কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন-সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় দেন।
কিন্তু এ রায় বিচারপ্রত্যাশী মানুষকে খুশি করতে পারেনি বরং অনেকে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে রায় ঘোষণার আগের দিন সোমবার সকালে সরকারের অনুমতি নিয়ে জামায়াতে ইসলামী রাজধানীর মতিঝিলে সমাবেশ করে। জনসভা থেকে বিচার বন্ধ, ট্রাইব্যুনাল বাতিল এবং আটক নেতাদের মুক্তির দাবি করা হয়। অন্যথায় সারা দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে বলে হুঁশিয়ার করে দেন জামায়াতের নেতারা। পরদিন কাদের মোল্লার মামলার রায় ঘোষণা করা হবে- এটি জানার পরপর সোমবার দুপুরেই জামায়াত মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করে। সোমবার বিকেল থেকেই ব্যাপক ধ্বংসাত্মক তৎপরতা শুরু করে জামায়াত-শিবির। রাতে উত্তরায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হলে বাসের যাত্রী এক ব্যাংক কর্মকর্তা পুড়ে মারা যান। মঙ্গলবারও সারা দেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তারা এর আগেও পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা, পুলিশ হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া, পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়, শত শত গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়ে আসছিল। কিন্তু এসবের ব্যাপারে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মুখে অনেক কিছু বললেও কার্যত এক ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এমনও অভিযোগ করা হয়েছে, সরকার জামায়াতের সঙ্গে গোপন সমঝোতার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা নিয়ে জনমনে ক্রমেই সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একাত্তর সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সেই বিচারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় জনগণ তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ক্ষমতায় পাঠায়। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ায় ধীরগতি, অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট দুর্বলতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে থাকে। বিচারালয়, সাক্ষী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তার দিকটিও ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর পরও জাতির প্রত্যাশা ছিল, বিলম্বে হলেও প্রত্যাশিত রায় তারা পাবে। কিন্তু কাদের মোল্লার রায়ে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে সরাসরি ও তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক বিশিষ্টজন। অবশ্য আইনমন্ত্রী বলেছেন, সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। কিন্তু তা কি মানুষের ভাঙা আস্থাকে জোড়া লাগাতে পারবে?
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশের জন্ম, সে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা তাদের কৃত অপরাধের বিচার বন্ধ করার দাবি তোলে কিভাবে? কিংবা এসব দাবি আদায়ের জন্য তারা সহিংসতার আশ্রয় নিলেও রাষ্ট্র তাদের ব্যাপারে নমনীয় থাকে কেন- সাধারণ মানুষও আজ এসব প্রশ্ন করছে। অতীতে প্রচলিত আদালতকে না মানা এবং দাবি আদায়ে সহিংসতার আশ্রয় নেওয়ায় জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহ্‌রীরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাহলে সেই একই বিচার কেন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তুলতে হলে সাধারণ মানুষের এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে জনমনে যাতে সংশয় আর না বাড়ে সে জন্য সরকারকে আরো দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.