পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ-আইন প্রণয়নের উদ্যোগটি ভালো, তবে... by শেখ হাফিজুর রহমান

ত ২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি একটি শুভ উদ্যোগ বলেই মনে করি। জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলে এটি পূর্ণাঙ্গ আইনে পরিণত হবে। এ আইনে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ এই আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে এ


আইনের বিচার করা হবে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারকে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হলো এবং কোন অবস্থায় চূড়ান্তভাবে আইনটিকে পাস করতে হচ্ছে, সে বিষয়ে আলোচনা দরকার। বাংলাদেশকে অনেকেই ‘মডারেট ইসলাম’ বা ‘উদার ইসলামে’র দেশ বলেন বা বলতে ভালোবাসেন। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও গড়পড়তা মানুষের মূল্যবোধের বিচারে বাংলাদেশের সমাজকে অনেকে ‘রক্ষণশীল’ বলবেন। কিন্তু সেই ‘মডারেট ইসলামে’র দেশ বা ‘রক্ষণশীল’ সমাজ যখন পরপর পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে থাকে, মাদক ও পর্নোগ্রাফি যখন সেই সমাজের হূৎপিণ্ডকে খামচে ধরে, ‘ইভ টিজিং’ বা বখাটে ছেলেদের উৎপাতে যখন মেয়েদের আত্মহত্যা করতে হয়, তখন খটকা লাগে। মনে হয়, এত দিন সমাজ ও মানুষের কর্মকাণ্ডের ওপর মূল্যবোধের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল, সেই নিয়ন্ত্রণ একেবারেই ভেঙে পড়েছে। অথবা বিষয়টা এমন যে শিক্ষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে কোনো নৈতিকতাই আমরা গ্রহন করছিনা। ভোগবাদী ও বাজারমুখী এক ব্যবস্থার মধ্যে যার যার বস্তুগত লক্ষ্য অর্জনে উন্মত্ত হয়ে পড়েছি। মানুষ আর পশুর মধ্যে তফাৎ আছে বলে এত দিন যা জানতাম, সে তফাৎটি আস্তে আস্তে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
পর্নোগ্রাফি বলতে প্রকাশ্যে যৌনতাকে দেখানো। পর্নো ইন্ডাস্ট্রি বা পর্নো শিল্প প্রকাশ্য যৌনদৃশ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাত ও বিপণন করে প্রাপ্তবয়স্কদের চিত্তবিনোদনের জন্য। নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্কের প্রকাশ্য প্রদর্শন বা উপস্থাপন সভ্যতার আদিকাল থেকেই নানাভাবে হয়েছে। সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ও স্থাপত্যে নানাভাবে যৌনতাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যৌনতার শিল্পসম্মত উপস্থাপন শিল্প, সাহিত্য ও জীবনবোধকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু টেলিভিশন, ভিডিও ও ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর ‘প্রাপ্তবয়স্কদের চিত্তবিনোদন’ বা মনোরঞ্জনের কথা বলে পর্নো ইন্ডাস্ট্রিগুলো সারা বিশ্বে যে পর্নোবাণিজ্য শুরু করেছে সমাজের ওপর তার ফলাফল খুবই মারাত্মক। একদিকে বিভিন্ন দেশে পর্নোগ্রাফির রয়েছে বিপুল চাহিদা, অন্যদিকে এর পেছনে রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী এক অর্থনীতি। ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে তিন হাজার ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আড়াই লাখ টাকা) বেশি ব্যয় হচ্ছে পর্নোগ্রাফির পেছনে। এ থেকেই বোঝা যায় যে পর্নো ইন্ডাস্ট্রি বিশ্ব অর্থনীতিতে কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পর্নোশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা ২০০৬ সালে চীনে ২৭.৪০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন। (যদিও পর্নোগ্রাফির উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন চীনে আইনত নিষিদ্ধ) ২০০৬ সালে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫.৭৩ বিলিয়ন ডলার, জাপানে ১৯.৯৪ বিলিয়ন ডলার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৩.৩৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন।
সারা বিশ্বের দেশে দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে পর্নোগ্রাফি থেকে। ‘প্রাপ্তবয়স্কের অধিকার’, ‘নিষিদ্ধ চাহিদা’ ও অর্থনীতির শক্তিতে চলছে পর্নোশিল্প। কিন্তু পর্নোশিল্প যে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করছে তা শিশু, নারী-পুরুষ ও সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষাক্ত সব দূষণ। শিশু পর্নোগ্রাফি বিষিয়ে দিচ্ছে কোমলমতি শিশুদের সুন্দর মন। পর্নোগ্রাফির ক্ষতিকর প্রভাবে বাড়ছে ধর্ষণ, যৌন অপরাধ এবং পুরুষ ও নারীর বিপথগামী আচরণ। ভিক্টোরিয়ান যুগে পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীল ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিল। ব্রিটেনে পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল অবসিনিটি পাবলিকেশনস অ্যাক্ট ১৮৫৭-এর মাধ্যমে। বর্তমানে অ্যামেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশে পর্নোগ্রাফি বৈধ, প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের একটি প্রধান মাধ্যম। তবে শিশু পর্নোগ্রাফি, পাশবিকতা ও নিষ্ঠুর যৌনতার প্রদর্শনীর ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ওসব দেশের পর্নোগ্রাফি আইনের সারকথা হচ্ছে, প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ স্বেচ্ছায় পর্নো ফিল্মে অংশ নিতে পারবে। প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ ওয়েবসাইট থেকে বা দোকান থেকে পর্নোগ্রাফির ভিডিও কিনে তা দেখতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকবার পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণনকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রণীত আইনকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে এ যুক্তিতে যে ওই আইনগুলো নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন। উপরন্তু, যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে মারাত্মক এক স্ববিরোধ। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রে পতিতাবৃত্তি অবৈধ, কিন্তু পর্নোগ্রাফি বৈধ। এ স্ববিরোধ নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক। তবে পশ্চিমের দেশগুলোতে শিশু পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ। এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের পর্নোগ্রাফি দেখার কোনো অনুমোদন আইনে নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে, এ আইন মানানো যেমন খুব কঠিন, আবার অনেক ক্ষেত্রে এ আইন মানাও হয় না।
বাংলাদেশ পশ্চিমের মুক্ত সমাজ এবং পশ্চিমের প্রভাবে প্রভাবিত অনেক এশিয়ান সমাজ থেকে ভিন্ন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, প্রচলিত মূল্যবোধ ও ধর্ম পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল ছবির উৎপাদন, সংরক্ষণ বাজারজাতকরণ ও প্রদর্শনীকে অনুমোদন করে না। কিন্তু কেব্ল টেলিভিশন, ভিডিও ও ইন্টারনেটের দৌলতে অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল ছবি ও চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী চলছে। এর ফলে যৌন অপরাধ, পুরুষের যৌন আচরণে হিংস্রতা ও বিপথগামিতা বেড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গত কয়েক বছরে আরেকটি প্রবণতা সমাজের সবাইকে খুব নাড়া দিয়েছে, আর সেটি হলো একশ্রেণীর পুরুষ মেয়েদের বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে। গোপনে এটিকে ভিডিও করে ওই পুরুষরা তখন চড়া দামে ভিডিওটি বিক্রি করে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। এভাবে অনেক মেয়ে প্রতারিত এবং সামাজিক নিগ্রহের শিকার হয়েছে। গত কয়েক বছরে আরও দুটি প্রবণতা রাহুর মতো পুরো সমাজকে গ্রাস করতে বসেছে। একটি হচ্ছে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি অথবা অশ্লীল ছবির বিপণন। মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল ছবি আপলোড করে তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্রীদের মোবাইলে। অন্য প্রবণতাটি আরও ভয়াবহ। কিশোর প্রেমিক তার মোবাইল ফোনে কিশোরী প্রেমিকার স্পর্শকাতর ছবি তুলে ওই ছবি দিয়ে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করছে।
এ ধরনের সামাজিকভাবে বিপজ্জনক একটি অবস্থায় বর্তমান মন্ত্রিসভা পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১-এর খসড়াটি অনুমোদন করে একটি ভালো কাজ করেছে। কেননা পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও বিপণনকে রোধ করার জন্য সরাসরি কোনো আইন এত দিন ছিল না। বিদ্যমান সিনেমাটোগ্র্যাফিক অ্যাক্ট, ১৯১৮, সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩, দণ্ডবিধি ও ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের কিছু বিধান দিয়ে পর্নোগ্রাফির উৎপাদন ও বিপণনকে পরোক্ষভাবে মোকাবিলা করা যায়, যা এ ধরনের একটি সামাজিক বিপদকে প্রতিরোধ করার জন্য খুবই অপর্যাপ্ত।
আশা করি, অল্পদিনের মধ্যে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংসদে পাস হবে। তবে এতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, কেউ যেন এমনটি মনে না করেন। কেননা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেসব পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হয়ে গেছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এবং প্রকাশ্য স্থানে পর্নোগ্রাফি ধারণকারী ভিডিও ও সিডির বিক্রি বন্ধ করা না গেলে শুধু আইন করে কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হয় না। আইন প্রণয়নের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা এবং পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে মেয়েদের প্রতি সহমর্মী ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠা।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.