আপিলের সুযোগ নেই রাষ্ট্রপক্ষের- আসামিপক্ষ আপিল করবে

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা।
অন্য দিকে আপিলের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই রাষ্ট্রপক্ষের। আইনজীবীরা বলছেন,  ট্রাইব্যুনালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী আসামি বেকসুর খালাস পেলেই কেবল আপিলের সুযোগ থাকে রাষ্ট্রপক্ষের।

গতকাল মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই রায় দেন। আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে তার ১৫ বছর করে কারাদণ্ড হয়। চতুর্থ অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

আবদুল কাদের মোল্লার মামলায় ঘোষিত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন তার আইনজীবীরা। মঙ্গলবার রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আসামিপরে আইনজীবী নাজীব মোমেন এ কথা বলেন। নাজীব মোমেন বলেন, ‘আমরা এই রায়ে হতাশ হয়েছি। আমরা আশা করেছিলাম কাদের মোল্লা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।’ সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকও রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দেন।

অন্য দিকে রাষ্ট্রপক্ষও রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে আপিলের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। কিন্তু সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইনে তার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রইব্যুনাল অ্যাক্ট (সংশোধিত) ১৯৭৩ এর ২১(১) ধারা অনুযায়ী, সাজাপ্রাপ্ত কোনো আসামি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন। কিন্তু ২১(২) ধারা অনুযায়ী, বেকসুর খালাসের কোনো আদেশের বিরুদ্ধেই কেবল সরকারপক্ষ আপিলের সুযোগ পাবে। ২১(৩) ধারা অনুযায়ী, উভয়পক্ষের ক্ষেত্রেই  আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ থাকবে।

রায় ঘোষণার পর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অবশ্য বলেছেন, ‘এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে। প্রসিকিউশন টিম যদি মনে করে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রয়োজন আছে, তবে তারা সেটা করতে পারবে।’ বাদি ও বিবাদি উভয় পই আপিল করতে পারবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, প্রসিকিউশনের মতামতের ওপর আপিলের বিষয়টি নির্ভর করবে।

আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘প্রত্যাশা করেছিলাম পাঁচ ও ছয় নম্বর অভিযোগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হবে। কিন্তু রায়ের মাধ্যমে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমাদের পরবর্তী করণীয় পরে বসে ঠিক করা হবে।’

তবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করতে পারে। রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে তাদের আপিল করতে হবে। আইনানুযায়ী, আসামি খালাস পেলে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে। আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে চতুর্থ অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমরা যদি আপিল করি তবে চতুর্থ অভিযোগ বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত এসেছে তার বিরুদ্ধে করব। তিনি আরো বলেন, প্রত্যাশা ছিল সর্বোচ্চ সাজা হবে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল সব কিছু বিচার বিবেচনা করে এই রায় দিয়েছেন। তবে আমরা এই রায়ে খুশি না। রায় হাতে পাওয়ার পর আপিলের বিষয়ে ভাবব আমরা। তিনি বলেন, আলাদাভাবে যে অভিযোগটি থেকে আবদুল কাদের মোল্লা খালাস পেয়েছেন, আমি মনে করি, সেই অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল আইনানুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করতে পারবে।

এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল আইনানুযায়ী আসামি সাজাপ্রাপ্ত হলে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সুযোগ পাবে না। যেহেতু আবদুল কাদের মোল্লাকে সাজা দেয়া হয়েছে, সেহেতু রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সুযোগ পাচ্ছে না। ছয়টি অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে। সেগুলো যদি পৃথক মামলা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে যে অভিযোগ থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন সেটির বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আইনমন্ত্রী ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অত্যন্ত হাস্যকর। রাষ্ট্রপক্ষের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ অবশ্যই জানেন যে, ট্রাইব্যুনাল আইনানুযায়ী সাজা বৃদ্ধির ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টে কোনো আপিল করা যায় না। আসামি বেকসুর খালাস পেলেই কেবল সরকারপক্ষ আপিল করতে পারবে। জেনেশুনে দেয়া রাষ্ট্রপক্ষের এমন বক্তব্যে মনে হচ্ছে পুরো বিষয়টি একটি সাজানো নাটক। তিনি বলেন, এ রায়ে সরকারপক্ষও সন্তুষ্ট নয়Ñ বিষয়টি সাজানো নাটক হতে পারে। কেননা তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছে, ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষভাবে বিচার করছে।

এ ব্যাপারে ড. শাহদীন মালিক বলেন, আপাত দৃষ্টিতে শাস্তি বৃদ্ধি করার জন্য আপিলের বিধান চোখে পড়ছে না। তবে যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে আলাদা আলাদাভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে সেগুলো যদি পৃথক মামলা হয়ে থাকে তবে আপিল করতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ।

এ ব্যাপারে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক তুরিন আফরোজ বলেন, শাস্তি বৃদ্ধি করতে আপিলের কোনো সুযোগ রাষ্ট্রপক্ষ পাবে না। তবে যে অভিযোগটি থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সেটির বিষয়ে বিচার চেয়ে আপিল করতে পারবে রাষ্ট্রপক্ষ। তিনি আরো বলেন, আবদুল কাদের মোল্লøা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সে সময়ও রাষ্ট্রপক্ষ তার শাস্তি বৃদ্ধির দাবি করতে পারবে না।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেছেন, সাজার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপক্ষ কেবল রিভিউ চাইতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.