নারীর প্রতি সহিংসতার রেকর্ড by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে সমাজ আজ থরথর করে কাঁপছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নারীর প্রতি সংহিসতা ভয়ানকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাঁচ বছরের শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে মধ্যবয়সী পুরুষের হাতে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রায় এক ডজন শিশু ধর্ষিত হয়েছে মানুষ নামে ওই জানোয়ারদের হাতে। এ ধর্ষণকর্ম থেকে বাদ যাচ্ছেন না মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকেরাও। একটি পাঁচ বছরের মেয়ের শরীরে কী এমন রূপ ও সৌন্দর্য আছে, যা দেখে একজন পুরুষের উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে? ওই বীর পুরুষেরা কি শিশুদের ধর্ষণ করছে, না ধর্ষণ করছে পুরো মানবজাতিকে?

মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধাক্কায়, তিলে তিলে গড়ে তোলা সোনার সংসার মুহূর্তেই ভেঙে যাচ্ছে। সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা পরিবারের ভেতরই সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছে। বাংলাদেশে আজ স্বামীর কাছে স্ত্রী নিরাপদ নয়, স্ত্রীর কাছেও নিরাপদ নয় স্বামী। নিরাপদ নয় মায়ের কাছে সন্তান এবং সন্তানের কাছে মা। এমনকি শিক্ষকের কাছেও নিরাপদ নয় শিক্ষার্থী। অপরূপা রূপসীরাও তাদের ভালোবাসার স্বামীদের হাতে প্রাণ দিচ্ছেন। নয়ন জুড়ানো প্রাণ ভরানোর মতো আদরের সন্তানকেও তার আপন মমতাময়ী মায়ের হাতে জীবন দিতে হচ্ছে, যা মনুষ্যত্বকে রীতিমতো স্তম্ভিত ও হতবাক করছে। নিজ পরিবারের ভেতর যদি মানুষের নিরাপত্তা না থাকে তাহলে আলোকিত বা ভালো মানুষ কিভাবে তৈরি হবে?

গত কয়েক দিনে দেশে শিশু ধর্ষণের বীভৎস ও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে সালমা আক্তার নামে এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। রাজবাড়ীতে এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে এক পাষণ্ড। মাদারীপুরে এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরায় কয়েক যুবক মিলে এক শিশুকে গণধর্ষণ করেছে। ফরিদপুরে ধর্ষিত হয়েছে এক শিশু। নীলফামারীতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক শিশু। নাটোরে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের শিশু মেয়েকে তার স্কুল থেকেই ধরে নিয়ে গেছে এক বখাটে যুবক। ঢাকার মিরপুরে বেড়িবাঁধের ওপর এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পটুয়াখালীর দশমিনায় ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক করা হয়েছে ধর্ষককে।

যশোরের কেশবপুরে দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছে ধর্ষক। ঢাকার মিরপুরে এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ঢাকার তোপখানা রোডে ১০ বছরের এক শিশুকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ বাথরুমে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। রংপুরে ছয় বছরের এক শিশু ধর্ষিত হয়েছে এক মধ্যবয়সী বীর পুরুষের হাতে। গোপালগঞ্জে এক শিশুর শ্লীলতাহানি করেছেন ৫৫ বছরের মানুষ নামের এক জানোয়ার। কুষ্টিয়ায় এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নোয়াখালীতেও ধর্ষিত হয়েছে এক শিশু। হবিগঞ্জ, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, চাঁদপুর ও সিরাজগঞ্জে পৃথকভাবে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

তা ছাড়া টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক কিশোরী। চট্টগ্রামের খুলশীতে কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এক কর্মজীবী মহিলাকে চারজন মুখ বেঁধে ধর্ষণ করে। হবিগঞ্জের মাধবপুরে এক গামেন্টস শ্রমিককে গণধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। মিঠাপুকুরে এক কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণের পর ভিডিও চিত্র ধারণ করে রাখে কিছু বখাটে যুবক। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গামেন্টকর্মী দু’বোনকে চোখ-মুখ বেঁধে ১০-১২ জন মিলে গণধর্ষণ করে। উল্লাপাড়ায় এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলন্তবাসে এক গামেন্টকর্মীকে ধর্ষণ করেছে বাসের চালক ও হেলপার। পিরোজপুরের কাউখালিতে কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে জামির নামে এক লম্পট। তা ছাড়া গাজীপুরে এমপির এপিএস কর্তৃক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে এক কিশোরী। ঢাকার উত্তরায় এক গৃহকর্মীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। সূত্র বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেল।

লক্ষণীয়, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদেরও নৈতিক অধঃপতন ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। একজন শিকের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ আর কে গ্রহণ করে? অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে গড়ে তুলতে যে অপরিসীম জীবনীশক্তি লাগে তা তো কেবল একজন শিকেরই থাকে। সে শিক কিভাবে পারেন ছাত্রীকে ধর্ষণ করতে? কিভাবে ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সর্ম্পক গড়ে তোলেন?

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ বীর উত্তম আনোয়ার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিকের বিরুদ্ধে তারই এক এসএসসি পরীার্থী ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে, শিকের নাম তারাক চন্দ্র মন্ডল। ধর্ষণের অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপককে আটক করেছে পুলিশ। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে শিকের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং একজন প্রধান শিক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছেনÑ এমন খবরও পত্রপত্রিকায় দেখা যায়। পাবনায় এক স্কুল শিককে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। মানিকগঞ্জে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে এক শিককে পুলিশে দিয়েছে জনতা। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক পরিমল তার ছাত্রীকে শুধু ধর্ষণই করেনি, ধর্র্ষণের চিত্র ভিডিও করে রেখেছে।

শিকদের এই অনভিপ্রেত ও পাশবিক এবং ন্যক্কারজনক আচরণ থেকে একটি পরিষ্কার সিগনাল পাওয়া যাচ্ছে যে, মনুষ্যত্বের কী ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে চলেছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।

উপরোল্লিখিত পরিসংখ্যান একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। সমগ্র দেশের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ। এভাবে একটার পর একটা লোমহর্ষক, বীভৎস ও পৈশাচিক পারিবারিক ও সামাজিক ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। এসবের জন্য আমরা কাকে দায়ী করব, নিশ্চয় শাসনকে; আর শাসন করেন কার্যত যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারাই। দেশে সুশাসন থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। প্রকাশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে একজন মানুষকে যখন কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে অপরাধীরা বীরের বেশে চলে যায়, তখন সমাজে অপরাধ করতে অন্যরাও উৎসাহ পায়।

বর্তমানে তথ্যের রাজ্যে বাধাহীন, অবাধ বিচরণের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও বিদেশী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল। ফলে সমাজ জীবনে বয়ে নিয়ে আসছে বিপজ্জনক সব ভাইরাস, বয়ে নিয়ে আসছে অপসংস্কৃতি, অশ্লীল, উলঙ্গ ও বিকৃত সব ছবি। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অন্য দিকে বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর যত সব অশ্লীল ও আপত্তিকর অনুষ্ঠান, আরেক দিকে ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা ও আফিমসহ নেশার ছড়াছড়ি। এর সবই যদি হয় একটি রাষ্ট্রের যুবসমাজের জীবনাচরণের অনুষঙ্গ, তাহলে এ যুবসমাজের ধ্বংস অবিশ্যম্ভাবী, যা কোনো আইন দিয়ে, শাসন দিয়ে ঠেকানো যাবে না।

সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে পরিবারের ভেতর ধর্মীয় অনুশাসন অপরিহার্য। শুধু ইসলাম নয়, প্রত্যেক ধর্মেই সৎ চরিত্র গঠনের নির্দেশনা দেয়া আছে। সন্তানদের ছোট থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি ধর্মীয় শিা দেয়াও বাধ্যতামূলক। ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েদের ‘এনার্জি’ সঠিক পথে ব্যবহৃত হয়, তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি হয় পরিশুদ্ধ। অন্যায়, পাপাচার, কামক্রোধ, মোহ ও যাবতীয় লোভলালসা এবং অযাচিত চাওয়া-পাওয়া তাদের মনোবৃত্তিকে দুর্বল করতে পারে না।

ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছেলেমেয়েদের দর্শন ও মূল্যবোধ তৈরি হয় পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার আলোকে, তাদের কাছে নর সুরতি, নারীও সুরতি; সুরতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। তারা জানে অন্যের মা-বোনের ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট হলে, অনুরূপ ইজ্জত ও সম্ভ্রম নষ্ট হবে তাদের মা-বোনদেরও। এটিই সামাজিক মূল্যবোধ, ভয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। আর এটি তৈরি হয় মূলত ধর্মীয় অনুশাসন থেকে। সুতরাং সমাজের র্ম্রীয়মান মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হলে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি সবার মনোনিবেশ করা অত্যাবশ্যক।

belaYet_1@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.