স্মরণ- চেতনায় ভাস্বর রাজু by আবু আলী সিনা

আজ ১৩ মার্চ রাজুর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। মঈন হোসেন রাজু_ সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্রনেতা, মৃত্তিকা বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঘাতকের বুলেটের আঘাতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ডাসের সনি্নকটে।
সমপ্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মেধাবী ছাত্র আবু বকরের মৃত্যু এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদী জামায়াত-শিবির কর্তৃক নির্মমভাবে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যাকা- ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একই কায়দায় সোলায়মান হত্যাকা-। আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। ছাত্র জীবনে ছাত্র সংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে আমরা স্লোগান দিতাম কোন মৃত্যুই যেন বিনা প্রতিবাদে না যায়- আজ এর সঙ্গে যোগ করা সময়োপযোগী কোন মৃত্যুই যেন বিনাবিচারে না যায়, অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়- সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এত বছর পরও রাজু হত্যার বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হত্যাকান্ডেরই বিচার হওয়ার নজির নেই। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর যথারীতি তদন্তে কমিটি হয়, মামলা হয়। তারপর সেটা হিমাগারে চলে যায়। এজন্যই সন্ত্রাসী খুনীরা আস্কারা পায়, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পরিপুষ্ট হয়ে আবার অপরাধ করে। মঈন হোসেন রাজু ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। কাসের নিয়মিত-মেধাবী ছাত্র, সদাহাস্যময় প্রাণোচ্ছল এক টগবগে তরুণ ক্যাম্পাসের প্রিয়মুখ। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের কাতারের সৈনিক, '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে এক অকুতোভয় যোদ্ধা, বস্তত '৯০-এর ছাত্র আন্দোলনে রাজু অসামান্য ভূমিকা রাখেন যাঁরা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন তাঁরা সবাই স্বীকার করবেন, এছাড়া সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য আপসু-র (All Party Students Unity- APSU) প্রায় সর্বস্তরের নেতাকর্মী তাঁকে চিনতেন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাঁর পাড়া শ্যামলীতেও আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখেন। সেই রাজু ঘাতকের বুলেটে অকালে প্রাণ হারান। ১৩ মার্চ পড়ন্ত বিকেলে টিএসটি চত্বরে রাজু যখন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা করছিলেন, সেসময় হাকিম চত্ব্বরের দিকে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা গোলাগুলি করছিল। তাৎণিকভাবে ছাত্র ইউনিয়নসহ অপরাপর সমমনা ছাত্র সংগঠন নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে, অস্ত্র ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন রাজু, স্লোগানে মিছিলে প্রকম্পিত করেন ক্যাম্পাস। মিছিলটি ডাস অতিক্রম করে একটু সামনে এগুলেই সন্ত্রাসীরা মিছিল ল্য করে গুলি করে, ঘাতকের বুলেট রাজুর মস্তক বিদীর্ণ করে, তার প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নেয়, স্তব্ধ হয়ে যায় তাঁর হৃৎপিণ্ড, একটি স্বপ্ন ও দ্রোহের যবনিকাপাত ঘটে এভাবেই। হত্যাকারীরা অচেনা ছিল না। তৎকালীন প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র চাইলে সন্ত্রাসীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যেত। রাজু হত্যার বিচার হয়নি।
রোমান্টিক ছিলেন রাজু, শামসুন নাহার হলের কোন ছাত্রীর জন্য হলগেটে প্রায়ই রজনীগন্ধা আর গোলাপের কলি দিয়ে আসতেন। তাঁর সেই প্রেম শাখা-প্রশাখায় মঞ্জরিত হয়নি, বড় অকালে চলে গেলেন রাজু; তাঁর সেই স্বপ্নের মানসী রাজুর মৃত্যুর পর হয়ত দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল, তারপর আমরা জানি না। ছাত্র সংগঠনের কর্মী হিসেবে আমরা দেয়ালে স্লোগান লিখতাম অথবা আওয়াজ তুলতাম আমরা সশস্ত্র হব অযস্র মৃত্যুতে, কিন্তু আমরা আর সশস্ত্র হইনি, রাজু হত্যার বদলাও নিতে পারিনি, 'রাজু সংসদ' হয়েছিল তার চেতনা বিকশিত করবার জন্য, সেটা আর অগ্রসর হয়নি। আমরা জীবনের ঘানি টানার জন্য যে যার কাজে ব্যসত্ম হয়ে পড়েছি। একজন সহযোদ্ধা, একজন কমরেড একজন বিপ্লবীর স্বপ্নের সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোথায় আছে ওর ছোট্ট সুন্দর বোনটা আমরা জানি না, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ত। শুনেছি ওর বড় ভাইয়া বাবা-মাকে নিয়ে আমেরিকায় চলে গেছেন। কেমন আছেন ওর পরিবার আমরা জানি না। প্রতিবছর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও সমমনা কিছু ছাত্র সংগঠন রাজু ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে, আলোচনাসভা করে নতুন করে প্রতিজ্ঞা করে সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার শিক্ষানীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য কিন্তু ওর জনম দুঃখিনী মায়ের বুকে থাকে নৈরাশ্যের হাহাকার, ঘনীভূত বেদনার ছায়াপাত, পুত্র শোকে বিহ্বল মায়ের খোঁজ আমরা রাখি না।
অবয় ও অন্ত:সারশূন্যতা তথা শর্টকাট পথে ব্যক্তিগতভাবে অর্থবিত্তের মালিক হবার প্রবণতা- এখানে ছাত্রদের মৌলিক দাবি, মননশীলতা ও সুকুমার বৃত্তি চর্চার কোন ব্যাপার নাই। আমরা আশা করি রাজুর স্বপ্ন বাসত্মবায়ন হোক, বৈষম্যহীন একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হোক, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হোক, আমরা সবাই মিলে এক সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলি। জয়তু রাজু।
লেখক : সাবেক বিজ্ঞান মিলনায়তন সম্পাদক, ডাকসু।

No comments

Powered by Blogger.