আওয়ামী লীগ-সুশীলসমাজ যৌথ প্রকল্প- সহজ কথা by আলফাজ আনাম

ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সুশীলসমাজ কোনো রাখঢাক না করে এখন খোলাখুলি প্রচারণায় নেমেছে।
হলমার্ক, ডেসটিনি ও পদ্মা সেতুর মতো বড় ধরনের দুর্নীতি এবং ছাত্রলীগের লাগামহীন সন্ত্রাসের কারণে সাধারণ মানুষ যখন সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ও হতাশ তখন বিরোধী দল ঘায়েলের জন্য মাঠে নেমেছে সুশীলসমাজ এবং ব্যবসায়ীদের একটি অংশ। লক্ষণীয়, টেলিভিশনের সামনে বিশেষ করে টকশোতে মন্ত্রীদের উপস্থিতি কমে গেছে। এর প্রধান কারণ সরাসরি টেলিফোনে প্রশ্ন করা যায় এমন টকশোগুলো মন্ত্রীদের জন্য বড্ড বিব্রতকর হয়ে পড়ছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা যখন গণমাধ্যমে নানামুখী প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন তখন সুশীলসমাজ তাদের উদ্ধারের প্রচেষ্টা নিয়েছেন। এ জন্য সরকারের হাতে থাকা শেষ অস্ত্র যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটিকেই এরা ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। এর ফলে এদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি জনগণের সামনে খুব সহজেই স্পষ্ট হয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সাথে পুলিশের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সুশীল এই গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা শুধু জামায়াত নয়, সরাসরি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। তাদের বক্তব্যর মূল সুর দু’টিÑ প্রথমত, বিএনপি কেন জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার পরই বিএনপির উচিত ছিল জামায়াতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, না হলে তাদের পরিত্যাগ করা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মুখফুটে এ জন্য বিএনপির বিচার দাবি না করলেও যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী হিসেবে প্রমাণ করতে তাদের চেষ্টার অন্ত নেই।

জামায়াতের আন্দোলন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিএনপির নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। কিন্তু সে অবস্থানের ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ থাকছেন। জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালে বিএনপির সমর্থন দেয়াকে কেন্দ্র করে এই সুশীল মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা খুবই হতাশা প্রকাশ করেছেন। জামায়াত এই হরতাল ডেকেছিল রাজধানীতে সমাবেশ করতে না দেয়ার প্রতিবাদে। রাজনৈতিক দল হিসেবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার জামায়াতের রয়েছে। এদের বক্তব্য হচ্ছে যেহেতু তারা সভা-সমাবেশের নামে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে, এ কারণে তাদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই। কিন্তু এরা বলছে না কখন থেকে কোন পরিস্থিতিতে জামায়াতের সাথে পুলিশের সংঘষের্র ঘটনাগুলো ঘটছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াতের সভা-সমাবেশের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কেন এই নিষেধাজ্ঞা, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। নভেম্বর মাসের পর থেকে শুরু হয়ে যায় ব্যাপক ধরপাকড়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতাদেরও গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে। জামায়াত যখন রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করতে চাইছে তখনই বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে একপর্যায়ে জামায়াতের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই সংঘর্ষ নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোনে কোনো স্থানে পুলিশ জামায়াত-শিবিরকর্মীদের হাতে মার খেয়েছে।

আমরা দেখছি, সোমবার জামায়াতকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে জামায়াত সমাবেশ ও মিছিল করেছে। এই কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়, জামায়াতের হরতালের কর্মসূচিতে বিএনপি সমর্থন দিয়ে ভুল করেনি বরং একটি দলের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সঠিক দায়িত্ব পালন করেছে। শুধু জামায়াত নয়, যেকোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের মতো গণতান্ত্রিক অধিকার যদি হরণ করা হয় তাহলে অবশ্যই তাতে বিএনপির সমর্থন থাকা উচিত। সভা-সমাবেশের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে জামায়াতের আন্দোলনের যৌক্তিকতা যেমন প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি এই আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন যে রাজনৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল তা-ও প্রমাণিত হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়েও বিএনপির নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। কিন্তু সুশীল এই মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা বিএনপির এ অবস্থানকে দেখছেন ক্ষমতাসীন দলের চোখে। ক্ষমতাসীন দল এ বিচার নিয়ে যে ব্যাখা দিচ্ছেন তাকে সঠিক হিসেবে ধরে নিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান বা ব্যাখ্যাকে নিরপেক্ষ হিসেবে জনগণের সামনে হাজির করার চেষ্টা করছেন। বিএনপি কখনোই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করেনি। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছেÑ এই বিচার হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতমুক্ত। যেহেতু এটিকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বলা হচ্ছে সে কারণে বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু বিচার স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে থেকেই। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যাদের বিচার চলছে তাদের সবাইকে আটক করা হয়েছিল ভিন্ন মামলায়। যেমন জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার হাস্যকর অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আবার শুধু বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগ আনা হয়েছে। তাহলে কি অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগে অভিযুক্ত লোক নেই? অবশ্যই আছে। একটি উদহারণ দেয়া যাক, গত আওয়ামী লীগ শাসনামলে ধর্মমন্ত্রী করা হয়েছিল মাওলানা নুরুল ইসলামকে। তার বিরুদ্ধে ’৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ছিল। মাওলানা নুরুল ইসলাম মারা গেছেন। কিন্তু তার মতো আরো অনেকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির রাজনীতির সাথে জড়িত আছেন। কিন্তু তাদের একজনকেও কেন এই বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না? বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ বাংলাদেশের পতাকা যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে তুলে দিয়েছে বিএনপি। অথচ এ কাজটি ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম শুরু করেছে। এরপরও বিএনপির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা কতটা যুক্তিসঙ্গত? আর জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগ অন্তত চারটি রাজনৈতিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ অথবা পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ১. এরশাদের সামরিক শাসনামলে ’৮৬ সালে জামায়াত ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ২. এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতও যুগপৎ আন্দোলন করেছে। সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের সাথে জামায়াতের যোগাযোগ ছিল। ৩. এরশাদের পতনের পর ’৯১ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে সাক্ষাৎ করে তার দলের সমর্থন ও দোয়া চেয়েছিলেন। ৪. তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ’৯৩ থেকে ৯৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও জামায়াত যৌথভাবে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য দু’দলের নেতাদের নিয়ে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সুশীলসমাজভুক্ত তথাকথিত নিরপেক্ষ ভাষ্যকারেরা এই রাজনৈতিক অতীত এখন ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিএনপি কেন প্রশ্ন তুলেছে তা নিয়ে এ সুশীলসমাজের দুঃখের অন্ত নেই। এটাও বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী হওয়ার একটি উদহারণ হিসেবে তারা দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে বলে রাখা দরকার, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর দিকে জামায়াতও এর বিরোধিতা করেনি। এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রথম প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যখন পুলিশের রিপোর্টকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয়েছে। এরপর আসামি পক্ষের সাক্ষীর সংখ্যা সীমিত করে দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি গুম হয়ে গেছে। বিচারপতির সাথে স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর দেখা গেছে, সরকারের মন্ত্রী, বিচারপতি ও প্রসিকিউশনের মধ্যে গভীর যোগসাজশ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে লোভ দেখিয়েছেন, মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হলে তার পদোন্নতি হবে।

সুশীলসমাজের এই প্রতিনিধিরা ন্যায়বিচার ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার কিন্তু বিচারের নামে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার যোগসাজশের মতো কুকীর্তির ব্যাপারে একেবারেই চুপ। এ কারণেই বিএনপির চেয়ারপারসন অভিযোগ করেছিলেন যে, এই ট্রাইব্যুনাল পক্ষপাতদুষ্ট। এ ধরনের কাণ্ডকারবারের পর শুধু বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল কেন, যেকোনো বিবেকবান মানুষ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলবেই। কিন্তু বাংলাদেশের সুশীলসমাজের বিবেক আওয়ামী লীগের আলোয় আলোকিত। তাদের বিবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের বিবেক দিয়ে  পরিচালিত হয়।

সুশীলসমাজের কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষেও বক্তব্য রাখছেন। কোন যুক্তিতে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে তা নিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে বিভক্তিও রয়েছে। আদর্শবিচ্যুত বাম প্রভাবাধীন সুশীলেরা মনে করেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দুনিয়ার বহু দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তো বটেই, এদের চোখে আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এ ধরনের যুক্তিতে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলে যে মানুষের রাজনৈতিক দল গঠনের মৌলিক অধিকার হরণ করা হবে, সে যুক্তি তারা মানতে নারাজ। ’৭২ সালে পতিত বামেরা যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে সব দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন কায়েমের জন্য প্ররোচিত করেছিল এদের পরামর্শ এখন এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই একদলীয় শাসন কায়েমের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে কত বড় মূল্য দিতে হয়েছে, সে দিকটি তারা বিবেচনায় আনতে নারাজ।

আবার আরেকটি অংশ মনে করে, যেহেতু জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছেÑ এ কারণে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। মাওলানা আবুল কালাম আযাদের রায়ে আমরা এমন ইঙ্গিত পাচ্ছি। যদিও বাংলাদেশে আদালতের রায় নিয়ে তুলনামূলক পর্যালোচনা বা অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণ খুব একটা হয় না। আবুল কালাম আযাদ ’৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষী দিয়েছেন তারা জামায়াত নয় বরং রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগের সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন। রাজাকার, আলবদর যদি সহযোগী বাহিনী হয় সেগুলো ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী। জামায়াতে ইসলামী তো রাষ্ট্রীয় কোনো সেনবাহিনী ছিল না। আরো অনেক রাজনৈতিক দলের মতো একটি রাজনৈতিক দল ছিল। যে দলটি অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাহলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী কেন তাতে অভিযুক্ত হবে, তা একটি বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের ৯০ শতাংশের জন্ম স্বাধীনতার পর। এদের নেতৃত্বের একটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি তোলার যৌক্তিকতা কোথায়?

আমরা দেখছি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজপথের আন্দোলনের পর সুশীলসমাজের কেউ কেউ অবস্থান পরিবর্তন করছেন। এখন বলা শুরু করেছেন, এত বিপুল তরুণের উপস্থিতি আছে এমন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে মিসর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের নাম পরিবর্তনের পরেও তাদের উত্থানকে উদহারণ হিসেবে তুলে ধরে বলা হচ্ছে, এর ফলে তাদের আন্দোলন আরো বেশি বেগবান হয়ে উঠতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে সুশীলসমাজ ও আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমাজে উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক অস্তিত্ব স্বীকার করার মানসিকতার ঘাটতি প্রবলভাবে ফুটে উঠছে। ফলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি, জামায়াত-বিএনপি কিংবা জামায়াত-আওয়ামী লীগ সর্ম্পক নিয়ে তারা কোনো ভারসাম্যমূলক কিংবা নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করতে পারছেন না। সুশীল এই বুদ্ধিজীবীকুল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নামে মূলত ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদের পপুলার জনভিত্তি থাকে। হিটলারও নির্বাচিত হয়েছিলেন বিপুল ভোটে। তার পাশেও তৎকালীন জার্মানির শিক্ষিতসমাজ এবং প্রচারযন্ত্র দাঁড়িয়েছিল। এখনো এই সুশীল বুদ্ধিজীবীরা জামায়াতের বিরোধিতার নামে প্রধান বিরোধী দলকেও আঘাত করছেন একই উদ্দেশ্য নিয়ে, যাতে আওয়ামী লীগের একদলীয় রাজনীতিকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেয়া যায়। এক-এগারোর পর এই সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এদের অধীনে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ব্রুট মেজরিটি দিয়ে বিজয়ী করা হয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল একনায়কত্ববাদী শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে, যাতে আইন প্রণয়নে কোনো সমস্যাই না হয়। একইভাবে বিচার বিভাগকেও ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতায় থাকার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। এ কারণে আমরা এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখে প্রতিনিয়ত বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিচারের হুমকি শুনছি। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, সুশীলসমাজের ইসলামপন্থী রাজনীতি বিশেষ করে জামায়াতের বিরুদ্ধে যে কঠোর অবস্থান, তা আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটি অংশ মাত্র। এই সুশীলসমাজের সাথে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ যোগ দিয়েছেন। মতিঝিলে ছাত্রশিবিরের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের পর ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই এক বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু পুরান ঢাকার ক্ষুদ্রব্যবসায়ী বিশ্বজিৎকে যখন কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তখন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেনি। অবশ্য এফবিসিসিআই ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের একটি পকেট সংগঠনে পরিণত হয়েছে। গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে যখন শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারার কারণে পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের দাবি ওঠে, তখন তারা লাজবাব হয়ে যান; কিন্তু যখন বিরোধীদলীয় নেতা শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম গুমের কথা বলে সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন, তখন এই ব্যবসায়ীরা দ্রুত তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। বিরোধীদলীয় নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সাথে তারাও সায় দেন। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের সাথে সুশীলসমাজ ব্যবসায়ী আর প্রচারযন্ত্র এখন যৌথভাবে কাজ করছে। বিএনপির ভেতরের সুশীলবান্ধব নেতারা তা কতটা উপলব্ধি করতে পারছেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

alfazanambd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.