শ্রদ্ধাঞ্জলি-তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ by রাশেদা কে চৌধূরী
চলে গেলেন সেই মানুষটি—স্যামসন এইচ চৌধুরী। যাঁর হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে এসেছে স্কয়ার গ্রুপ, বিশাল মহীরূহের ছায়াতলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্পোদ্যোগ। বিন্দু বিন্দু প্রয়াসে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল সিন্ধুর মতো শিল্পাঙ্গন। পাবনার আতাইকুলায় যাঁর জন্ম, যাঁর প্রথম কর্মোদ্যোগের সূচনা মফস্বলের একটি ছোট্ট শহরে তিনজন সহকর্মী নিয়ে, তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞের ফসল আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র, ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক
পরিমণ্ডলে। তিনজন সহকর্মীর ছোট্ট এই উদ্যোগ আজ প্রায় অর্ধ লক্ষ কর্মজীবীর বিশাল শিল্প গ্রুপে পরিণত হয়েছে।
প্রয়াত এই মানুষটি সম্পর্কে আজ আমরা কত কিছু জানতে পারছি, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে কত বিশিষ্টজন তাঁকে স্মরণ করছেন, তাঁরই স্বপ্নের ফসল টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত হচ্ছে তাঁর কর্মময় জীবনের প্রামাণ্য চিত্র্বপ্রাতঃস্মরণীয় এক ব্যক্তিত্বের কর্মযজ্ঞের কত বিচিত্র ইতিহাস, যাপিত জীবনের জয়গাথা। এত বড়মাপের একজন মানুষের বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর জীবনকাহিনি এভাবে তুলে ধরা হয়তো সম্ভব, কিন্তু মানুষের জন্য তাঁর মমত্ববোধ, দেশের জন্য তাঁর স্বপ্নের বিশালতা, সহকর্মীদের জন্য তাঁর অপার মননশীলতাকে কি তেমন করে জনসমক্ষে তুলে ধরা সম্ভব? কত যশস্বী সুধীজন, কত সংবেদনশীল মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
কিন্তু গত তিন দশকে পারিবারিক বন্ধুত্বের সুবাদে আমাদের সবার প্রিয় স্যামসন দাদাকে যেভাবে দেখেছি, যেমনটি জেনেছি তা তো কিছুতেই ভোলার নয়। অনেক আগ্রহের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছিলাম স্যামসন দাদা এ দেশে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। প্রাণের আকুতি থেকে গড়ে তুলেছেন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আর অনেকগুলোর উন্নয়নেও ছিল তাঁর অবদান। কী করে এ দেশের বেকার জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করা যায়, তা নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছিল তাঁর। একদিন আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা, তোমরা কী করছ? আমাদের নতুন প্রজন্ম না শিখছে বাংলা, না রপ্ত করছে অন্য কোনো ভাষা?’ আমি তাঁর প্রশ্নের জুতসই উত্তর দেওয়ার আগেই আবার বলে উঠলেন, ‘পৃথিবীটা যেভাবে এগোচ্ছে, আমরা যদি না এগোই তাহলে কী করে হবে? বাংলা ও ইংরজি দুুটো ভাষা না জানলে তো হবে না।’ আমি হেসে বললাম, ‘দাদা, অনেক ইংরেজিমাধ্যম স্কুল থেকে অনেক শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছে, যারা চটপট করে ইংরেজি বলাটা রপ্ত করেছে....।’ আমার কথা শেষ হলো না। দাদা বললেন, ‘ওদের কথা ভেবে কী হবে? ওরা তো সব দেশের বাইরে ঘাঁটি গাড়বে। আমাদের মূলধারার শিক্ষায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে কোনো পরিবর্তনই দৃশ্যমান হবে না, দেশটাও এগোবে না।’ এই ছিল স্যামসন চৌধুরীর ভাবনা—দেশের কিছু সুবিধাভোগী মানুষের জন্য নয়, মূলধারার আপামর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু শুধু স্বপ্নবিলাস নয়, অসম্ভব পরিশ্রম আর অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে প্রমাণও করে গেছেন যে স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব।
প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় আগে আমরা জনাবিশেক মানুষ রোটারি ক্লাবের উদ্যোগে গিয়েছিলাম উজবেকিস্তান, আনন্দ সফরে, স্যামসন দাদার নেতৃত্বে। দাদা-বউদিকে সঙ্গে নিয়ে কত ঐতিহাসিক স্থানে ছোটাছুটি, সকাল-সন্ধ্যা অনিতা বউদির সঙ্গে কত খুনসুটি! দাদার সেই প্রাণখোলা কথাবার্তা, বউদির মিষ্টি হাসির সেই স্মৃতির সঙ্গে আজ মনে পড়ছে একটি ঘটনা। সেই সফরে আমরা কয়েকজন ঠিক করলাম তাসখন্দের কাছেই বুখারা শহরে মুসলিম সাধক বুখারি (রহ.)-এর সমাধিস্থল পরিদর্শনে যাব। সেদিন আমাদের সাধারণ চিন্তা-চেতনা থেকে আমরা ধরে নিয়েছিলাম স্যামসন দাদারা হয়তো বুখারি সমাধিতে যাবেন না। কিন্তু শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে গেল যখন দাদা সোচ্চার কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কেন যাব না? যে মানুষ অন্যের ধর্মকে সম্মান দিতে জানে না, সে নিজের ধর্মকেও ছোট করে।’
স্যামসন চৌধুরীকে সবাই চেনে একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তারূপে, একজন অসাধারণ পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে। তাঁর ঔদার্য্য আর সংবেদনশীলতা জিয়নকাঠির মতো স্পর্শ করত তাঁর আশপাশের সব মানুষকে, সেটা জানে কতজন! তাঁর স্ত্রী ও দীর্ঘদিনের পথচলার সাথি অনিতা চৌধুরীকে তিনি যে মর্যাদার সঙ্গে, যে অন্তহীন ভালোবাসায় সম্মান করে চলতেন, তা এ দেশের যেকোনো নারীর আরাধ্য বস্তু হতে পারে। তাঁর পারিবারিক সূত্রে শুনেছি, দাদা-বউদির সংস্রবে থেকেও দেখেছি, জীবনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় স্যামসন চৌধুরী তাঁর জীবনসঙ্গীর সঙ্গে আলাপ করে চূড়ান্ত করতেন। অফুরন্ত ভালোবাসার সঙ্গে অবিচল আস্থার সংমিশ্রণে ভরপুর এই যুগলের জীবনগাথা আজ আমাদের অনুসরণীয় হতে পারে।
আমাদের সমাজ যখন এক সর্বগ্রাসী অস্থিরতায় আক্রান্ত, ক্রমবর্ধমান পারিবারিক সহিংসতা যখন নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে, তখন এমন একজন ক্ষণজন্মা, সংবেদনশীল মানবসন্তানের প্রয়াণে আমাদের অন্তরে রক্তক্ষরণ তো হবেই। তবুও মৃত্যুর অমোঘ বিধান আমাদের মানতেই হবে। শুধু প্রার্থনা, স্যামসন চৌধুরীর বিদেহী আত্মা শান্তি পাক—তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, তাঁর প্রাণের শিল্পোদ্যোগগুলো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করুক। ‘স্যামসন দাদা, আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, আমরা আপনাকে ভুলব না।’
রাশেদা কে চৌধূরী: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান।
প্রয়াত এই মানুষটি সম্পর্কে আজ আমরা কত কিছু জানতে পারছি, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে কত বিশিষ্টজন তাঁকে স্মরণ করছেন, তাঁরই স্বপ্নের ফসল টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত হচ্ছে তাঁর কর্মময় জীবনের প্রামাণ্য চিত্র্বপ্রাতঃস্মরণীয় এক ব্যক্তিত্বের কর্মযজ্ঞের কত বিচিত্র ইতিহাস, যাপিত জীবনের জয়গাথা। এত বড়মাপের একজন মানুষের বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর জীবনকাহিনি এভাবে তুলে ধরা হয়তো সম্ভব, কিন্তু মানুষের জন্য তাঁর মমত্ববোধ, দেশের জন্য তাঁর স্বপ্নের বিশালতা, সহকর্মীদের জন্য তাঁর অপার মননশীলতাকে কি তেমন করে জনসমক্ষে তুলে ধরা সম্ভব? কত যশস্বী সুধীজন, কত সংবেদনশীল মানুষের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
কিন্তু গত তিন দশকে পারিবারিক বন্ধুত্বের সুবাদে আমাদের সবার প্রিয় স্যামসন দাদাকে যেভাবে দেখেছি, যেমনটি জেনেছি তা তো কিছুতেই ভোলার নয়। অনেক আগ্রহের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছিলাম স্যামসন দাদা এ দেশে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। প্রাণের আকুতি থেকে গড়ে তুলেছেন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আর অনেকগুলোর উন্নয়নেও ছিল তাঁর অবদান। কী করে এ দেশের বেকার জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করা যায়, তা নিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছিল তাঁর। একদিন আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা, তোমরা কী করছ? আমাদের নতুন প্রজন্ম না শিখছে বাংলা, না রপ্ত করছে অন্য কোনো ভাষা?’ আমি তাঁর প্রশ্নের জুতসই উত্তর দেওয়ার আগেই আবার বলে উঠলেন, ‘পৃথিবীটা যেভাবে এগোচ্ছে, আমরা যদি না এগোই তাহলে কী করে হবে? বাংলা ও ইংরজি দুুটো ভাষা না জানলে তো হবে না।’ আমি হেসে বললাম, ‘দাদা, অনেক ইংরেজিমাধ্যম স্কুল থেকে অনেক শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছে, যারা চটপট করে ইংরেজি বলাটা রপ্ত করেছে....।’ আমার কথা শেষ হলো না। দাদা বললেন, ‘ওদের কথা ভেবে কী হবে? ওরা তো সব দেশের বাইরে ঘাঁটি গাড়বে। আমাদের মূলধারার শিক্ষায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে কোনো পরিবর্তনই দৃশ্যমান হবে না, দেশটাও এগোবে না।’ এই ছিল স্যামসন চৌধুরীর ভাবনা—দেশের কিছু সুবিধাভোগী মানুষের জন্য নয়, মূলধারার আপামর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু শুধু স্বপ্নবিলাস নয়, অসম্ভব পরিশ্রম আর অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে প্রমাণও করে গেছেন যে স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব।
প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় আগে আমরা জনাবিশেক মানুষ রোটারি ক্লাবের উদ্যোগে গিয়েছিলাম উজবেকিস্তান, আনন্দ সফরে, স্যামসন দাদার নেতৃত্বে। দাদা-বউদিকে সঙ্গে নিয়ে কত ঐতিহাসিক স্থানে ছোটাছুটি, সকাল-সন্ধ্যা অনিতা বউদির সঙ্গে কত খুনসুটি! দাদার সেই প্রাণখোলা কথাবার্তা, বউদির মিষ্টি হাসির সেই স্মৃতির সঙ্গে আজ মনে পড়ছে একটি ঘটনা। সেই সফরে আমরা কয়েকজন ঠিক করলাম তাসখন্দের কাছেই বুখারা শহরে মুসলিম সাধক বুখারি (রহ.)-এর সমাধিস্থল পরিদর্শনে যাব। সেদিন আমাদের সাধারণ চিন্তা-চেতনা থেকে আমরা ধরে নিয়েছিলাম স্যামসন দাদারা হয়তো বুখারি সমাধিতে যাবেন না। কিন্তু শ্রদ্ধায় মাথাটা নত হয়ে গেল যখন দাদা সোচ্চার কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘কেন যাব না? যে মানুষ অন্যের ধর্মকে সম্মান দিতে জানে না, সে নিজের ধর্মকেও ছোট করে।’
স্যামসন চৌধুরীকে সবাই চেনে একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তারূপে, একজন অসাধারণ পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে। তাঁর ঔদার্য্য আর সংবেদনশীলতা জিয়নকাঠির মতো স্পর্শ করত তাঁর আশপাশের সব মানুষকে, সেটা জানে কতজন! তাঁর স্ত্রী ও দীর্ঘদিনের পথচলার সাথি অনিতা চৌধুরীকে তিনি যে মর্যাদার সঙ্গে, যে অন্তহীন ভালোবাসায় সম্মান করে চলতেন, তা এ দেশের যেকোনো নারীর আরাধ্য বস্তু হতে পারে। তাঁর পারিবারিক সূত্রে শুনেছি, দাদা-বউদির সংস্রবে থেকেও দেখেছি, জীবনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় স্যামসন চৌধুরী তাঁর জীবনসঙ্গীর সঙ্গে আলাপ করে চূড়ান্ত করতেন। অফুরন্ত ভালোবাসার সঙ্গে অবিচল আস্থার সংমিশ্রণে ভরপুর এই যুগলের জীবনগাথা আজ আমাদের অনুসরণীয় হতে পারে।
আমাদের সমাজ যখন এক সর্বগ্রাসী অস্থিরতায় আক্রান্ত, ক্রমবর্ধমান পারিবারিক সহিংসতা যখন নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে, তখন এমন একজন ক্ষণজন্মা, সংবেদনশীল মানবসন্তানের প্রয়াণে আমাদের অন্তরে রক্তক্ষরণ তো হবেই। তবুও মৃত্যুর অমোঘ বিধান আমাদের মানতেই হবে। শুধু প্রার্থনা, স্যামসন চৌধুরীর বিদেহী আত্মা শান্তি পাক—তাঁর প্রিয় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, তাঁর প্রাণের শিল্পোদ্যোগগুলো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করুক। ‘স্যামসন দাদা, আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, আমরা আপনাকে ভুলব না।’
রাশেদা কে চৌধূরী: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান।
No comments