সংসদে মহাজোট এমপিদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক দলের সদস্যরা।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় দেশবাসী হতাশ উল্লেখ করে তাঁরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের লক্ষ্যে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী জামায়াত-শিবিরচক্রকে কঠোর হস্তে দমনের দাবি জানান তাঁরা।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নামাজের বিরতির পর পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। আলোচনায় অংশ নেন জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইনউদ্দিন খান বাদল ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আবদুল মান্নান। এরপর আওয়ামী লীগের নূরুল ইসলাম সুজনসহ বেশ কয়েকজন ফ্লোর চাইলে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী স্পর্শকাতর এ বিষয়ে ঢালাও আলোচনার সুযোগ না দিয়ে আগামীতে দিন নির্ধারণ করে আলোচনার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাবের পর ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী আর কাউকে ফ্লোর না দিয়ে সংসদের নির্ধারিত কার্যসূচি শুরু করেন।
রাশেদ খান মেনন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'ট্রাইব্যুনালের রায়ে গোটা জাতি হতাশ হয়েছে; মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পুরো দেশের মানুষের মন ভেঙে গেছে।' তিনি বলেন, 'প্রবাদ আছে, সাপের মুখে চুমু খেতে নেই, সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। আমরা কিন্তু সেই সাপ (জামায়াত-শিবির) নিয়ে খেলছি। মানুষের মধ্যে এ রায় নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, এসব বিষয় পরিষ্কার করতে হবে।'
মেনন বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র চলছে। এ বিচার বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। জামায়াত-বিএনপি এখন সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণসহ পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, অথচ তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো! আমরা কারো মৃত্যু কামনা করি না; কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললে সর্বোচ্চ দণ্ড হবে, এটাই স্বাভাবিক।'
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, জামায়াত-শিবির সারা দেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে। অথচ তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামে পুলিশকে জামায়াত-শিবির রজনিগন্ধা দিচ্ছে, আবার রাতে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করছে। ট্রাইব্যুনালকে হুমকি দিয়ে গৃহযুদ্ধের কথা বলছে। অথচ প্রশাসন নীরব। এসব নিয়েও মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইনউদ্দীন খান বাদল জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, "একজন কসাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতের এমন রায়ে গোটা জাতি ক্ষুব্ধ। মা-বোনের সতীত্ব, নিজেদের অস্তিত্ব এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমরা কারো সঙ্গে সমঝোতা করি না, হতে পারে না। অথচ 'নন-নেগোশিয়েবল' ইস্যুতেও 'নেগোশিয়েট' করা হচ্ছে। জামায়াত-শিবির দেশে গৃহযুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা করছে; এরা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছে না। এরা রাষ্ট্রশক্তির ওপর আঘাত হানছে। সারা দেশে জামায়াতের আস্ফালন, স্পর্ধার মধ্যে ট্রাইব্যুনালের এ রায় জনগণের মধ্যে অন্য ধারণা সৃষ্টি করছে।" তিনি এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান।
আবদুল মান্নান বলেন, 'কসাই নামে পরিচিত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা প্রায় ৪০০ মানুষকে হত্যা করেছে। আদালতে তার বিরুদ্ধে আনীত পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগের কারণে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল।' তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলছে, 'একাত্তরে কসাই কাদের মোল্লা যা করেছে, তাতে শুধু তার নয়, তার চৌদ্দ গোষ্ঠীর ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল।' ট্রাইব্যুনালের রায় জাতিকে হতাশ করেছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, জামায়াত-শিবির ঘোষণা দিয়েছিল, কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হলে দেশে গৃহযুদ্ধ বাধাবে, লাগাতার হরতাল দেবে। মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, জামায়াতের হুমকির কারণেই কি ট্রাইব্যুনাল এমন রায় দিলেন? বাকি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে পারে বলে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে।
উত্তপ্ত আলোচনার মধ্যেই সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী নোটিশ ছাড়া আদালতের রায় নিয়ে এমন মুক্ত আলোচনা চালিয়ে না যাওয়ার জন্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, 'সংসদে এখন প্রধানমন্ত্রী নেই। তিনি থাকলে ভালো হতো। আর বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং আদালতের হওয়ায় এভাবে আলোচনা করতে দেওয়া ঠিক হবে না। আমরা নিজেরা বসে আলোচনা করে একটি দিন ধার্য করি, সেদিন সংসদে এ ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে।'
সংসদ উপনেতার অনুরোধে অনির্ধারিত বিতর্কের অবসান হয়। তবে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাকালে সরকারি দলের সদস্যরাও রায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

No comments

Powered by Blogger.