বার্মিজ ও ইন্ডিয়ান প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে ভয়াবহ ভূমিকম্প- সাত মাত্রার হলে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশে

 রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ধ্বংসসত্মূপে পরিণত হবে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মহানগরী। ধসে পড়বে প্রায় তিন লাখ ভবন। মৃতু্য হতে পারে সোয়া দু'লাখ মানুষের।
আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে চার লাখের বেশি। তবে দিনের বেলায় ভূমিকম্প হলে নিহত ও আহতের সংখ্যা কম হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্মিজ ও ইন্ডিয়ান পেস্নট দু'টির মুখোমুখি সংঘর্ষ বা একটি আরেকটির ওপর উঠে গেলে বাংলাদেশে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় গভীর ফাটল সৃষ্টি হওয়ায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা। তাঁরা বলছেন, রাজধানীতে ৯৫ ভাগ ঘরবাড়ি নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানায় ৰয়ৰতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এছাড়া ঘনবসতি হওয়ার কারণে ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ। বাংলাদেশে গত ২শ' বছরে পাঁচ হাজার ও বিগত পাঁচ বছরে ৬শ' ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তাই প্রস্তুতি জরম্নরী। সরকারের পৰ থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। উদ্ধার কাজের জন্য ৪২ হাজার কর্মীর প্রশিৰণ চলছে। আগামী এক মাসের মধ্যে চূড়ানত্ম হচ্ছে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন। শুরম্ন হয়েছে নতুন বিল্ডিং তৈরির প্রক্রিয়া। উদ্ধার কাজের জন্য পর্যায়ক্রমে ১৪০ কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনবে সরকার। ৫-৬ মার্চ দু'দিনব্যাপী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ আয়োজিত তৃতীয় ভূকম্পন বিষয়ক সিম্পোজিয়ামে অংশ নেয়া দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পের ব্যাপারে বাংলাদেশকে দিয়েছেন চূড়ানত্ম সতর্ক বার্তা। সেই সঙ্গে তাগিদ দিয়েছেন যে কোন সময় ভয়াবহ প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশের সব ক'টি বিভাগীয় শহর। এর মধ্যে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম সবচেয়ে এগিয়ে। মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রাজধানী ঢাকা। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ করায় ধ্বংসসত্মূপ ও মৃতের সংখ্যা বাড়বে; পঙ্গু হবে অসংখ্য মানুষ। দেখা দিতে পারে জাতীয় দুর্যোগ। খাদ্যের জন্য হতে পারে হাহাকার। বাড়বে অনাথ শিশুর সংখ্যা। কমবে মাথাপিছু আয়। সেই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কাও সমানতালে। বাংলাদেশের ২০১৫ সালে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের ৰেত্রে অন্যতম অনত্মরায় হিসেবে কাজ করতে পারে ভূমিকম্প। তাই ভবন নির্মাণে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত। মাত্রাতিরিক্ত চাপে দেবে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা।
জরিপ : বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিষয়ে খাদ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কমপ্রেহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএমপি) ও এশিয়ান ডিজাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টারের (এডিপিসি) সহযোগিতায় একটি গবেষণা জরিপ চালানো হয। এতে দেখা যায়, রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প রাজধানীতে হলে ৭৮ হাজার ৩২৩টি ভবন পুরোপুরি ধসে পড়বে। সাত মাত্রার বেশি হলে ৭২ হাজার ৩১৬টি পুরোপুরি; ৫৩ হাজার ১৬৬টি ভবন আংশিক ৰতিগ্রসত্ম হবে। ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে মারা যাবে এক লাখ ৩১ হাজার মানুষ। আহত হবে ৩২ হাজার। সৃষ্টি হবে এক লাখ ১৫ হাজার ২০০ টন ধ্বংসসত্মূপ। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে আড়াই লাখ ভবন ধসে পড়বে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার ভবন ৰতিগ্রসত্ম হবে। মারা যেতে পারে প্রায় এক লাখ মানুষ। একই মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটে ৪০ হাজার ভবন বিধ্বসত্ম হবে। ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা।
কেন ঝুঁকিপূর্ণ : বিশেষজ্ঞদের মতে, বার্মিজ ও ইন্ডিয়ান পেস্নটের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান। এ দু'টি টেকটোনিক পেস্নটের মুখোমুখি সংঘর্ষ বা একটি আরেকটির ওপর উঠে গেলে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সে ৰেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অনেক শহর ধ্বংসসত্মূপে পরিণত হবে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতীয় টেকটোনিক পেস্নট বছরে ৬ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বে সরে যাচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের পেস্নট বছরে ২ সেন্টিমিটার করে পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের শিলাসত্মরের অভ্যনত্মরে বিপুল পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এ সঞ্চিত শক্তি শিলাসত্মরের সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলেই ঘটে যাবে মহাধ্বংসযজ্ঞ। ভূমিকম্পের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে উচ্চ, মাধ্যম ও কম ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে ফেনী হয়ে ভারতের অসম পর্যনত্ম বিসত্মীর্ণ এলাকায় গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের ফাটল রেখা থেকে রিখটার স্কেলে আট মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রস্তুতি : ভূমিকম্প মোকাবেলায় সরকারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নেয়া হচ্ছে দেশী ও আনত্মর্জাতিক ভূমিকম্প গবেষকদের মতামত ও পরামর্শ। সরকারের খাদ্য, দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভূমিকম্পপরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় ১৪০ কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার পরামর্শ দিয়েছিল বিশেষজ্ঞ কমিটি। এর মধ্যে ৭০ কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যে আনা হয়েছে। ধসে পড়া ভবনে জীবিত কেউ আছে কিনা তা পরীৰা করার জন্য আনা হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্র। সংশিস্নষ্টরা বলছেন, উদ্ধার কাজে নতুন এ যন্ত্রটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। উদ্ধার কাজের জন্য ৪২ হাজার কর্মীর প্রশিৰণ চলছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ৬২ হাজার প্রশিৰিত উদ্ধারকর্মী তৈরি করবে সরকার। আর্মড ফোর্স, ফায়ার সার্ভিস ও বেসামরিক বাহিনী উদ্ধার কাজে যোগ দেবে। জরম্নরী ত্রাণ ও খাদ্য সহায়তায় সরকারের সংশিস্নষ্ট বিভাগগুলোকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিল্ডিং কোড পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নতুন বিল্ডিং কোড নির্ধারণ ও সে অনুযায়ী ভবন নির্মাণের সার্বিক বিষয় সরকারের পৰে দেখভাল করবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। দুর্যোগমন্ত্রী ড. আদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে উদ্ধার কাজের জন্য আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে আনত্মরিক। প্রয়োজনে এ খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো হবে। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর মধ্যে হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস স্টেশনসহ গুরম্নত্বপূর্ণ স্থাপনা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভূমিকম্প সহায়ক করে তোলা হবে।
আর্থর্কোয়েক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত ভবনগুলোর মধ্যে হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসসহ গুরম্নত্বপূর্ণ স্থাপনা ভূমিকম্পের সহায়ক করে তোলা হবে। নতুন প্রযুক্তিতে এসব ভবন নিরাপদ থাকবে। ঢাকায় ভূমিকম্প হলে এক লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। তবে সময়ের প্রেৰিতে মৃতের সংখ্যা ৮০ হাজারও হতে পারে। হাইতির ভূমিকম্পের প্রভাব আমাদের দেশে বিসত্মারের আশঙ্কা নেই। ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে সরকারীভাবে স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুতি জরম্নরী। পাশাপাশি প্রশিৰিত বাহিনী আর্মড ফোর্স ও ফায়ার সার্ভিসকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.