১৯৭১ ॥ চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ যুদ্ধ by সামসুদ্দিন আহম্মদ

এদিকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রাবাস ও মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস, জেলা ছাত্রলীগ ও শহর ছাত্রলীগের সদস্যরা সব দ্বন্দ্ব ভুলে একতাবদ্ধ হয়। এরপর থেকে ছাত্রাবাসগুলো স্বাধীনতাকামীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হলো।
যুদ্ধ শুরু হলে কিভাবে শহরবাসীকে রা করা যায় এবং বাঙালী ইপিআর সৈনিক ও পুলিশকে কিভাবে সহায়তা করা হবে সে ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা করা হয়। শহরে তখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে ডা. জাফর বাঙালী সৈনিক ও ইপিআর অফিসারদের নিয়ে সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় শহরের পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরী আলোচনায় বসেন। ডা. জাফর গোপনে কয়েক দফা বাঙালী সামরিক অফিসারদের সাথে মিলিত হন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ অফিসে এক জরুরী সভা বসে। হান্নান সাহেবের নেতৃত্বে আবু সালেহ, ডা. এমএ মান্নান, ডা. জাফর, জহুর আহমদ চৌধুরী, কায়সার ভাই, এসএম জামাল উদ্দিন, খালেক চাচা, মির্জা মনসুর, কফিল উদ্দিন, নূরুল ইসলাম চৌধুরীসহ অনেকে সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাঙালী সামরিক অফিসাররা সিদ্দিকী সাহেবকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করে তাঁদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা নিয়ে আসেন। চট্টগ্রামবাসীকে রা করার নেপথ্য পরিকল্পনাকারীর নাম আমরা পরে জানতে পারি। তিনি হচ্ছেন ইপিআর-এর বিপ্লবী অফিসার ক্যাপ্টেন রফিক। ডা. জাফরের কাছ থেকে শুনেছি, চট্টগ্রামবাসীকে রার জন্য তিনি বাঙালী ইপিআর সৈনিকদের আগেই প্রস্তুত রেখেছেন।
এদিকে বন্দুকের দোকানের অস্ত্রগুলো আমরা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে মজুদ করি। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে মীর্জা মনসুর সাহেবকে ছাত্র-শ্রমিক-যুবক ও প্রাক্তন সৈনিকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
২৩ মার্চ বাঙালীদের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ আসে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। জাহাজটির নাম 'সোয়াত।' এই অস্ত্রশস্ত্র বাঙালীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। ইতোমধ্যে বাঙালী শ্রমিকরা ওই জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ ঘটনার পর পরই বন্দর থেকে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ পর্যন্ত শত শত ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়। রাস্তার দু'পাশে লাখো জনতার সমাবেশ ঘটে। শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা হয়, অস্ত্র ক্যান্টনমেন্টে নেয়া যাবে না। খালাস করা অস্ত্র বন্দরের শেডে রাখতে হবে।
২৪ মার্চও চট্টগ্রামবাসীর জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ। বাঙালী সামরিক প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বাঙালীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বিষয়টি পাকিস্তানীরা সহজে মেনে নিতে পারেনি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিলেন এমআর সিদ্দিকী। তাঁর সাথে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন এমএ হান্নান, এমএ মান্নান, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। আবু মোহাম্মদ হাসেমের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, মোখতার আহমদের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং এসএম জামালউদ্দিনের নেতৃত্বে শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এসব পরিষদের সমন্বয়কারী ছিলেন ডা. জাফর ও আবু সালেহ। ২৪ মার্চ সকালবেলা এমএ হান্নানের নেতৃত্বে সব ক'টি সংগ্রাম পরিষদ আওয়ামী লীগ অফিসে এক জরুরী সভায় বসে। প্রত্যেক থানার আহ্বায়ক কমিটিকে যে কোন সঙ্কট মোকাবেলার নির্দেশ দেয়া হয়।
ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন পাঞ্জাবী ব্রিগেডিয়ার আনসারী।
দেওয়ানহাট থেকে নৌবন্দর পর্যনত্ম ব্যারিকেড গড়ে তোলার জন্য বাঙালী সৈন্যদের নিয়োগ করা হলো। ইতোমধ্যে হালিশহর থেকে এমপি ইসাহাক মিয়ার নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ একটি দল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বন্দরের দিকে অগ্রসর হয়। এর আগে অস্ত্র খালাসের জন্য যে সমঝোতা হয় তা বাতিল বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার আনসারী ঘোষণা দিলেন, যে কোন মূল্যে অস্ত্র খালাস করতে হবে। এদিকে মিছিলে মিছিলে লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে বন্দরের দিকে। এই সর্বপ্রথম পাকিস্তানী সেনারা বন্দর এলাকায় গণহত্যায় মেতে উঠল। অনেক মানুষ মারা গেল, যার কোন হিসাব নেই। বন্দর থেকে পুরো চট্টগ্রাম শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। কত লোক মারা গেছে তা নিয়ে শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের বাঙালী সামরিক অফিসাররা তখন নির্বিকার হয়ে বসে রইলেন। এর ফলে আমাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হলো। এই প্রথম চট্টগ্রাম বন্দরে গণহত্যার ইতিহাস রচিত হলো। ইতোমধ্যে আরেকটি গুজব রটল। শহরের যেসব এলাকায় ইপিআরের সৈন্যরা ডিউটিরত ছিল তাদেরকে ডিউটি থেকে অপসারণের নির্দেশ দিল পাক সেনা-কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের মানুষ আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ২৫ মার্চ সকালে সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় বাঙালী সামরিক অফিসার ও সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে বিমানবন্দর, পোর্ট ও আগ্রাবাদ এলাকায় সারাদিন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। ২৫ মার্চ রাত ৯টার দিকে নৌবাহিনীর সৈন্যরা বিমানবন্দর দখল করে নেয়। রাত ১০টার পর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পরিস্থিতি হয়ে ওঠে চরম ভীতিকর।
পাকিস্তানী সেনাদের মোকাবেলা করার জন্য আগে থেকেই ইপিআর সৈন্যরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পজিশন নিয়েছিল। রেলওয়ে হিল (ঈ.জ.ই), কোর্ট হিল, জেনারেল হসপিটালের পাহাড়, টিএ্যান্ডটি ভবন, মেডিক্যাল কলেজ, প্রবর্তক হিল, নিউমার্কেট এবং আরও বহু জায়গায় তারা অবস্থান নিয়েছিল। শহর রার জন্য ইপিআরের সাথে পুলিশ, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সবাই যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত ছিল। এদিকে ষোলশহর থেকে বায়েজিদ বোসত্মামি রোড ও শেরশাহ কলোনি পর্যন্ত ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সৈন্যরা পাহারারত ছিল। আওয়ামী লীগ অফিসে এমএ হান্নানের নেতৃত্বে একটি কন্ট্রোলরম্নম খোলা হয়েছিল। এর দায়িত্বে ছিলেন এসএম জামালউদ্দিন ও খালেক চাচা। প্রত্যেক প্রান্ত থেকে খবর আসতে থাকে কিছু কিছু এলাকায় গোলাগুলি চলছে এবং থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। প্রবর্তক পাহাড় থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ছোট ছোট ইপিআর দলের পাহারা দেখতে পাই। বহু আগে থেকে ইপিআর সদস্যরা আমাদের সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন রফিক। বিভিন্ন সূত্রে শোনা যাচ্ছিল, বাঙালী অফিসাররা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন জায়গায় গোপন বৈঠক করছে। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীকে রার জন্য তাদের কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। ২৫ মার্চ রাত যত ঘনিয়ে আসছে চট্টগ্রামবাসী তত উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছে। ঠিক সাড়ে ১২টার সময় ঢাকা থেকে একটি ফোন আসে আওয়ামী লীগ অফিসে। এতে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। সমস্ত শহর জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল। আমরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম, বিভিন্ন লকারে যেসব অস্ত্রশস্ত্র জমা ছিল তা কিভাবে নিজেদের আয়ত্তে নেয়া যায়। সেই ব্যবস্থা আমরা এসপি সাহেবের মাধ্যমে করে নিয়েছিলাম। রাত ১২টার পরে সালেহ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা ৭ জন পুলিশের সহায়তায় রাইফেল কাবের অস্ত্রগুলো নিজেদের দখলে নিই। ওই দিনের এই দুঃসাহসিক কাজে যারা অংশ নিয়েছিলাম তাদের মধ্যে আমি আর সালেহ ভাই এখনও বেঁচে আছি। মোখতার আহমদ, বশরুজ্জামান, জাফর, মান্নান, দীপক এরা এখন আর কেউ বেঁচে নেই। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.