সর্বাত্মক হরতালঃ ব্যাপক সংঘর্ষ- চট্টগ্রামে ৩ জন নিহত, আহত সহস্রাধিক

জামায়াতের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের গুলিতে চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে নিহত হয়েছেন ইমরান খান নামে এক শিবির নেতা এবং মোহাম্মদ আফজাল ও শফিকুল ইসলাম নামে দুই জামায়াতকর্মী।
সেখানে আরো গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ৩০০ ব্যক্তি। চান্দগাঁও থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের থানায় ধরে নিয়ে হাত-পায়ে গুলি করে আহত করেছেন। তার নেতৃত্বে মসজিদে নামাজরতদের লক্ষ্য করে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল মঙ্গলবারের হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহস্রাধিক লোক আহত হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন অন্তত ৫০০। হরতালে রাজধানী ছিল ফাঁকা। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে হরতাল সমর্থকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গুলিবর্ষণ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ, ধরপাকড়, লাঠিপেটা, যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ নির্বিচারে লোকজনকে গ্রেফতার করে। ফজরের নামাজ আদায় করতে যারা মসজিদে গিয়েছেন তাদের অনেকেই পুলিশের রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হয়েছেন। শেরেবাংলা নগর এলাকায় এক ব্যক্তিকে পুলিশ ফজরের পর থানায় ধরে নিয়ে দু’পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হরতাল চলাকালে রাজধানীর রাস্তাঘাটে দু’একটি যানবাহন চলতে দেখা গেছে। তবে তাতে কোনো যাত্রী ছিল না। রাজধানীর দোকানপাট, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ব্যাংক-বীমায় উল্লেখযোগ্য কোনো লেনদেন হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকলেও তালাবদ্ধ রেখে ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থান করেন। রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনো পরিবহন ছেড়ে যায়নি এবং রাজধানীতে আসেওনি। লঞ্চ চলাচল করেনি। ট্রেন ও বিমান চলাচল করলেও যাত্রীসংখ্যা ছিল কম। রাজধানীতে গতকালও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মারমুখো অবস্থানে দেখা যায়। মিছিল দেখলেই গুলি চালায় পুলিশ। পিকেটারদের কাউকে ধরতে পারলে তার ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, অনেক নিরপরাধ মানুষও পুলিশের রোষানলে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।



যাত্রাবাড়ী-কদমতলী : হরতাল চলাকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় দফায় দফায় মিছিল ও পিকেটিং করেছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এ সময় রায়েরবাগ এলাকায় জামায়াত-শিবির কর্মীদের সাথে পুলিশ ও র‌্যাবের সংঘর্ষ হয়। এতে লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেলে কয়েকজন আহত হন। হরতালের সমর্থনে সকাল ৯টার দিকে জামায়াত-শিবিরের শতাধিক নেতাকর্মী রায়েরবাগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে মিছিল বের করে। পিকেটাররা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ও র‌্যাব মিছিলকারীদের লাঠিচার্জ করলে উভয়ের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। পিকেটাররা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একপর্যায়ে মিছিলকারীরা রাস্তায় গাছের গুঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে। এ সময় স্থানীয় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে পিকেটারদের ধাওয়া করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার শেল ব্যবহার করে। ঘটনাস্থল থেকে পিকেটার সন্দেহে দু’জনকে আটক করা হয়।

এই ঘটনার পরপরই শনিরআখড়া এলাকায় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। পুলিশের দাবি রায়েরবাগের একটি গলি থেকে ৩০-৪০ জন জামায়াত-শিবিরকর্মী রাস্তায় উপর্যুপরি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ল্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এরপর তারা রাস্তায় টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়। র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে জামায়াত-শিবির সন্দেহে আটজনকে আটক করা হয়।

দুপুর ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী এলাকার সাদ্দাম মার্কেটের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। এ ঘটনায় আলী আকবর নামে এক শিশুসহ (৮) চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।

অপর দিকে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে যাত্রাবাড়ীর মিরহাজিরবাগের খালপাড় রোডে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ঝটিকা মিছিল বের করে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। এ সময় ওই এলাকায় একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়।

মহাখালী : সকাল সোয়া ৬টার দিকে মহাখালী টিভি গেটের সামনে একটি মিছিল বের করে হরতাল সমর্থনকারীরা। ওই সময় পুলিশ সদস্যদের বহনকারী একটি মিনিবাস ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। মিছিলকারীরা বাসটি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় পুলিশ বাসটি থামিয়ে মিছিলকারীদের ধাওয়া করলে সেখানে সংঘর্ষ হয়। মিছিলকারীদের ইটের আঘাতে একজন আর্মড পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন।

আগারগাঁও : সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হরতালের সমর্থনে রোকেয়া সরণির আগারগাঁও তালতলা বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি কিছু দুর অগ্রসর হলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। এ সময়  পুলিশের সাথে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ সেখান থেকে পাঁচজনকে আটক করে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শেওড়াপাড়া ও তালতলার মাঝামাঝি এলাকায় হরতালের সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়। পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। তাদের ছোড়া গুলিতে সাফায়েত কবীর (৪৩) ও মাইনুল ইসলাম (২৮) নামে দু’জন আহত হন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা জানান, তারা জামায়াত বা শিবিরের সদস্য নন। তারা পথচারী ছিলেন। পুলিশ বলছে, তারা নাশকতার চেষ্টা করলে পুলিশ শর্টগান দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়।

সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মিরপুর রোডের ডিসি তেজগাঁও কার্যালয়ের সামনে একটি মিছিল বের করে হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। তারা বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। কিছু সময় পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের ধাওয়া করতে চাইলে মিছিলকারীরা পুলিশকে ধাওয়া করে। পরে পুলিশ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে।

মিরপুর : সকাল ৭টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে মিছিল বের করে হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় পুলিশ মিছিল আটকে দিলে মিছিলকারীরা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর-১১ নম্বরে আরো একটি মিছিল বের করে হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। একপর্যায়ে মিছিলকারীরা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সকাল ৭টায় মিরপুরের সেনপাড়া এলাকায় একটি মিছিল বের করে হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় তারা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। এতে একজন গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ তিনজনকে আটক করেছে।

খিলগাঁও : সকাল ৯টার দিকে খিলগাঁও ফাইওভারের কাছে একটি মিছিল বের করে হরতাল সমর্থনকারীরা। পুলিশ তাদের বাধা দিলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ফাটানো হয়। ককটেলে মহিবুল্লাহ (২৪) নামে একজন আহত হন। এ ছাড়া এই ঘটনায় নুরুন্নবী (৩২) নামে একজন পুলিশ কনস্টেবলও আহত হন। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

ধানমন্ডি : এলাকায় সকাল ৮টার দিকে ধানমন্ডি ১৫ বিআরটিসির একটি দোতলা বাস ভাঙচুর করে হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় তারা তিনটি ককটেল ফাটায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তারা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এলিফ্যান্ট রোড : সকাল ৯টার দিকে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালে একটি স্টাফ বাসে আগুন দিয়েছে হরতাল সমর্থকেরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৯টার দিকে আইসিবির ওই স্টাফ বাসটি (ঢাকা জ ১৪-০৩৩১) যাত্রী নিয়ে মতিঝিলের দিকে যাচ্ছিল। বাটা সিগন্যালের কাছে একদল হরতাল সমর্থক বাসটির গতিরোধ করে যাত্রীদের নেমে যেতে বলে। তারা নামলেই হরতালকারীরা বাসটি ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

কদমতলী : বেলা সোয়া দু’টার দিকে কদমতলী এলাকায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা মিছিল বের করে। পরে তারা রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে। এ সময় র‌্যাবের একটি টহল দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে আটককৃতদের মারধর করে। এতে কয়েকজন রক্তাক্ত হন।

ওয়ারি জোনের উপপুলিশ কমিশনার মোজাম্মেল হক জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চোরাগোপ্তাভাবে দুয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ টহল দিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের মাদরাসা ও মেসগুলোতে তল্লাশি করেছে পুলিশ।

এ দিকে হরতালের সমর্থনে পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোডে সকালে পিকেটাররা গাড়ি ভাঙচুর করেছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছার আগেই পিকেটাররা পালিয়ে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বংশাল এলাকায় পিকেটাররা রাস্তায় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় পুলিশ ধাওয়া করলে পিকেটাররা ইটপাটকেল ছুড়ে মারে।

এ ছাড়া হরতাল চলাকালে সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। হরতাল চলাকালে পুরান ঢাকার সব ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান এবং অফিস ও মার্কেট বন্ধ ছিল।

হরতালের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ফাঁকা। হাতেগোনা কয়েকটি বিভাগের পরীক্ষা হলেও কোনো কাস হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বাসও ছেড়ে যায়নি। হরতালের সময় দুপুরে ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করে ছাত্রলীগ।

এ দিকে জামায়াতের ডাকা আজকের হরতালের দিনে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীন আজ বুধবারের এমএড (সান্ধ্য) কার্যক্রমের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পরীক্ষার নতুন তারিখ পরে জানানো হবে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ অফিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের ডিসি মাসুদুর রহমান জানান, হরতালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫২ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
       

No comments

Powered by Blogger.