদ্দের জন্য প্রয়োজনীয় ৩২ হাজার টাকা জোগাড় হয় রেল শ্রমিক ইউনিয়ন, দলীয় ফান্ড এবং শুভানুধ্যায়ীদের দেওয়া অর্থে। এখনো রেললাইনের কাছে ওই জমিতেই তিনি বসবাস করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরিতে ন্যাপ তথা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী-অনুসারীদের একটি বড় ভূমিকা থাকায় জসীমউদ্দিনের মনে হয়েছিল, এবার দেশে শান্তি আসবে। এই প্রত্যাশা তাঁর আরো বেড়ে যায়, যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় মূলনীতির একটি হিসেবে 'সমাজতন্ত্র'কে বেছে নেন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শিক চেতনায় জারিত হওয়ায় তিনি দলের কর্মকাণ্ডে আরো সময় দিতে শুরু করেন। জীবনের শুরুতে সংসারের প্রয়োজনে জসীমউদ্দিন মণ্ডল চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু গরিব মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিপূরক রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন, সেই কাজটিকে প্রধান কর্তব্য বিবেচনা করায় আর কখনোই পরিবারের দায়-দায়িত্ব পালন করা হয়ে ওঠেনি। স্ত্রী মরিয়ম ওরফে জাহানারার অসীম ধৈর্য ও বিচক্ষণতায় এবং স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় তাঁর সংসারের খরচ মিটেছে।
১৯৭৩ সালে জসীমউদ্দিন মণ্ডল মস্কো সফরে যান। সেখানকার অভাবনীয় উন্নতি, মানুষের প্রতি মানুষের দরদবোধ, সব কিছুতে পরিপাটি ও স্নিগ্ধতার ছাপ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশটি আবারও উল্টোপথে যাত্রা শুরু করলে তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েন। এ সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দুই বছর জেলে কাটাতে হয়। জসীমউদ্দিনের মতে, ওই সময়টা ছিল বড় খারাপ। সমাজতন্ত্রের প্রতি গোটা বিশ্বে নানাভাবে আক্রমণ হচ্ছিল। আর দেশে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। ১৯৭৯ সালে নির্বাচন দিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার নামে রাষ্ট্রপতির শাসন শুরু হয়। এর তিন বছর পর আবারও এরশাদের সামরিক শাসন। এরশাদবিরোধী আট বছরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শুরু হয়। তবে এর মধ্য দিয়ে দেশে আবারও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। স্বৈরাচারী এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। আর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সমাজতন্ত্রের ওপর একের পর এক আক্রমণ চলতে থাকে। চলে শীতল যুদ্ধের নানা রকমফের। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নেয়। দেশটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন আর সমাজতন্ত্রের পরাজয় জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে হতবাক করে তোলে; আর সেই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী মরিয়ম। তিনি এটি একেবারে মেনে নিতে পারেননি। কেন এমন হলো? সমাজতন্ত্র কি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়? জবাবে জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এখনো অজেয়। এই দর্শনের ভিত্তিতে সমাজবিপ্লব সম্পন্ন হবে। আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে গরিব-মেহনতি মানুষের মুক্তি আসবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যা ঘটেছে, তা সাময়িক বিপর্যয় মাত্র।' তিনি আরো বলেন, 'মনে রাখতে হবে, মার্কসবাদী দর্শনের প্রয়োগ হচ্ছে সমাজে। এখানে নানা চিন্তার মানুষের বসবাস। ব্যক্তি-আকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তি-সম্পত্তির মোহ কাটানো বড় দুঃসাধ্য ও কষ্টকর। এ কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে। বিপর্যয় ঘটা মানে এ কথা বলা যাবে না যে দর্শন মিথ্যা। আর একটি কথা, যারা পুঁজিবাদী তথা বাজার-অর্থনীতির মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে চেয়েছে, আমরা তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তারা কী উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তাদের উন্নয়ন হচ্ছে, একদিকে চাকচিক্য, অন্যদিকে হাহাকার। আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর অবস্থা তো একই। উপরন্তু এরা এদের স্বার্থে দেশে দেশে যুুদ্ধ-সংঘাত বাধিয়ে রেখেছে। আমেরিকা স্বাধীন দেশ ইরাকে টন টন বোমা ফেলে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে মদদ দেয়। আবার এরাই মানবাধিকারের কথা বলে। সত্যিই বিচিত্র!' তাঁর মতে, মার্কসবাদী দর্শনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজে সব মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করা সম্ভব।
পরিবার, স্বজন ও কাছের বন্ধুরাও এই মানুষটির রাজনৈতিক চেতনা, মার্কসবাদী দর্শনের প্রতি আস্থা এবং উন্নততর নৈতিক বোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জসীমউদ্দিনের কাছের বন্ধু রেল শ্রমিক মো. আবদুল আজিজ তাঁর সম্পর্কে বলেন, '১৯৫৭-৫৮ সাল থেকে জসীম ভাইকে চিনি। দেখেছি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁর অগাধ, প্রশ্নাতীত। জীবনে কখনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কিছু করেননি। মানুষের ভালোর জন্যে সব কিছু করার চেষ্টা করেছেন। আর বর্তমান রাজনীতির যে খাইখাই দশা সেটির সঙ্গে জসীমউদ্দিন মণ্ডল একেবারে বেমানান।'
প্রায় একই কথা বলেন রেল শ্রমিক নেতা শাহ আলম। তিনি জসীম মণ্ডলকে একেবারে কাছ থেকে দেখছেন ১৯৬২ সাল থেকে। তিনি বলেন, 'জসীম ভাই আমাদের শিখিয়েছেন, শ্রমিকরাও মানুষ। শ্রমিকদের অধিকার কেউ দিয়ে দেবে না; অধিকার আদায় করে নিতে হবে। সংগ্রামটি রাজনৈতিক। আর কাজটি সমাজবিপ্লব। বৈজ্ঞানিক আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে এই সমাজবিপ্লব সম্পন্ন হবে। এ কারণে শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত হতে হবে। শ্রেণী আদর্শের রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে হবে। সে জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করেছি; পাশাপাশি সিপিবির (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছি। আমাদের আদর্শ জসীম ভাই।'
জসীমউদ্দিন মণ্ডল আজও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে সমানে বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। গ্রামের কৃষক আর শহরের শ্রমিকের জন্য অতি সহজভাবে তিনি কথা বলতে পারেন বলে তাঁর বক্তৃতার বেশ চাহিদাও আছে। তিনি বলেন, 'যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সাম্যবাদী সমাজের পক্ষে মানুষকে বলে যাব। আমার লক্ষ্য ছিল এই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। আমার জীবদ্দশায় এই আদর্শের প্রতিষ্ঠা হলো না। তবে একদিন এই আদর্শ প্রতিষ্ঠা পাবেই। তা না হলে গরিব-মেহনতি মানুষের মুক্তি নেই।' তিনি আরো বলেন, 'অনেকে আমাকে বলেন, রাজনীতি করে কী পেয়েছি, তাঁরা হয়তো টাকা-পয়সা, ধন-দৌলতের কথা বলতে চান; আমি তো টাকা-পয়সা বা ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির জন্য রাজনীতি করিনি। আমার রাজনীতি ছিল একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। আদর্শের প্রতিষ্ঠা হয়তো হয়নি। তবে একদিন হবেই।'
আজকের কুষ্টিয়া জেলার কালিদাশপুর গ্রামে এক অতিসাধারণ পরিবারে জসীমউদ্দিন মণ্ডলের জন্ম। তখন কুষ্টিয়া জেলা ছিল নদীয়া জেলার মধ্যে। কবে জন্ম হয়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ তিনি বলতে পারেননি। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, "মা বলতেন, 'সেই যে দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ শুরু হলো, তার ঠিক ১০ বছর পর তোর জন্ম।' এর থেকে আন্দাজ করতে পারি, ১৯১৪ সাল থেকে ১০ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৪ সালে এই পৃথিবীর আলোর মুখ আমি প্রথম দেখি।" (পৃ. ৯, সংগ্রামী স্মৃতিকথা, জীবনের রেলগাড়ি_জসীমউদ্দিন মণ্ডল)। অবশ্য, জন্মদিন সম্পর্কে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'মায়ের কাছে শুনে, আর দাদির হিসাব মতে আমার মনে হয় জন্মদিনটি হবে ১২ আশ্বিন।'
তাঁর বাবা চাকরি করতেন রেলে। বেতন পেতেন মাত্র ১৩ টাকা। তবে মাত্র এক টাকা দুই আনাতেই তখন এক মণ ভালো চাল পাওয়া যেত। বাবার রেলের চাকরির সুবাদে সেই ছোটবেলায় তিনি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
নানাবাড়ির গ্রামের এক পাঠশালায় জসীমউদ্দিন মণ্ডলের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। খড়ের চালা আর বাঁশের বাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া পাঠশালা। পাঠশালার হেডপণ্ডিত মহিম মুখুজ্জে (মুখোপাধ্যায়) তাঁর মামাকে একদিন বলেছিলেন, 'বুঝলে হে, ছেলেটা কালে একজন কেউকেটা গোছের কিছু হবে, আমি বলে দিলুম।' মহিম বাবুর কথা মনে পড়ায় তিনি যেন আনমনেই বলে ওঠেন, 'কেউকেটা আর হতে পারলাম কোথায়!'
১৯৩২ সালে তাঁর বাবা পদোন্নতি পেয়ে টালি ক্লার্কের পদ পান। আসেন সিরাজগঞ্জে। ১৯৩৪-এ বদলি হয়ে যান রানাঘাট। সেখান থেকে পার্বতীপুর। ক্রমাগত বদলি এবং স্থান বদলের ধাক্কায় পড়াশোনা তাঁর আর হয়ে ওঠেনি। পার্বতীপুর থাকার সময় তাঁর বাবার এক সহকর্মী তাঁকে পড়ানোর চেষ্টা করেন। তিনি পড়াশোনায় উৎসাহ জোগাতে নানা গল্প বলতেন। এই গল্পের একটি অংশজুড়ে থাকত স্বদেশিদের গল্প। দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে যেসব তরুণ-তরুণী জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করে চলেছে তাদের গল্প। তাঁর মুখে শুনেছেন মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের সাহসী জীবনসংগ্রাম এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে আ@ে@@@াৎসর্গের কাহিনী।
জসীম মণ্ডল বলেন, 'আসলে লোকটি ছিল স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বলার ধরনে আমার চোখের সামনে যেন সেসব ঘটনা দেখতে পেতাম, মনে হতো আমার কাছে যদি অস্ত্র থাকত তাহলে আমিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতাম।' এ ঘটনার মধ্য দিয়ে স্বদেশিদের প্রতি প্রবল আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় জসীম মণ্ডলের। স্বদেশি দেখার জন্য উন্মুখ হন তিনি। স্বদেশি দেখার বাসনায় তিনি একদিন কয়েক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান পার্সেল ট্রেনে করে পার্বতীপুর থেকে কলকাতায়। যাহোক, স্বদেশি দেখার সাধ তখনো মেটেনি। এরপর তাঁর বাবা বদলি হয়ে আসেন ঈশ্বরদী।
পৃথিবীর পাঠশালায়
ঈশ্বরদী থাকতে তিনি হরহামেশা কলকাতা যেতেন। এই ট্রেনে যাওয়া তো আবার ফিরতি ট্রেনে চলে আসা। তাঁর ভাষায়, 'ঈশ্বরদীর দিনগুলো (পরে অবশ্য তিনি সেই ঈশ্বরদীতে থিতু হন। এখনো আছেন সেখানে।) সত্যিই রোমাঞ্চে ভরা। সেই সময় কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে ডাল-ভাতের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন কলকাতায় জোরেশোরে লাল ঝাণ্ডার মিছিল হতো। শ্রমিক আন্দোলন চলছিল। লাল ঝাণ্ডা, মিছিল, শ্রমিকদের আন্দোলন_এগুলো আমাকে ভয়ানকভাবে টানত। আমি বারবার যেতাম এর খবর আনতে।' পরে আর কলকাতায় গিয়ে আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে হয়নি। একদিন তাঁর বাবা কলকাতায় বদলি হয়ে যান। আর জসীমউদ্দিন মণ্ডলও পেয়ে যান এক নতুন জীবন।
কলকাতা তখন স্বাধিকার আন্দোলনে টগবগ করছে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় মিছিল আর স্লোগান। জসীমদের বাসা ছিল নারকেলডাঙ্গা কলোনিতে। কলোনির চারপাশে উঁচু দেয়াল। এর পাশ দিয়ে গেছে বড়বাজারের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে মিছিল যেত। মিছিলের আগে থাকতেন শ্রমিকরা। মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে বজ্রকঠিনভাবে তাঁরা আওয়াজ দিতেন, 'ইংরেজ বেনিয়া এ দেশ ছাড়ো, ভারত মাতাকে মুক্ত করো', 'লাল ঝাণ্ডা কি জয়, ভারত মাতা কি জয়', 'পুকার তা হায় ইনসান রোটি কাপড়া আউর মোকাম' প্রভৃতি। এসব স্লোগান শুনে আনমনা হয়ে পড়েন কিশোর জসীম। নিজের অজান্তেই একদিন নিজেকে আবিষ্কার করেন মিছিলের সারিতে।
মিছিল দেখতে দেখতে তিনি হয়ে যান মিছিলের একজন। স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগান দেওয়া, দেশকে দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করা, গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষাকারীদের ক্ষমতায় বসানোর আকাঙ্ক্ষায় টগবগ করতে করতে কিশোর জসীম এগোতে থাকেন। মিছিল যেত ধর্মতলা আর বউবাজার ঘুরে মনুমেন্টের দিকে। মনুমেন্টে এসে মিছিল থামত। নেতারা বক্তব্য দিতেন। অনেক দিন পর ১৯৮৯ সালে কলকাতায় সিপিআইয়ের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) কংগ্রেসে সেই মনুমেন্টের পাদদেশে জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
মনুমেন্টের সভা-সমাবেশ শেষে বিলাতি কাপড় পোড়ানোর ধুম পড়ে যেত। জসীমের মতো অল্প বয়সীদের দায়িত্ব ছিল বিলাতি কাপড় জোগাড় করা। তাঁরা হাওড়া ঘাটে স্নান করতে আসা নারীদের বিলাতি কাপড় চুরি করে নিয়ে এসে নেতাদের হাতে তুলে দিতেন। বিলাতি কাপড় চুরির ধান্ধায় জসীমের মতো কিশোরের দল হাওড়া ঘাটে ঘুরঘুর করতেন। আর নেতারা সেই কাপড় পুড়িয়ে দিতেন। তাঁদের আনন্দ আর দেখে কে!
নারকেলডাঙ্গার রেল কলোনিতে জসীমউদ্দিন মণ্ডলের নেতৃত্বে তখন সমবয়সীদের একটি দলের নিত্যদিনকার কাজ হয়ে দাঁড়ায় মিটিং-মিছিলে যোগ দেওয়া। তখন তাঁরা কলকাতা বলতে বুঝতেন গড়ের মাঠকে। কেউ হয়তো খবর আনতেন আজ মিটিং হবে। চল, সবাই মিটিং শুনতে। আর হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়া। যেমন ছিল মিটিং-মিছিল, তেমনি ছিল পুলিশের আক্রমণ। লাল পাগড়িধারী পুলিশরা মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দিত। এ ছাড়া ছিল লাঠিপেটা। জসীমউদ্দিন বলেন, 'ব্রিটিশরা তো একবার এক গোরা সার্জেন্টকে নিয়ে আসে মিছিল-মিটিং প্রতিরোধ করতে। তার নাম ছিল এন্ডারসন। একটা বিরাট কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ে পুলিশ ফোর্স নিয়ে সদর্পে সে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। মিছিল কিংবা পথসভা দেখলেই তার কালো গোড়া দাবড়ে দিত জনতার ওপর। ঘোড়ার পায়ের আঘাতে-চাপে মানুষজন পিষ্ট তো হতোই। তার ওপর নৃশংসভাবে সে লাঠিচার্জ করত।'
দেশমাতৃকার লড়াইয়ে আগুয়ান বিপ্লবীরা সেই সার্জেন্টকে শায়েস্তাও করেছিল। একদিন পরিকল্পিতভাবে বিপ্লবীরা অলিগলিতে লুকিয়ে থেকে সাহেবের আসার অপেক্ষায় ছিল। একসময় দেখা গেল কিছু পার্শ্বচর নিয়ে সার্জেন্ট সাহেব আসছে। ধর্মতলার চৌমাথায় এসে পেঁৗছলে অলিগলি থেকে বন্দে মাতরম স্লোগান ওঠে। সার্জেন্ট স্লোগানের উৎস সন্ধানে এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। এমন সময় গলির মধ্য থেকে সাহেবকে লক্ষ্য করে একযোগে বোমা পড়তে শুরু করে। একের পর এক বোমার বিস্ফোরণে গোটা এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সাহেবের পার্শ্বচররা যে যার মতো ছুটে পালায়। কেউ কেউ বোমার আঘাতে রাস্তায় পড়ে কোঁকাতে থাকে। সার্জেন্টের ঘোড়াটাও মুখ থুবড়ে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সবাই ভেবেছিল সার্জেন্ট সাহেবও অক্কা পেয়েছে। কিন্তু পরে জানা যায়, সে বেঁচে গেছে। তবে আর কোনো দিন সে মিছিল-মিটিং ছত্রভঙ্গ করতে আসেনি।
দেশোদ্ধারে যুবা-তরুণদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বিপরীতে শুরু হয়েছিল ব্রতচারী আন্দোলন। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, তরুণ-যুবাদের সংগঠিত করে খেলাধুলা আর শরীরচর্চার মধ্যে আটকে রাখা। জসীমউদ্দিন মণ্ডলের মতে, এই আন্দোলনটি ছিল ইংরেজদের একটি চাল। শাসকরা সব সময় তাদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য জনগণের মাঝে তাদের আস্থাভাজন একটি গোষ্ঠী গড়ে তুলতে চায়। ইংরেজরাও তখন স্বাধীনতার নেশায় পেয়ে বসা হাজার হাজার বিপ্লবী যুবা-তরুণদের বিপরীতে একদল স্বাস্থ্যবান যুবা-তরুণ গড়ে তুলতে চাইছিল, যাতে তারা বিপ্লবীদের সংস্পর্শে না যেতে পারে এবং নিজেরা স্বাস্থ্যবান দালাল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে।
রেলের চাকরি ও রাজনীতির মাঠ
তখন ১৯৩৯ সাল। দুনিয়াজুড়ে আরো একটি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। জসীমউদ্দিন মণ্ডলদের পরিবারে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ভাড়ারে টান পড়তে শুরু করে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ফলে প্রয়োজনের তাগিদে জসীমউদ্দিনের মাথায় চাকরির চিন্তা উঁকি দেয়। মাথায় ভাবনা এলেই তো আর হবে না, চাকরিটা তো পেতেও হবে।
অবশ্য তখন চাকরির বাজারে এত আকাল পড়েনি। মোটামুটি গায়ে-গতরে ভালো থাকলে লাইনে দাঁড়াতে পারলে চাকরি একটি জুটে যেত। প্রয়োজন ছিল চাকরির লাইনটি। একদিন সেই লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগও এসে যায়। যুদ্ধের প্রয়োজনে সেনা সংগ্রহ করা হচ্ছিল। বাড়ির কাউকে না বলে জসীমউদ্দিন মণ্ডল লাইনে দাঁড়িয়ে যান। মিলে যায় চাকরি। সংগৃহীত 'নতুন সেনাদের' নিয়ে ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল খিদিরপুরে। সেখান থেকে জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হবে কোচিন বন্দরে। কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনাদলে নাম লিখিয়েই অনেক দূর যেতে হবে ভেবেই মনটা কেমন যেন হয়ে যায় তাঁর। এ কারণে সুযোগ বুঝেই ট্রাক থেকে নেমে পালিয়ে চলে আসেন জসীমউদ্দিন মণ্ডল।
আবারও চাকরির লাইন। এবার সেনাদলে নয়; রেলের চাকরিতে লাইন। যথারীতি গোরা সাহেবের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে মন জয় করা। বয়স জিজ্ঞেস করাতে প্রয়োজনের খাতিরে ষোলো বছর বয়সকে আঠারো বলে তিনি চাকরিটি বাগিয়ে নেন। রেল বিভাগে তাঁর চাকরি হয়। কাজটি রেলের ইঞ্জিনে কয়লা দেওয়া। ফায়ারম্যানের সহকারী। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রেলে গিয়ে ওঠেন। ডিউটি করে ফিরে আসেন। মাস শেষে বেতন পেলেন ১৫ টাকা। তাঁর লাল ঝাণ্ডার দলে চাঁদা দেন চার আনা। কয়েক মাসের ব্যবধানেই সেই চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় এক টাকায়।
তখন তিনি নিয়মিত পার্টির অফিসে যাতায়াত শুরু করেছেন। পার্টির নেতাদের সঙ্গে তখনো পরিচয় হয়নি। ভালো করে চেনেন শ্রমিক নেতা ইসমাইল হোসেনকে। পরিচিত হয়েছেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ ও কমরেড আবদুল হালিমের সঙ্গে। একদিন দেখেন এক মাথা ঝাঁকড়া চুলো বাউণ্ডুলে গোছের এক লোক কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের সঙ্গে বকবক করে চলেছেন, আর হো হো করে হাসছেন। দৃশ্যটি মোটেই ভালো লাগেনি জসীমউদ্দিন মণ্ডলের। পরে জানতে পারেন সেই ঝাঁকড়া চুলো ব্যক্তিটি আর কেউ নন, আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। জানতে পারেন কবি কাজী নজরুলও পার্টির কাজেকর্মে সহযোগিতা করেন।
ছিলেন আরো একজন লাজুক স্বভাবের কবি। কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি দলের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করতেন। অফিসে আরো আসতেন পি সি যোশী, এস এ ডাঙ্গে। আরো পরে আসতে থাকেন জ্যোতি বসু। কমিউনিস্ট মানেই সোনার মানুষ। ত্যাগ, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতায় অনন্য ব্যক্তিত্ব। জসীমউদ্দিন মণ্ডলের তখনকার লক্ষ্য সোনার মানুষ হওয়া, কমিউনিস্ট হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। সে কারণে রেলের ডিউটির সময়টুকু বাদে বাকি সময়টা দলের কাজে, দলের প্রয়োজনে ব্যয় করতে থাকেন। উৎসাহভরে নিজে যেচে কাজ করেন। অল্প দিনেই নেতাদের নজরে পড়ে যান। প্রস্তাব আসে ক্যাডার করে নেওয়ার। এতে উৎসাহী হয়ে আরো বেশি বেশি করে দলের কাজ করতে থাকেন। অবশেষে ১৯৪০ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'সেদিন আমার বুক গর্বে ভরে ওঠে। আমি শোষিত মানুষের পার্টি, সর্বহারা শ্রেণীর সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য।'
১৯৪১-৪২ সালের কথা। এরই মধ্যে চাকরিতে তাঁর প্রমোশন হয়েছে। হয়েছেন সেকেন্ড ফায়ারম্যান। ইঞ্জিনে কয়লা না মারলে আর রেল চলবে না। রেল চালনায় এই বিশেষ ভূমিকা থাকার কারণে তখন ফায়ারম্যানরা আচমকা এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। তখন হরহামেশাই বার্মা রণাঙ্গনে ব্রিটিশের অস্ত্রবোঝাই ট্রেন চলত। এগুলো যেত চিৎপুর হয়ে। একদিন ড্রাইভার ও ফায়ারম্যানরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে বললেন, তাঁরা আর ট্রেনে উঠবেন না। বন্ধ হয়ে গেল ট্রেন চলাচল। খবর পেয়ে রেলের গোরা সাহেবরা ছুটে এলেন। প্রথমে হুমকি ধমকি, পরে অনুরোধ-উপরোধ। একপর্যায়ে ট্রেন চলল বটে, তবে এই অপরাধে (!) কয়েকজনকে বদলি করা হলো। জসীমউদ্দিন মণ্ডলকেও বদলি করে দেওয়া হয় কাঠিহার লোকোইয়ার্ডে।
১৯৪২-এর আগস্টে শুরু হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সবার মুখে তখন একই ধ্বনি : কুইট ইন্ডিয়া, ডু অর ডাই, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। বুকভরা বেদনা নিয়ে জসীমউদ্দিন বলেন, 'সর্বাত্মক এই আন্দোলনে কতজনের যে প্রাণ যায়, তার হিসাব নেই।' প্রাণ দেন গান্ধীবুড়ি নামে খ্যাত মাতঙ্গিনী হাজরাও। সে বছরই অসুখে মারা যান জসীমউদ্দিন মণ্ডলের বাবা। এরপর পুরো সংসারের দায় চাপে তাঁর মাথায়।
ভাগ হয়ে গেল বাংলার হৃদয়
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল এই ভূখণ্ডের রাজনীতির জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলে চলেন তাঁর দেখা সেই সময়ের নানামুখী তৎপরতার কথা। ইংরেজদের কবল থেকে দেশ মুক্ত করার সংগ্রাম প্রবলভাবে এগিয়ে চলে, পাশাপাশি শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বিরোধ। অবশ্য ১৯০৫ সালে বাংলা দুই ভাগ (বঙ্গভঙ্গ) হওয়ার পর থেকেই হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি শুরু। পরবর্তী সময়ে এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগের রাজনীতি বেশ পোক্ত হয়। দাবি ওঠে হিন্দুদের জন্য একটি দেশ, মুসলমানদের জন্য আরেকটি দেশ। জসীমউদ্দিনের ভাষায়, 'এই বিভক্তির রাজনীতি করে ধনীগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ। এরা দুটি দল হলেও একই শ্রেণী-স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিপরীতে কমিউনিস্টরা, লাল ঝাণ্ডার প্রতিনিধিরা গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে। কিন্তু সেদিন এই কমিউনিস্টরা (এমনকি আজও) বেশি মানুষকে তাদের আদর্শে আকৃষ্ট করতে পারেনি। যে কারণে বিভেদ নামক একটি স্থায়ী ক্ষত দানা বাঁধতে শুরু করে (যার প্রকোপে-প্রভাবে আমরা আজও জ্বলে-পুড়ে মরছি)।'
১৯৪৭-এর আগস্টে উপমহাদেশ স্বাধীন হলো। রক্তের হোলি উৎসবের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের জন্ম হলো ভারত ও পাকিস্তান নামে। পাকিস্তান নামের দেশটির দুটি অংশ। এক অংশ পুবে এবং অন্য অংশ পশ্চিমে। এখানে বাংলা ভাগ হয়ে পুবের অংশ তথা পূর্ববাংলা হলো পাকিস্তানের অংশ।
কলকাতা ছেড়ে জসীম আসতে চাননি। কিন্তু তাঁকে বলা হলো, তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে যেতে হবে। জসীম মণ্ডল বলেন, 'আমার মুসলমানি নাম দেখে দরখাস্ত গ্রহণকারী হিন্দু কর্মকর্তাটি মনে করে থাকতে পারেন আমি ভুল করে ভারতে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছি: অথবা সেই সময়ে ধর্মীয় হিংসার কারণে ওই হিন্দু কর্মকর্তাটিও চাননি একজন মুসলমান ভারতে থেকে যাক।'
সাধারণ শ্রমিক থেকে নন্দিত নেতা
একজন কমিউনিস্ট হিসেবে জসীমউদ্দিন মণ্ডল নিজে কখনো চাননি ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হোক। যে কারণে তিনি নিজে যেখানে ছিলেন, সেই কলকাতায়ই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। মুসলিম_এই পরিচয় নিয়ে পাকিস্তানে আসতে চাননি। কিন্তু কী আর করা! চলে আসতে হলো। চলে আসেন ঈশ্বরদীতে। চেনা জায়গা। কাছেই নিজের জন্মস্থান। ঈশ্বরদীতে শ্বশুরবাড়ি। আর এর রেলস্টেশন, লোকোশেড সব কিছু তাঁর আপন। এখানেও তাঁর সেই কাজ। রেলে চড়া, বয়লারে কয়লা মারা। আর বাড়তি দলের কাজ।
দেশবিভাগের পরও কিছুদিন কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়নি। ১৯৪৮-এর শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি আলাদাভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করে। জ্যোতি বসু, বীরেন দাশগুপ্ত, মনসুর হাবিবের মতো নেতারা ভারতের অংশে আটকে পড়েন। দেশবিভাগের আগে রেল শ্রমিকদের নেতা হিসেবে জ্যোতি বসু শিলিগুড়ি, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, ঈশ্বরদী, শান্তাহার, রানাঘাট প্রভৃতি জায়গায় চষে বেড়িয়েছেন। পাকিস্তান পর্বে রেল শ্রমিকদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করতে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থাৎ রেলের পশ্চিমাঞ্চল জোনে জসীমউদ্দিন মণ্ডলও চরকির মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন।
কিন্তু দলীয় কর্মকাণ্ডে ঝক্কি অনেক। নতুন দেশ। মুসলমানের দেশ। পাকিস্তানি তথা পাঞ্জাবিরা রাজা। শরণার্থীদের চাপ অনেক। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। চালের দামও বেশ। ১৯৪৯ সালের কথা। এক জেলার চাল যাতে আরেক জেলায় না যায়, তা প্রতিরোধে সরকারের তৈরি করা মিলিশিয়ারা রেলে চেকিং করত। একদিন এভাবে চেক করে ইঞ্জিন বগিতে করে নিয়ে আসা জসীম মণ্ডলের তিন বস্তা চালও তারা রাজশাহী স্টেশনে নামিয়ে নেয়। এতে তাঁর নেতৃত্বে রেল স্ট্রাইক হয়। নিয়ে যাওয়া চাল ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে আর কোনো রেল চলাচল করেনি। সরকারের পক্ষে একজন ম্যাজিস্ট্রেট রেল কর্মচারীদের চাল আর মিলিশিয়ারা নামাবে না এমন লিখিত অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ট্রেন আবারও চালু হয়। এর ফল হিসেবে জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে সাসপেন্ড করা হয়।
রেল শ্রমিক নেতা হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালনকারী আন্দোলনটি হলো খুদবিরোধী আন্দোলন। সেই সময়ে রেল শ্রমিকদের দেওয়া হতো চালের বদলে খুদ। মুরগির খাবার খুদ শ্রমিকদের দিয়ে কর্মকর্তাদের ভালো চাল দেওয়া হতো। জসীমউদ্দিন মণ্ডলের নেতৃত্বে শুরু হয় এই খুদবিরোধী আন্দোলন। একটাই দাবি, সবাইকে চাল দিতে হবে। কোনো শ্রমিককে খুদ দেওয়া চলবে না। সমস্যা বর্ণনা করে জসীমউদ্দিনের দেওয়া বক্তব্যে সব রেল শ্রমিক একমত হন। গর্জে ওঠেন লোকোশেডের শ্রমিকরা। শেড খালাসিরা হাতের গাঁইতি-শাবল-কোদাল ফেলে দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান। পোর্টার, সান্টার, ফায়ারম্যান, ড্রাইভার সবাই কাজ বন্ধ করে দিয়ে শরিক হন মিছিলে। ঈশ্বরদীতে তখন ট্রেন এসে আটকা পড়ে। কোনো ট্রেন নড়ছে না। শ্রমিকরা কাজ করবেন না। আগে তাঁদের দাবির ব্যাপারে সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে, তবেই রেল চলবে।
বিকেল ৫টার দিকে পাবনা থেকে কয়েক লরি রিজার্ভ ফোর্স এসে পেঁৗছায়। তারা একদিকে রেল চালানোর উদ্যোগ নেয়; অন্যদিকে এই আন্দোলনের নেতাদের খুঁজতে থাকে। জসীমউদ্দিন তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী দেলওয়ারের সহায়তায় রেল কলোনিতে পালিয়ে যান। পরে রাতের একটি ট্রেনে জসীম মণ্ডল আর বিজন সেন পেঁৗছান আবদুলপুর স্টেশনে। সেখান থেকে হাঁটাপথে নাটোর হয়ে বাসুদেবপুর গ্রামের হালদারপাড়ায় গিয়ে ওঠেন গভীর রাতে। সেখানে ছিল পার্টির শক্তিশালী সংগঠন। দিন দুয়েকের মধ্যে জানা যায়, খুদবিরোধী আন্দোলন করায় জসীম মণ্ডলসহ মোট ছয়জনের নামে হুলিয়া জারি হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি মাস ছয়েকের মতো সেখানকার সাঁওতালপাড়ায় থাকেন। সাঁওতালদের সঙ্গে ক্ষেতে-খামারে কাজ করতেন। গায়ের রং ও শরীর খানিকটা তাঁদের মতো হওয়ায় কেউই কখনো তাঁকে সন্দেহ করেনি।
মাস ছয়েকের মাথায় একদিন ঈশ্বরদীতে এসে ওঠেন লোকোশেডের কমরেড সাহাবুদ্দিনের বাসায়। ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সেখান থেকেই তাঁকে এবং দেলওয়ারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। একসময় অতিপরিচিত রেলস্টেশন থেকে সবার সামনে দিয়ে স্কর্ট করে নিয়ে যায় তাঁদের। জসীমউদ্দিনকে পাঠানো হয় পাবনা জেলে, আর দেলওয়ারকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী জেলে। এরপর আর দেলওয়ারের সঙ্গে জসীমউদ্দিনের দেখা হয়নি। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে অন্যান্য কমিউনিস্ট বিপ্লবীর সঙ্গে দেলওয়ার শহীদী মৃত্যুবরণ করেন, যা ইতিহাসে খাপড়া বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
রেল শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে আন্দোলন ছাড়াও জসীমউদ্দিন মণ্ডল সে সময় উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের সঙ্গেও কাজ করেছেন। দিন, রাত তাঁরা সাঁওতালপাড়ায় অনেক মিটিং করেছেন। দিনে চলাফেরা করতে হতো লুকিয়ে, রাতেও সাবধানে। কারণ তখন মুসলিম লীগের পাকিস্তানি সরকার কমিউনিস্টদের ওপর বেজায় খেপা ছিল। তবে সাধারণের মাঝে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে একটি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। লীগ-কংগ্রেস দলের নেতা-কর্মীদের বিপরীতে কমিউনিস্টরা গরিব মানুষের উন্নয়নের কথা বলে, তারা সৎ, নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না, তাদের কাছে সমষ্টির স্বার্থবোধ অনেক বড় প্রভৃতি। জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'এ কারণে যেখানে গিয়েছি, মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি। কিছু পাওয়ার আশায় মানুষ আমাদের যত্ন-খাতির করেনি। তবে তারা জানত, আমরা ক্ষমতায় গেলে তাদের ভালো হবে।'
মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মানসিকতা জসীমউদ্দিন মণ্ডলের জেলজীবনেও অব্যাহত ছিল। পাবনা জেলে কয়েদি-হাজতিদের দিয়ে ঘানি (সরিষা, তিল, তিসি প্রভৃতি থেকে তেল তৈরির দেশীয় যন্ত্রবিশেষ, যা এখন প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে) টানানো হতো। জসীমউদ্দিন মণ্ডলকেও ঘানি টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বিদ্রোহ করে বসেন। না, ঘানি টানা হবে না। ঘানি টানে পশু। আমরা পশু নই যে ঘানি টানব। শুধু নিজে নয়, অন্যদেরও ঘানি টানা থেকে তিনি বিরত থাকার আহ্বান জানান। এই বিরোধে ঘানি টানার তদারককারী কয়েদিকে তিনি মারতে উদ্যত হন এবং দুটি ঘানি গাছ ভেঙে ফেলেন। এর জের ধরে জেলখানায় পাগলা ঘণ্টা বাজানো হয়। বেদম পিটুনি দিয়ে তাঁকে একটি সেলে নিয়ে উদোম শরীরে মেঝেতে পানি ঢেলে রাখা হয়। শীতের সময় শরীরে কাপড়বিহীন অবস্থা এবং মেঝের পানিতে তিনি সিঁটিয়ে যাওয়ার দশায় পড়েন। রাত ২টায় ডিউটিতে আসা প্রহরী তাঁর এই অবস্থা দেখে বিচলিত হন। তাঁকে কাপড়চোপড় দিতে চান। কিন্তু ওই প্রহরী বিপদে পড়তে পারেন এই বিবেচনা থেকে তিনি সেই সুযোগ নেননি।
কারা কর্তাদের এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে তিনি অনশন শুরু করেন। খাবার দিয়ে যাওয়া হয়; তিনি তা গ্রহণ করেন না। এভাবে কেটে যায় দুই দিন। জেলার তাঁকে ভয়-ভীতি দেখান। জসীম মণ্ডলের এক রা। অনশন ভাঙবেন না। তিনি বলেন, ডিসি (ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর, যাঁদের এখন ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার বা জেলা প্রশাসক বলা হয়) সাহেবকে জেলে আসতে হবে। খবর পেয়ে জেলখানায় ডিসি আসেন। ডিসি তো উদোম অবস্থায় একটি মানুষকে দেখেই মুখ লুকান। বলেন, 'একি, কাপড় পরুন।' সুযোগ পেয়ে জসীমউদ্দিন বলেন, 'কাপড় তো আপনার জেলার খুলে নিয়ে গেছে, আমার কাছে তো কোনো কাপড় নেই।' এই শুনে তিনি হতবাক বনে যান। এই অমানবিক আচরণের জন্য জেলারকে শাস্তি দেওয়া হবে বলে শাসিয়ে জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে কাপড় পরান। অনশন ভাঙার অনুরোধ করেন। এ সময় তিনি ডিসি সাহেবকে দিয়ে জেলখানায় আর মানুষ দিয়ে ঘানি না চালানো, খাবারের মান উন্নত করা প্রভৃতি দাবি আদায় করে নেন। ডিসি সাহেব অনশন ভাঙিয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে তবে ফেরেন।
এর পর তাঁকে পাঠানো হয় রাজশাহী জেলে। সেখানে গিয়েও আরেক ধরনের অশান্তি। এবার তাঁকে গম পিষতে বলা হলো। যথারীতি তিনি গম পিষতে অস্বীকার করলেন। জেল-জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তাঁকে কঠোরতর শাস্তি ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হলো। ডাণ্ডাবেড়ি পরানো থাকলে হাঁটতে-চলতে অসুবিধা হয়। পা ফুলে গিয়ে একসময় দগদগে ঘা হয়ে গেল। ডাণ্ডাবেড়ির ঘায়ের ক্ষতচিহ্ন এখনো জসীমউদ্দিন মণ্ডল বয়ে নিয়ে চলেছেন। পরে তাঁকে এই শাস্তি থেকে কেন যেন মাফ করে দেওয়া হয়। তবে বদলি করে দেওয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে।
সেই সময় ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে অনেক গুণী রাজনীতিক বন্দি ছিলেন। ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিক সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, নগেন সরকারসহ আরো অনেকে। এমনি এক সময় স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে তাঁর তিন দিনের প্যারোলে মুক্তি মেলে। তাঁকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ, জগন্নাথগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ হয়ে ঈশ্বরদীতে নিয়ে আসে। পথে পথে অসংখ্য মানুষ তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে। কেউ কেউ নিয়ে আসে ফুলের তোড়া, কেউ আনে খাবার। পথিমধ্যে নেতাকে দেখতে পাওয়া আর তাঁকে একটু যত্ন করার সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চায়নি। মানুষের এই ভালোবাসায় বিমুগ্ধ জসীমউদ্দিন। ১৯৫৫ সালের দিকে জেল থেকে ছাড়া পান জসীমউদ্দিন মণ্ডল।
মুক্তিযুদ্ধের আগে, মুক্তিযুদ্ধকালে
পাকিস্তান পর্বে দুই দফায় মোট আট বছরের মতো তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। আর রেল শ্রমিকদের পক্ষে খুদবিরোধী আন্দোলন করার অপরাধে (!) তাঁর রেলের চাকরি চলে যায়। চাকরিবিহীন রেল শ্রমিক নেতা জসীমউদ্দিন মণ্ডল তখন পুরো সময়টি রাজনীতির জন্য ব্যয় করেন। তিনি তখনো জেলে। ১৯৬৩ সালের দিকে জেলের মধ্যেই কমিউনিস্ট রাজনীতির মতাদর্শগত বিভেদ চাঙ্গা হয়। মাও সে তুংয়ের চিন্তা ও তাঁর গেরিলা যুদ্ধের কৌশলে অনেকেই আকৃষ্ট হন। নতুন কমরেডরা দলে ভেড়েন, আর তাঁরা নতুন তত্ত্বের জয়গান করতে থাকেন। আলাউদ্দিন, মতিন, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আবদুল হক, তোয়াহা প্রমুখ নেতা তখন মাও অনুসারী। মাও সে তুংয়ের বই তখন তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান। পূর্ব বাংলায় বিপ্লবের পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে তাঁরা তখনই সশস্ত্র লড়াই শুরু করার আহ্বান জানান।
জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'এ ধারার বিপরীতে আমরা যাঁরা অবস্থান করছিলাম, তাঁদের তারা সংশোধনবাদী হিসেবে আখ্যা দেয়। বলতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ।' তখন থেকেই গোপন কমিউনিস্ট দলের রাজনীতিতে চীন ও সোভিয়েত তথা মস্কো অনুসারী নামের দুটো ধারা তৈরি হয়।
কিছুদিন পর পূর্ব বাংলায় শুরু হয়ে যায় আরেক বিপর্যয়। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। তখন আইয়ুব খানের প্রচারযন্ত্র অন্ধভাবে ভারতবিরোধিতা শুরু করে। স্লোগান ওঠে, 'কাফের ধ্বংস করো।' চীনা রেডিওতেও ভারতবিরোধী প্রচারণা ঠাঁই করে নেয়। এ অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে জসীমউদ্দিন মণ্ডল লিখেছেন, 'এই উগ্র যুদ্ধংদেহী প্রচারণা পূর্ব বাংলার মানুষকে সাময়িকভাবে হলেও বিভ্রান্ত করে তুলল। এ সময় ন্যাপের কিছু কর্মী, এমনকি পার্টির কিছু কর্মীও যুদ্ধ উন্মাদনায় মেতে উঠল। কমিউনিস্ট পার্টি অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রচার করল।' (পৃ. ৮৪, সংগ্রামী স্মৃতিকথা জীবনের রেলগাড়ি_জসীমউদ্দিন মণ্ডল)।
সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারীদের একটি অংশ ন্যাপের সঙ্গে কাজ করত। তখন ন্যাপ নেতা মওলানা আবদুুল হামিদ খান ভাসানী। এই ভাসানীর সঙ্গে জসীমউদ্দিন মণ্ডল দেশের উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রচারণা সভা করেছেন। এসব প্রচারণা সভায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধের ভয়াবহ দিকগুলো তুলে ধরা হতো। যুদ্ধের উন্মাদনা থাকলেও অতি দ্রুত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে এর প্রতিক্রিয়া পড়ায় মানুষ এর বীভৎসতা সম্পর্কে আঁচ করতে পারছিল। তাঁরা দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বোদা, নবাবগঞ্জ, শিবপুর, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক সভা করে আইয়ুবী শাসনের কৌশল এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। মানুষও তাঁদের কথা অনুধাবন করতে শুরু করে।
পরবর্তী সময়ে ন্যাপ দুই ভাগ হয়ে যায়। রিকুইজিশন ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ। তখন জসীমউদ্দিন মণ্ডল ন্যাপের এই অংশের সঙ্গে মিশে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে কমিউনিস্ট পার্টিতে দ্বিধা-বিভক্তি আসে। তখনো দলের কর্মকাণ্ড গোপনে পরিচালিত হতো। একটি অংশ সশস্ত্র সংগ্রামের সমর্থক, যারা মাও অনুসারী; অন্য অংশ সোভিয়েত অনুসারী।
১৯৬৮ সালে আইয়ুব শাহী তাঁর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচারের জন্য উন্নয়ন দশক উদ্যাপন করেন। বিপরীতে ফুঁসে থাকা মানুষ আইয়ুব শাহীর পতন, বিডি সিস্টেম বাতিল ও সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে গণ-আন্দোলন শুরু করে। ঈশ্বরদীতেও তখন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি (ডাক) গঠিত হয়। যা গড়ে তোলার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন জসীমউদ্দিন মণ্ডল এবং কমিউনিস্ট পার্টির মস্কোপন্থী অনুসারীরা। আইয়ুববিরোধী এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাও অনুসারী কমিউনিস্টরা অংশ না নিয়ে বরং তারা একটি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ার ১৬ দিন পর নগরবাড়ী ঘাট থেকে রাস্তার দুই ধারের বাড়িঘর জ্বালাতে জ্বালাতে ঈশ্বরদীতে এসে পেঁৗছায় তারা। জসীমউদ্দিন মণ্ডল তখন ছিলেন তাঁদের তৈরি করা কন্ট্রোল রুমে। সেখানে খবর এল দ্রুত এলাকা ত্যাগ করার। তিনি দ্রুত বাড়ি এসে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাস্তায় চার দিন কাটিয়ে গোড়ালি সীমান্তের ফিঙ্গিতলায় পেঁৗছান। সেখান থেকে করিমপুর হয়ে কৃষ্ণনগর এবং পরে কলকাতায় পেঁৗছান। কলকাতায় তিনি ওঠেন তাঁর পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী নাচোলের রানিমা ইলা মিত্রের বাড়িতে। ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র খুবই সাদরে তাঁদের গ্রহণ করেন। তাঁরাই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন। একে একে রাজনৈতিক সহকর্মী মণি সিং, রতন সেন, রণেশ মৈত্র প্রমুখের সঙ্গে দেখা হয়। শুরু হয় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের সঙ্গে তখন সভা-সমাবেশে জসীমউদ্দিন মণ্ডল বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতাযুদ্ধের অনিবার্যতা এবং এতে দুনিয়ার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যে সমর্থন করা উচিত, সেই যুক্তি তুলে ধরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ান।
স্বাধীন দেশে
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই তিনি দেশে ফেরেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রীর তিল তিল শ্রমে গড়ে তোলা দোচালা ঘর দুটো বিহারিরা পুড়িয়ে দেয়। স্বাধীন দেশে সংসার চালানোর জন্যে সেই ১০ কাঠা জমিও বিক্রি করে দিতে হয়। থাকার জায়গার জন্য ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের পাশে ছয় শতক পরিত্যক্ত সম্পত্তি বরাদ্দ নেন। বরাদ্দের জন্য প্রয়োজনীয় ৩২ হাজার টাকা জোগাড় হয় রেল শ্রমিক ইউনিয়ন, দলীয় ফান্ড এবং শুভানুধ্যায়ীদের দেওয়া অর্থে। এখনো রেললাইনের কাছে ওই জমিতেই তিনি বসবাস করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরিতে ন্যাপ তথা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী-অনুসারীদের একটি বড় ভূমিকা থাকায় জসীমউদ্দিনের মনে হয়েছিল, এবার দেশে শান্তি আসবে। এই প্রত্যাশা তাঁর আরো বেড়ে যায়, যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় মূলনীতির একটি হিসেবে 'সমাজতন্ত্র'কে বেছে নেন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সমাজতান্ত্রিক আদর্শিক চেতনায় জারিত হওয়ায় তিনি দলের কর্মকাণ্ডে আরো সময় দিতে শুরু করেন। জীবনের শুরুতে সংসারের প্রয়োজনে জসীমউদ্দিন মণ্ডল চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু গরিব মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিপূরক রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন, সেই কাজটিকে প্রধান কর্তব্য বিবেচনা করায় আর কখনোই পরিবারের দায়-দায়িত্ব পালন করা হয়ে ওঠেনি। স্ত্রী মরিয়ম ওরফে জাহানারার অসীম ধৈর্য ও বিচক্ষণতায় এবং স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় তাঁর সংসারের খরচ মিটেছে।
১৯৭৩ সালে জসীমউদ্দিন মণ্ডল মস্কো সফরে যান। সেখানকার অভাবনীয় উন্নতি, মানুষের প্রতি মানুষের দরদবোধ, সব কিছুতে পরিপাটি ও স্নিগ্ধতার ছাপ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশটি আবারও উল্টোপথে যাত্রা শুরু করলে তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েন। এ সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দুই বছর জেলে কাটাতে হয়। জসীমউদ্দিনের মতে, ওই সময়টা ছিল বড় খারাপ। সমাজতন্ত্রের প্রতি গোটা বিশ্বে নানাভাবে আক্রমণ হচ্ছিল। আর দেশে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। ১৯৭৯ সালে নির্বাচন দিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার নামে রাষ্ট্রপতির শাসন শুরু হয়। এর তিন বছর পর আবারও এরশাদের সামরিক শাসন। এরশাদবিরোধী আট বছরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শুরু হয়। তবে এর মধ্য দিয়ে দেশে আবারও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। স্বৈরাচারী এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। আর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সমাজতন্ত্রের ওপর একের পর এক আক্রমণ চলতে থাকে। চলে শীতল যুদ্ধের নানা রকমফের। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নেয়। দেশটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন আর সমাজতন্ত্রের পরাজয় জসীমউদ্দিন মণ্ডলকে হতবাক করে তোলে; আর সেই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী মরিয়ম। তিনি এটি একেবারে মেনে নিতে পারেননি। কেন এমন হলো? সমাজতন্ত্র কি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়? জবাবে জসীমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, 'মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এখনো অজেয়। এই দর্শনের ভিত্তিতে সমাজবিপ্লব সম্পন্ন হবে। আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে গরিব-মেহনতি মানুষের মুক্তি আসবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যা ঘটেছে, তা সাময়িক বিপর্যয় মাত্র।' তিনি আরো বলেন, 'মনে রাখতে হবে, মার্কসবাদী দর্শনের প্রয়োগ হচ্ছে সমাজে। এখানে নানা চিন্তার মানুষের বসবাস। ব্যক্তি-আকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তি-সম্পত্তির মোহ কাটানো বড় দুঃসাধ্য ও কষ্টকর। এ কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে। বিপর্যয় ঘটা মানে এ কথা বলা যাবে না যে দর্শন মিথ্যা। আর একটি কথা, যারা পুঁজিবাদী তথা বাজার-অর্থনীতির মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে চেয়েছে, আমরা তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তারা কী উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তাদের উন্নয়ন হচ্ছে, একদিকে চাকচিক্য, অন্যদিকে হাহাকার। আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর অবস্থা তো একই। উপরন্তু এরা এদের স্বার্থে দেশে দেশে যুুদ্ধ-সংঘাত বাধিয়ে রেখেছে। আমেরিকা স্বাধীন দেশ ইরাকে টন টন বোমা ফেলে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে মদদ দেয়। আবার এরাই মানবাধিকারের কথা বলে। সত্যিই বিচিত্র!' তাঁর মতে, মার্কসবাদী দর্শনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজে সব মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করা সম্ভব।
পরিবার, স্বজন ও কাছের বন্ধুরাও এই মানুষটির রাজনৈতিক চেতনা, মার্কসবাদী দর্শনের প্রতি আস্থা এবং উন্নততর নৈতিক বোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। জসীমউদ্দিনের কাছের বন্ধু রেল শ্রমিক মো. আবদুল আজিজ তাঁর সম্পর্কে বলেন, '১৯৫৭-৫৮ সাল থেকে জসীম ভাইকে চিনি। দেখেছি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁর অগাধ, প্রশ্নাতীত। জীবনে কখনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কিছু করেননি। মানুষের ভালোর জন্যে সব কিছু করার চেষ্টা করেছেন। আর বর্তমান রাজনীতির যে খাইখাই দশা সেটির সঙ্গে জসীমউদ্দিন মণ্ডল একেবারে বেমানান।'
প্রায় একই কথা বলেন রেল শ্রমিক নেতা শাহ আলম। তিনি জসীম মণ্ডলকে একেবারে কাছ থেকে দেখছেন ১৯৬২ সাল থেকে। তিনি বলেন, 'জসীম ভাই আমাদের শিখিয়েছেন, শ্রমিকরাও মানুষ। শ্রমিকদের অধিকার কেউ দিয়ে দেবে না; অধিকার আদায় করে নিতে হবে। সংগ্রামটি রাজনৈতিক। আর কাজটি সমাজবিপ্লব। বৈজ্ঞানিক আদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে এই সমাজবিপ্লব সম্পন্ন হবে। এ কারণে শ্রমিকশ্রেণীকে সংগঠিত হতে হবে। শ্রেণী আদর্শের রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে হবে। সে জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করেছি; পাশাপাশি সিপিবির (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছি। আমাদের আদর্শ জসীম ভাই।'
জসীমউদ্দিন মণ্ডল আজও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে সমানে বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। গ্রামের কৃষক আর শহরের শ্রমিকের জন্য অতি সহজভাবে তিনি কথা বলতে পারেন বলে তাঁর বক্তৃতার বেশ চাহিদাও আছে। তিনি বলেন, 'যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সাম্যবাদী সমাজের পক্ষে মানুষকে বলে যাব। আমার লক্ষ্য ছিল এই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। আমার জীবদ্দশায় এই আদর্শের প্রতিষ্ঠা হলো না। তবে একদিন এই আদর্শ প্রতিষ্ঠা পাবেই। তা না হলে গরিব-মেহনতি মানুষের মুক্তি নেই।' তিনি আরো বলেন, 'অনেকে আমাকে বলেন, রাজনীতি করে কী পেয়েছি, তাঁরা হয়তো টাকা-পয়সা, ধন-দৌলতের কথা বলতে চান; আমি তো টাকা-পয়সা বা ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির জন্য রাজনীতি করিনি। আমার রাজনীতি ছিল একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য। আদর্শের প্রতিষ্ঠা হয়তো হয়নি। তবে একদিন হবেই।'
No comments