খরা কাটছে- ০ বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগ ০- বেসরকারী অংশগ্রহণ বৃদ্ধির নীতিমালা সংশোধনের পর বিনিয়োগকারীদের- ব্যাপক আগ্রহ ॥ শীঘ্রই ইতিবাচক পরিবর্তন- উপদেষ্টা by রশিদ মামুন

দেশের বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগ খরা কেটে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে বিদ্যুত খাতে বেসরকারী অংশগ্রহণ বৃদ্ধির নীতিমালা সংশোধনের পর থেকেই বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
সংশোধিত নীতিমালায় প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ অবারিত হওয়ায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকরীরা এর মধ্যে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতদিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে যে বিনিয়োগ বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হয়েছিল এখন তা কেটে যাবে। একই সঙ্গে দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে দাতানির্ভরতা কমে দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ায় স্থবিরতা কাটিয়ে গতি ফিরে পাচ্ছে বিদ্যুত খাত। ইতোমধ্যে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি ছাড়াও বড় কয়েকটি বিদ্যুত কেন্দ্রর জন্য প্রাকমূল্যায়ন দরপত্র (পিকিউ টেন্ডার) আহ্বান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী (বীরবিক্রম) বলেছেন, সরকার জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সর্বাত্মক গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের পদক্ষেপে শীঘ্রই দেশের জ্বালানি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ৩১ ডিসেম্বর বিদ্যুত খাতে বেসরকারী অংশগ্রহণ বৃদ্ধির নীতিমালা ২০০৮ সংশোধনের পর থেকে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এর মধ্যে অভিজ্ঞ বেশ কয়েকটি কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছে। তারা সবাই বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বিনিয়োগের আগে বিবেচনা করা হয় পরিবেশটি কতটা বিনিয়োগ অনুকূল। বাংলাদেশে অন্যান্য খাতে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ হলেও বেসরকারী খাতে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ ছিল না। কঠোর শর্তের বেড়াজালে সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এ খাতে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তারা আগ্রহী হতো না।
সূত্রমতে, দেশের ৪৭ ভাগ মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পায়। আর ৫৩ ভাগ মানুষই বিদ্যুতের সুবিধাবঞ্চিত। বিদ্যুতের অভাবে দেশের শিল্প বাণিজ্যে চরম এক অস্থিরতা চলছে। পিডিবির হিসেবেই গ্রীষ্ম মৌসুমে চাহিদার সঙ্গে ফারাক এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। বেসরকারী হিসেবে যা আড়াই হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ বিদ্যুত পেতে চায়। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে এ সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব নয়। এজন্য বেসরকারী খাতকে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ সহজ করার জন্য আইন সংশোধন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বেসরকারী খাতে নির্মিত বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য কোন জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদন করা হলে তার মূল্য কত হবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তা নির্ধারণ করে দেবে। চাইলেই অভিজ্ঞ যে কোন উদ্যোক্তা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারবেন। তবে এ বিদ্যুত কেনার বিষয়ে সরকারের কোন বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। তবে স্বাভাবিকভাবে চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুত উৎপাদিত হওয়ায় এখন দেশের বিশাল ঘাটতি মোকাবেলায় সরকারই এ বিদ্যুত কিনবেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা আইনের সংশোধনী অনুমোদনের পর তা আইন মন্ত্রণালয়ে ভ্যাটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের ভ্যাটিংয়ের পর এখন বিজি প্রেসে গেজেটটি ছাপার অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ১৯৯৬ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ২০২০ সালের মধ্যে সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুত সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য পরবর্তীতে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুত খাতে বেসরকারী খাতের অধিক অংশগ্রহণ উদ্বুদ্ধ করা, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা, বিদ্যুতের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং দেশের সীমিত গ্যাস সম্পদ সংরক্ষণ করা। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়নি।
গত সপ্তাহে বেসরকারী বিনিয়োগে নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এ্যাডভান্স এনার্জির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এ্যাডভান্সড এনার্জির প্রধান নির্বাহী রফিক খোওজা চুক্তি স্বাৰরের পর বলেন, তারা সর্বোচ্চ ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তার প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জনতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির বলেন, এতে সরকারের ওপর চাপ কমে আসবে। মানুষ চাহিদা অনুযায়ী সহজে বিদ্যুত পাবে। এতে বিদ্যুত খাতে যে সঙ্কট চলছে তা কেটে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সূত্রগুলো বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এছাড়া দেশে পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা মুখিয়ে থাকে। বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগের জন্য এসব অনুকূল পরিবেশ সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের বিদ্যুত খাতে বেসরকারী বিনিয়োগকে কাজে লাগাতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) সুযোগ রাখা হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি খাতের উন্নয়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হচ্ছে। যেখানে এক হাজার কোটি টাকা বেসরকারী বিনিয়োগ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশের বিদ্যুত খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে গত ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং লন্ডনে রোডশোর আয়োজন করে বিদ্যুত মন্ত্রণালয়। এতে মোট ২০৩টি কোম্পানি বাংলাদেশে বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে সরকারের পৰ থেকে বলা হচ্ছে বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগ মন্দা এবার দূর হবে।
এসব ৰেত্রে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে রাজনৈতিক চাপ এবং তদ্বিরমুক্ত হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে সব ৰেত্রে আইন এবং নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটানোর যে প্রবণতা রয়েছে তা যেন বারংবার না ঘটে সেদিকে সরকারকে নজরদারি করার আহ্বান জানান তাঁরা।
বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, অতীতে দেখা গেছে বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পর ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি কিনে উচ্চমূল্যে বিদ্যুত বিক্রি করেছে। বেসরকারী খাতের সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী উদ্যোক্তারা নিজ উদ্যোগে জ্বালানি সংগ্রহ করে বিদ্যুত উৎপাদন করে ভোক্তার কাছে বিক্রি করবেন। বেসরকারী বিনিয়োগের ৰেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থে তা শতভাগ মেনে চলার ওপর জোর দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.