‘সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের রায়’

রায় ঘোষণার পরপরই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লা বলে ওঠেন ‘আল্লাহু আকবার’। এ রায় অন্যায়।
যেসব অভিযোগে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তাও অন্যায় আর যে অভিযোগে খালাস দেয়া হয়েছে সে অভিযোগও মিথ্যা। বিচারকেরা জল্লাদের মতো এ রায় দিয়েছেন। তারা তাদের বিবেককে বন্ধক দিয়ে অন্যায়ভাবে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ রায় দিয়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার পর আবদুল কাদের মোল্লা বলেন, আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ঢাকায় ছিলাম না। আমি ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। আল্লাহর আদালতে এই বিচারকদের বিরুদ্ধে মামলা করব তাদের অন্যায় বিচারের জন্য। সে দিন তাদের হাত, তাদের পা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।

কথা বলার আকুতি : রায় ঘোষণার জন্য ট্রাইব্যুনাল-২ এর তিনজন বিচারপতি বিচার কক্ষে প্রবেশ করে আসন গ্রহণের সাথে সাথে আবদুল কাদের মোল্লা বলেন, মাননীয় আদালত আমার কিছু কথা ছিল। রায় পড়া শুরুর আগে থেকেই তিনি কথা বলার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনি বসুন। আবদুল কাদের মোল্লা বলেন, রায় ঘোষণার পর কথা বলতে দেবেন কি না জানতে চাচ্ছি। ট্রাইব্যুনাল আবারো তাকে বসতে অনুরোধ করেন এবং রায় ঘোষণা শুরু করেন। এরপর রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবদুল কাদের মোল্লা আল্লাহু আকবর বলে কথা বলতে শুরু করেন। অন্য দিকে রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ট্রাইব্যুনাল কক্ষ থেকে বের হয়ে যান বিচারপতিরা। আবদুল কাদের মোল্লা কিছুক্ষণ কথা বলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে ট্রাইব্যুনাল কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যান।

রায়ের পুরো সময়জুড়ে কথা বলার একটি আকুতি ছিল কাদের মোল্লার চোখেমুখে। তার পরনে ছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও সাদা টুপি। রায় পড়া শুরু হলে কাদের মোল্লা তার সামনে থাকা কাঠগড়ার ওপর বাম হাত রেখে একটু এগিয়ে রায় শুনতে থাকেন। কাঠগড়ার কাঠের ফাঁক দিয়ে পুরোটা সময় তিনি বিচারকদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

রায় শেষ হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেনÑ এই বিচারকরা বিচারকে কলঙ্কিত করেছেন। তারা এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। এক দিন কুরআনের আইন অনুযায়ী আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব। সে দিন তাদের হাত-পা কথা বলবে। আজ আমার বিরুদ্ধে যে রায় দেয়া হয়েছে তা মিথ্যা, আবার যে মামলায় খালাস দেয়া হয়েছে সে মামলাও মিথ্যা। এমনকি আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে রায় দেয়া হয়েছে সেসবও মিথ্যা।

আবদুল কাদের মোল্লার জবানবন্দী : গত বছরের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ট্রাইব্যুনালে নিজেই ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, আমার নাম আবদুল কাদের মোল্লা, আমার পিতার নাম মো: সানাউল্লাহ মোল্লা। আমার জন্মতারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৪৮। আমার জন্মস্থান জরিপের ডাংগি, ইউনিয়ন চর বিষ্ণুপুর, থানা ও উপজেলা সদরপুর, জেলা ফরিদপুর। আমার বর্তমান স্থায়ী ঠিকানাÑ গ্রাম : আমিরাবাদ, ইউপি ভাষানচর, থানা ও উপজেলা সদরপুর, জেলা ফরিদপুর। আমার বর্তমান ঠিকানাÑ ফ্যাট নম্বর- ৮/এ, গ্রিন ভ্যালি অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট নম্বর- ৪৯৩, বড় মগবাজার, ঢাকা-১২১৭।

আমার প্রাথমিক শিক্ষা হয় জরিপের ডাংগি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৮ সালে আমি প্রাথমিক শিক্ষা বৃত্তিসহ সম্পন্ন করি। আমি ১৯৫৯ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হই, এটি একটি হাইস্কুল। আমি ১৯৬৪ সালে ওই স্কুল থেকে এসএসসি প্রথম বিভাগে পাস করি। ওই বছরই সম্ভবত জুলাই মাসে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হই। ওই কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করি। ওই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করি। এরপর প্রায় এক বছর চার মাস বাইশরশি শিব সুন্দরী অ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতা করি। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হই। আমি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ওই সময় গোটা বছরই প্রায় কাস হয়েছে, মাঝে মাঝে হরতাল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বিঘœ ঘটেছে। ফলে প্রায় সময় প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ডিসেম্বরের পরীক্ষা ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার তারিখ পড়েছিল সম্ভবত ১২ বা ১৩ মার্চ, ১৯৭১। কিন্তু ঐতিহাসিক ৭ মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান চূড়ান্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার কারণে উল্লেখিত তারিখের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। তখন আমরা জিজ্ঞেস করি পরীক্ষা কবে হবে। তখন তিনি বলেন, দেশের যে পরিস্থিতি তাতে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয়। আরো বললেন তোমরা হলে থাক, আমি তোমাদের অচিরেই আমার সিদ্ধান্ত জানাব। আমরা যারা হলে ছিলাম তারা বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে আমরা নিজেরাই আবারো তার সাথে দেখা করি। এই পরিস্থিতিতে তিনি আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঢাকায় যাদের থাকার ব্যবস্থা আছে তাদের নিজ নিজ বাসায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আর যাদের ঢাকায় বাড়িঘর নেই তাদের তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বললেন। যাওয়ার আগে ডিপার্টমেন্টের অফিসে প্রত্যেকের ডাক এবং টেলিগ্রাম ঠিকানা দিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।

এরপর ১১ বা ১২ মার্চ, ১৯৭১ আমি আমার নিজ গ্রামের বাড়ি আমিরাবাদ চলে যাই। সেখানে যাওয়ার পর প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়–য়া ছাত্ররা যারা বাড়িতে চলে এসেছে তারা এবং স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকেরা আমরা একত্রে আমিরাবাদ হাইস্কুলের মাঠে বসতাম এবং রেডিওতে প্রচারিত প্রতিদিনের খবরাখবর শুনতাম। ইতোমধ্যে অবসরপ্রাপ্ত জেসিও আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। এভাবে এক সপ্তাহ বা তার কিছু সময় বেশি পার হয়ে যায়।

২৩ মার্চ, ১৯৭১ আমাদের এলাকায় তখনো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি যায়নি। বেশির ভাগ বাড়িঘরে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। শুধু থানা হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ওই দিন আমরা ১২টার সময় জেসিও সম্ভবত তার নাম ছিল মফিজুর রহমানের ডাকে আমরা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়–য়া ছাত্র এবং স্কুলের উচ্চশ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র একত্রিত হই। মফিজুর রহমান সাহেব আমাদেরকে বললেন তিনি বিকেল থেকেই আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেবেন এবং সেই লক্ষ্যে তিনি কিছু কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল জোগাড় করেছেন। তিনি আরো বললেন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তাই আমাদেরকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা ওই দিন বিকেলে তার পরামর্শমতো ৩০-৪০ জন একত্রিত হই। তিনি প্রাথমিক পরীক্ষা নেয়ার পর ২/১ জন বাদে প্রায় সবাই প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য মনোনীত করেন এবং ওই দিন থেকেই আমরা পিটি, প্যারেড শুরু করি। তিনি প্রথম তিন দিন আমাদেরকে ডামি রাইফেল দেননি। পরে ২০-২১টি ডামি রাইফেল দেন এবং এই রাইফেলগুলো দিয়েই আমরা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩০ এপ্রিল বা ১ মে তারিখে ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত আমরা ট্রেনিং চালিয়ে যাই। ফরিদপুরে সেনাবাহিনী পৌঁছার পর কয়েক দিন আমাদের ট্রেনিং বন্ধ থাকে। এর কয়েক দিন পর আবার ট্রেনিং চালু হয়। যে দিন পাক সেনারা ফরিদপুর থেকে বরিশালের দিকে যায় সে দিন আমরা আমাদের স্কুল থেকে কামানের গোলার শব্দ শুনতে পাই। কামানের গোলার শব্দ শোনার পর আমরা মাঠ থেকে স্কুলঘরের ভেতরে ঢুকে যাই। এরই মধ্যে এক দিন কয়েকটি যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার ওপর দিয়ে খুব নিচ দিয়ে উড়ে যায়। ফলে সবাই সাংঘাতিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাই এবং আমাদের ওস্তাদ ট্রেনিং বন্ধ করে দেন। এই সময়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে অবসরপ্রাপ্ত অথবা এলপিআরে থাকা বা ছুটিতে থাকা সব সামরিক কর্মকর্তা ও সিপাহিদের কাজে যোগদান করার নিমিত্তে নিকটবর্তী থানা অথবা সেনা ছাউনিতে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর আমি লেখাপড়ার জন্য ঢাকা আসার চেষ্টা করতে থাকি। জবানবন্দীতে উল্লেখিত ব্যক্তিদের সাথে ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করি যাতে আমার লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি না হয়। তারা তিনজনই আমাকে একযোগে পরামর্শ দেন এখন ঢাকায় যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, তোমার ভূমিকা সম্পর্কে ঢাকায় কারো জানা নেই। সেখানে গেলে বর্তমান অবস্থায় যেকোনো ধরনের বিপদ হতে পারে। আমরা তোমার ভূমিকা সম্পর্কে জানি, তাই তুমি বাড়িতে থাকো। আমরা খোঁজখবর নেই, তারপর সবকিছু জানাশোনার পর এবং বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে ছড়ানো-ছিটানো অস্ত্রপাতি সরকারের হাতে জমা হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, জান-মালের নিরাপত্তা বিধান হবে, তখন আমরাই তোমাকে ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব।

এরপর তাদের পরামর্শ মোতাবেক আমি বাড়িতে এবং উল্লেখিত পীর সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকি এবং চৌদ্দরশি বাজারে ব্যবসায় করতে থাকি। তখন মাঝে মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা হাসান, মাকসুদ, আবদুল হাই প্রমুখের কাছ থেকে আমি চিঠি পেতে থাকি, তারা লেখে যে, তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আস। এই চিঠিপত্র সম্পর্কে আমি সদরপুর থানার উল্লেখিত তিন ব্যক্তিকে জানাই। তারা বললেন একটু দেখেশুনে যাওয়াই ভালো, এই চিঠি যে তারাই লিখেছেন তার কী প্রমাণ আছে।

১৯৭২ সালের সম্ভবত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সদরপুর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি শাহজাহান তালুকদার নিজেই আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং আমাকে শহীদুল্লাহ হলের গেটে নামিয়ে দেন। আমি আসার পর ছাত্রলীগের বর্ণিত নেতৃবৃন্দ আমার ভর্তি এবং হলে থাকার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন। কারণ তারা আমার কাসমেট ছিলেন এবং আমি তাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করতাম এবং তাদের সাথে আমার আন্তরিকতাও ছিল।

১৯৭১ সালের সম্ভবত জুলাই মাসের শেষ দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অফিস থেকে টেলিগ্রাম এবং ডাকযোগে খবর পাই যে, পরীক্ষা শুরু হয়েছে, আমি যেন এসে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দেই। আমি এই বার্তা মোতাবেক জুলাই মাসের শেষ দিকে ঢাকায় আসি এবং হলেই উঠি। সপ্তাহখানেক প্র্যাকটিক্যাল কাসও করি। কাস শেষ হওয়ার দুই-তিন দিন পর তিন দিনের বিরতিসহ দুই দিনব্যাপী প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা চলে। পরীক্ষা শেষে সপ্তাহখানেক পর আবার বাড়ি চলে যাই।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বাতিল হওয়ার কারণে আমার ব্রেক অব স্টাডি হয় এবং এ কারণে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি করা হয়নি। ১৯৭৪ সালে আমি আইইআর (ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ) ডিপ্লোমা ইন এডুকেশনে (সোস্যাল সাইন্স) ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন পাস করি।

আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করি। এরপর ডিগ্রি প্রথম বর্ষে যখন পড়াশোনা করি তখন ইসলাম অ্যান্ড কমিউনিজমের তুলনামূলক পড়াশোনা করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পেরে আমি ইসলামী ছাত্রসংঘের কাজ করতে থাকি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করি। পড়াশোনা শেষ করে ওই সালেই আমার রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার আগেই আমি কিছুদিন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করি। পরে বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে চাকরি করি। আমি সেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমি উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-৭৫ সালে শিক্ষকতা করেছি। আমি মানারাত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম।

১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে আবার আত্মপ্রকাশ করার পর আমি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করি। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম পুনঃপ্রকাশিত হয়। আমি মানারাত থাকা অবস্থায় ওই পত্রিকায় শিক্ষা পাতার পরিচালক ছিলাম। সাংবাদিকতার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে আমি সংগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে যোগদান করি। তবে তখনো আমি মানারাত ট্রাস্টের সদস্য ছিলাম। ইতোমধ্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ডিইউজে প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করি। ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দুইবার নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলাম ডিইউজে তার সাথে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকি। সম্ভবত ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হই। ১৯৮৭ সালে আমি ঢাকা মহানগর জামায়াতে আমির নির্বাচিত হই এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করি। ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে আমি কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলাম।

কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য থাকার কারণে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদবিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ উভয় দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ জামায়াতের সমর্থন চায়। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন পেলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারবে নাÑ এ কথা আওয়ামী লীগকে জানানো হয়। এরপর বিএনপি আমাদের কাছে সরকার গঠনের জন্য সমর্থন চাইলে বিএনপিকে সমর্থন দেই তবে শর্ত দেই যে, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু তারা করেনি। এ কারণে আমরা পরে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির সাথে একীভূত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করি। আন্দোলনের সময় মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের বাসায় প্রায়ই লিয়াজোঁ কমিটির মিটিং হতো এবং আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম। নাসিম সাহেব এই লিয়াজোঁ কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন। আমি এগুলো নোট করে নিয়ে এসে বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতাম। আন্দোলন তীব্রতর রূপ লাভ করলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আমাকে এবং আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদকে একই দিন গ্রেফতার করে আটকাদেশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সপ্তাহ দুয়েক পর আমি মুক্তি পাই।

আমাদের আন্দোলন চলতে থাকে। একপর্যায়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে আইন পাস করে। আন্দোলনের কারণে জামায়াতের সাথে বিএনপির দূরুত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে জামায়াত এবং বিএনপি আলাদাভাবে নির্বাচন করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং আমাকে বললেন আমরা তো সরকার গঠন করলাম, আমাদের কিছু পরামর্শ দেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মহিউদ্দীন খান আলমগীর তখন মুখ্যসচিব ছিলেন এবং তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রিসিভ করেন। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দেই যা শুনে তিনি আমাকে সাধুবাদ জানান। একইভাবে তিনি পরে আমাকে আরো দু’বার ডেকেছিলেন।

এখন আমি মনে করছি দীর্ঘ দিন যাদের সাথে রাজনৈতিক আন্দোলন করলাম, মিটিং-মিছিল করলাম, সুসম্পর্ক রাখলাম, সখ্য রেখে চলেছি তারা এখন শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর সাথে আমার বিন্দুমাত্র কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। আমি কোনোভাবেই ওই ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত ছিলাম না। বিগত ৪০ বছরের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কারোর পক্ষ থেকে পত্র-পত্রিকায় বা কোনো কর্তৃপক্ষের বরাবর কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

No comments

Powered by Blogger.