আসামিপক্ষের আইনজীবী টিমের প্রতিক্রিয়া- এ রায়ে বিচার বিভাগে কালো অধ্যায়ের সূচনা হলো

জামায়াতের ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার বিষয়ে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন,
এ রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক ও কালো অধ্যায়ের সূচনা হলো। ১৮৬০ সালে ভারতবর্ষে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এ রায়ের মতো দুঃখজনক একটি রায়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ মামলায় কাদের মোল্লা সাহেবকে দোষী প্রমাণ করার মতো সাক্ষ্য-প্রমাণের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয়টি অভিযোগের একটিও তারা প্রমাণ করতে পারেনি। তাই এটি একটি ন্যায়ভ্রষ্ট রায় এবং যত তাড়াতাড়ি এ রায় বাতিল করা হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।

আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক রায় ঘোষণার পর গতকাল সন্ধ্যায় আসামিপক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয় সাংবাদিকদের কাছে। এ সময় ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক রায় বিষয়ে এ কথা বলেন। হরতালের কারণে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের চেম্বারে সন্ধ্যার পর ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয় বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দেয়া লিখিত বক্তব্যে আরো বলেন, এ রায়ে আমরা বিস্মিত ও হতাশ। মাত্র ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে কিভাবে এমন একটি চরম দণ্ড প্রদান করা হলো? ১২ জন সাক্ষীর বেশির ভাগই হচ্ছে ‘শোনা সাক্ষী’ এবং মাত্র তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দাবি করলেও আসামিপক্ষ তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে সাফল্যের সাথে নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেনÑ আমরা বিস্মিত যে, এ রায়ের অনেক বক্তব্যই আবেগপ্রসূত। বিচারকের কাছ থেকে আবেগপ্রসূত বক্তব্য প্রত্যাশিত নয়। আমরা এ মামলার শুনানিকালে আমেরিকান ও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের তিনটি নজির তুলে ধরে দেখিয়েছিলাম যে, একজন বিচারকের শুধু যুক্তি দিয়েই পরিচালিত হওয়া উচিত, আবেগ দিয়ে নয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ রায় হাইকোর্টের মানদণ্ডের অনেক নিচে অবস্থান করছে।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, আসামির পক্ষে যদিও মাত্র ছয়জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, তবুও এই ছয়জনের সাক্ষ্য থেকেই স্পষ্ট হয়েছে যে, আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের সময় ঢাকা শহরেই ছিলেন না, ছিলেন তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। কিন্তু তাদের এ বক্তব্য গ্রহণ না করে মিরপুর অঞ্চলে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কৃত অপরাধের দায় আবদুল কাদের মোল্লার ওপর চাপানো হয়েছে। সংরক্ষিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল, এমনকি প্রসিকিউশনের অন্যতম সাক্ষী কবি রোজির লিখিত বইয়ে বিহারিদের অপরাধ সংঘটনের বর্ণনা এবং সেখানে আবদুল কাদের মোল্লার কোনো রকম উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও এসব সত্য গোপনকারী সাক্ষী নিজের লিখিত বইয়ের তথ্য অস্বীকার করে সরকারি চাপে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর পরও আদালত সেসব সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এই সাজা দিয়েছেন। বিচারের যেকোনো মানদণ্ডে কাদের মোল্লাকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দেয়া উচিত ছিল। আমরা মনে করি, এটি একটি perverse judgment (ন্যায়ভ্রষ্ট রায়) এবং আমার প্রত্যাশা করি যে, আপিল বিভাগে এ রায় সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয়ে যাবে।

লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে তিনটি অভিযোগ বিষয়ে কোনো চাুস সাক্ষী হাজির করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। অন্য অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে সাক্ষী হাজির করেছে, তাদের সাক্ষ্য আমরা নস্যাৎ করতে পেরেছি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য হওয়া বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে তাকে খালাস দেয়া উচিত। আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ে জামায়াতকে জড়ানোসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এটি বিচার্য বিষয় ছিল না; অথচ রায়ে জামায়াতকে জড়ানো হয়েছে। এটি আবেগের মাধ্যমে করা হয়েছে। এটি কাম্য ছিল না। বিচারক যখন আবেগ দিয়ে প্রভাবিত হন, তখন তিনি সঠিক বিচার করতে ব্যর্থ হন।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি একটি খারাপ রায়; যত তাড়াতাড়ি এ রায় বাতিল করা হবে, ততই মঙ্গল দেশের জন্য।

সংবাদ ব্রিফিয়েং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী নজরুল ইসলাম এবং আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম, এস এম শাহজাহান কবীর, সাজ্জাদ আলী চৌধুরী, তারিকুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.