রাজনীতির ভাষা by মাহমুদুর রহমান মান্না

রাজনীতির কি আলাদা কোনো ভাষা হতে পারে? অনেকেই হয়তো অবাক হবেন; আমরা তো বাংলায় (অথবা জাতিগতভাবে আলাদা ভাষায়) কথা বলছি। ভাষা তো একটাই।
তাহলে রাজনীতির আবার আলাদা ভাষা কেমন?
কথাটা ঠিক। কিন্তু তার পরও যে ভাষায় গ্রামের কৃষক কথা বলে, সে ভাষায় শহরের একজন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কথা বলে না। যেভাবে একজন আইনজীবী কথা বলেন, সেভাবে একজন চিকিৎসক বলেন না। ভাষার একটি মানসম্পন্ন ও ভাবগত অর্থ রয়েছে। ভাষা অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। ভাষার ভেতরে মানুষের সদিচ্ছা, সততা বা এর বিপরীত চরিত্র- সবই চিহ্নিত হয়। আর আজকাল পৃথিবীর মানুষ যেহেতু রাজনীতির বাইরে একটি নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছে না, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনীতির একই ভাষা-চরিত্র থাকতে হবে এবং তা হতে হবে মানুষের জীবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। রাজনীতিবিদদের কথার ফানুস, নিরর্থক গলাবাজি, মিথ্যাচার, পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার প্রভৃতি হতে পারে না রাজনীতির ভাষা। কারণ রাজনীতির মধ্যে মানুষের জীবন চলছে অথবা পিষ্ট হচ্ছে; রাজনীতি গঠন করছে মানুষের জীবন, তাকে ঋদ্ধ অথবা বিদ্ধ করছে। জনগণের জন্য রাজনীতি যদি হয়, তাহলে অবশ্যই গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হয়, যাতে জীবনকে সমৃদ্ধি দেওয়া যায়, জীবনকে করা যায় নিরাপদ। আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে অন্তত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আসনে যাঁরা আছেন ও বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীদের ভাষায় স্বৈরাচারী মনোভঙ্গি, অসহিষ্ণুতা, হিংসা-প্রতিহিংসা প্রকাশ পায়- এমন কিছু ব্যবহার যাতে না হয় সেদিকে সচেতন থাকতে হবে।
কথায় বলে, মাছের পতন ধরে মাথায়। রাষ্ট্রের কর্ণধার বা কোনো দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীর বাচনভঙ্গিতে যদি অসহিষ্ণু ও প্রতিহিংসার ভাব পরিলক্ষিত হয়, তবে নিঃসন্দেহে হাজার হাজার কর্মীর মনে তার প্রভাব পড়বে এবং এতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে। তাতে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অবশেষটুকুও আর রক্ষা হবে না। এর প্রকাশ আজ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি আমরা। বিশ্বজিৎ হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যে সহিংসতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা এসব অতি ও দুষ্ট কথনের জন্যই হচ্ছে। রাজনীতি হয়ে পড়েছে সাংঘর্ষিক। অতএব, রাজনীতিতে একটি মানসম্পন্ন ভাষা খুবই দরকার। অন্তত একটি গণতান্ত্রিক সত্য, সুন্দর, সহিষ্ণুতাপূর্ণ ভাষা ব্যবহারের চর্চা শুরু করতে হবে এখনই।
রাজনৈতিক ভাষা জনমনে প্রভাব সৃষ্টি করে, এমনকি এভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও তার প্রভাব অপ্রতিরোধ্য। যেমন- 'আসাদের শার্ট', 'হটাও এরশাদ, রুখো স্বৈরাচার' অথবা নূর হোসেনের বুকে-পিঠে লেখা 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক'- এসব জনপ্রিয় স্লোগান আমাদের সংস্কৃতির অতি প্রিয় বচনে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং বা লেনিনের অনেক কথা রয়েছে সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে। মাও সে তুং বলেছিলেন, 'রাজনৈতিক বিপ্লবের পূর্বশর্ত হচ্ছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব।' যে জাতির সংস্কৃতি যত উন্নত, সে জাতির রাজনীতি, সাহিত্য, সবই তত উন্নত। আমরা বলতে পারি, আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ তথা রাজনৈতিক ভাষাভঙ্গি, আচরণ যত উন্নত হবে, জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে তার প্রভাব প্রতিফলিত হবে। তাই রাজনীতি থেকে আক্রমণাত্মক ভাষা-ভাব পরিত্যাগ জরুরি বলে দেশবাসী মনে করে।
আমরা নৈতিকতা বা নৈতিক শিক্ষা প্রত্যাশা করি শিক্ষার্থীদের কাছে। অথচ রাষ্ট্র পরিচালকরা সংসদে বসে যে ভাষায় কথা বলেন, যে নোংরা ভাবভঙ্গিতে মারামারি, হাতাহাতি করার পর্যায়ে পেঁৗছে যান, তা কেমন নৈতিকতা? তা কিরূপ গণতন্ত্র? অনেকের মনে আছে দুজন মহিলা সংসদ সদস্যের 'মহাকীর্তির' কথা। শালীনতার শেষ স্তরটুকুও তাঁরা বজায় রাখেননি। মাননীয় স্পিকার শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিলেন সেই পুরো প্রসিডিং বাদ দিতে। কারণ তার বেশির ভাগই ছিল অশ্রাব্য। এসব যদি রাজনীতির ভাষা হয়, তাহলে এ দেশের শিক্ষার্থী বা তরুণ সমাজ রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক কী শিক্ষা নেবে?
সংসদ সদস্যদের আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। তাঁদের দুঃসাহস, স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় জনগণ। জনগণের সেবা করতে ভোট দিয়ে যাঁকে সম্মানিত করা হয়, মহান দায়িত্ব অর্পণ করা হয়- সেই নেতা জনগণের সঙ্গে প্রভাব-প্রতিপত্তির জোর খাটান। পয়সা বা ঘুষ ছাড়া কারো জন্য কোনো কাজ বা তদবির করেন না, একটা ডিও লেটার পর্যন্ত লেখেন না। তাঁদের হাতে পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, এমনকি নিজের পার্টির নেতারা পর্যন্ত প্রহৃত হন। গণতন্ত্রের ভাষায় তাঁরা কথা বলেন না। আমি সব সদস্যের কথা বলছি না। অনেকের কথা বলছি।
সংসদে গণতন্ত্রচর্চা চললে সমাজেও তা প্রতিষ্ঠিত হতো। কিন্তু আজ সংসদে-সমাজে কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই, অপরের মত প্রকাশের সুযোগ ক্ষীণ। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো দেশকে দেখা হয়। সংসদে বিরোধী দল যায় না। তাদের অভিযোগ, সরকারি দল এত কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলে যে সেখানে বসে থাকা যায় না। একই অভিযোগ আবার সরকারি দল বিরোধীদের ব্যাপারে করে থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের নেতাদের আচরণ ও উচ্চারণ কতদূর নেমে গেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে নির্বাচন হয়, তাতে এক ভোটের ব্যবধানেও হারজিত হয়ে থাকে। তাহলে যে পরাজিত হলো এক বা ১০০ ভোটের ব্যবধানে, সে বিজয়ীর চেয়ে কোন বিচারে কম। অথবা কোন বিচারে অন্য সব রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের প্রতি সেবা-বৈষম্য চলে? অপরের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার এসব নেতা-পাতিনেতা শিক্ষা নেন উচ্চ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে। উচ্চ পর্যায়ের নেতা-নেত্রী সবাই যে অন্তরের দিক দিয়ে এখনই সহিংস বা প্রতিহিংসাপরায়ণ, তা নয়। কিন্তু তাঁরা অভ্যস্ত নন সুশীল ভাষা ব্যবহারে। এর কারণ কোনো দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা, সত্যবাদিতার মূল্য অনুপস্থিত। মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত তোষামোদ আর ওপরে ওঠার অনৈতিক প্রতিযোগিতা। যে কারণে সুশীল ভাষা ও শিষ্টাচার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বর্তমানে একেবারেই নেই।
দুই-আড়াই বছর আগের একটি ঘটনা। সিরাজগঞ্জে খালেদা জিয়ার জনসভায় একটি ট্রেনের নিচে পিষ্ট হয়ে জীবনহানি ঘটে কয়েকজনের। ঘটনার জন্য খালেদা জিয়া হাসিনাকে অভিযুক্ত করে বললেন, তিনি এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। শেখ হাসিনা তখন দেশে ছিলেন না। দুই দিন পর দেশে ফিরে তিনি বললেন, খালেদা জিয়া জেনেশুনেই রেললাইনের ওপর সভা করেছেন। এ ঘটনার জন্য তিনিই দায়ী। অতঃপর শুরু হলো এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘাতক, মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার বিরামহীন প্রতিযোগিতা দুই দলের নেতা-কর্মীদের। অথচ কেন তদন্ত করে সত্যটা উদ্ঘাটন করা হলো না? কেন কোনো পক্ষই তদন্তের জন্য চাপ দিল না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের? তাহলেই তো সত্য বেরিয়ে আসত। আর দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে তারও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো এই- সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে খিস্তিখেউর, অশোভন ভাষায় আক্রমণ।
কিছুদিন আগে ঢাকায় বিভিন্ন সমাবেশে ভাষণদানকালে খালেদা জিয়া বললেন, সাপকে বিশ্বাস করা যায়, আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করা যায় না। হতে পারে আওয়ামী লীগের ওপর যারপরনাই অসন্তুষ্ট। কিন্তু গণতন্ত্রের পরিবেশ প্রত্যাশা করেন তিনি। নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচন চান। সত্যিকার অর্থে যে সুন্দর রাজনৈতিক পরিবেশ ও দেশে সুন্দর ভবিষ্যৎ বা সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করে সে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অরাজনৈতিক, অগণতান্ত্রিক ভাষায় আক্রমণ করতে পারে না। কারণ অন্যকে অসহিষ্ণু করে তুললে সামগ্রিক পরিস্থিতি মন্দের দিকে যেতে পারে। সাপের সঙ্গে তো কথা বলতে পারেন না তিনি। এই ন্যূনতম বোধ রাজনীতিবিদদের না থাকা সত্যি দুঃখজনক। এই 'সাপ' শব্দের জবাবে নিশ্চয়ই বহুবার আমাদের রাজনীতির ভাষা বয়ানে 'সাপ' উচ্চারিত হয়েছে। দেশবাসী শুনেছে, হেসেছে।
সম্প্রতি প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসাকে নিয়ে এ ধরনের একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে, যাতে আবার রাজনীতিবিদদের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক টক শোতে তিনি ষাটের দশকের আন্দোলন ও নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ওই সময় তিনি ছিলেন তৃতীয় সারির নেতা।
প্রচণ্ড রকম ক্ষিপ্ত হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগ। তারা বলেছে, এ বি এম মূসা বলেছেন, তৃতীয় শ্রেণীর নেতা। এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ মন্তব্য করেছেন, এ বি এম মূসা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মানসিক ভারসাম্যহীন ও প্রতিক্রিয়াশীল। এ মন্তব্য গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।
এ বি এম মূসা একজন প্রবীণ সাংবাদিকই কেবল নন, তিনি বঙ্গবন্ধুর আমলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন আর এ বি এম মূসা আজও অকৃত্রিমভাবে শ্রদ্ধা করেন। বয়স হয়েছে, তাঁর উচ্চারণে ভুলত্রুটি হতেই পারে। যদিও এ বি এম মূসা বলছেন, তিনি তৃতীয় শ্রেণীর বলেননি। ভিডিও ফুটেজ দেখে নিলেই তো হতো। এমন আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলল কেন আওয়ামী লীগ? আমাদের দেশে মুরবি্বদের শ্রদ্ধা করার সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এমন সব ভাষার ব্যবহার করছেন, যাতে শ্রদ্ধা ও সৌজন্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
যেহেতু রাজনীতির বাইরে কোনো দেশ বা সমাজের অস্তিত্ব নেই, তাই রাজনীতির প্রভাব তাতে অবশ্যই পড়বে। এ জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান যে পর্যায়ের, সেই মাপেই সমাজকে চালিত করবে। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিত্ব তরুণদের অনুসরণীয় হওয়ার কথা, যা আজ কল্পনাও করা যাচ্ছে না। দেশের তরুণ-যুবকদের সুপথে পরিচালিত করতে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতিই প্রধান ভূমিকা রাখবে এ ক্ষেত্রে। এ ছাড়া গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব নয় সহনশীল সুশীল রাজনৈতিক ভাষার চর্চা ছাড়া। আমরা আশা করি, এই সত্যটা সবাই উপলব্ধি করবে। রক্ষা করবে গণতন্ত্রকে, দেশ ও জাতিকে।

লেখক : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট ও নাগরিক
ঐক্যের আহ্বায়ক
mrmanna51@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.