মোবাইল ফোনে চাঁদাবাজি ঠেকানো যাচ্ছে না যে কারণে- ভুয়া সেটে বাজার সয়লাব ॥ আইএমইআই নম্বর না থাকায় শনাক্ত হচ্ছে না অপরাধী

পুরনো ঢাকার একটি মোবাইল মার্কেটে সপ্তাহব্যাপী মোবাইল মেলা চলছে। মেলায় উপচেপড়া ভিড়। মেলায় সর্বশেষ মডেলের নোকিয়া এন-৯৫, ৯৬ থেকে শুরু করে এন-৮৬ মডেলের সেট ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখে বিস্মিত হতে হলো।
এগুলো দেখতে একই রকম হলেও ফাংশন আসল নোকিয়ার মতো নয়। আবার কোন কোনটায় স্যাটেলাইট কানেকশন দিলে পুরোদস্তুর টিভি সেটের মতো টিভিও দেখা যায়। দোকানিরা জানালেন, এগুলো চীনা মোবাইল সেট। বলাবাহুল্য, মেলাটিই ছিল চায়না মোবাইল মেলা। সেটগুলোর একটিই সমস্যা, এর কোনটাতেই আন্তর্জাতিক মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি-আইএমইআই নম্বর নেই। এতৰণে এত সসত্মায় মোবাইল বিক্রির কারণ বোঝা গেল। এই আইএমইআই নম্বর থাকা না থাকাকে এখানকার দোকানি বা ক্রেতা কেউই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে না দেখলেও এটা রীতিমতো অপরাধ বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেল।
অভিযোগ রয়েছে, বিটিআরসির নজরদারি না থাকায় রাজধানীর মোবাইল মার্কেটগুলো এখন সয়লাব হয়ে গেছে ভুয়া আইএমইআই নম্বরসমৃদ্ধ এমনকি আইএমইআই নম্বরবিহীন মোবাইল ফোন সেটে। চীন থেকে সস্তায় আমদানি করা এসব সেট স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করার জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে কোন প্রকার আইএমইআই নম্বরের তোয়াক্কা করে না। যে কারণে রাজধানীতে মোবাইলে হুমকি এবং চাঁদাবাজির ঘটনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেলেও সঠিক আইএমইআই নম্বর না থাকায় পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মোবাইল ফোনে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা কমিয়ে আনতে ফোন রেজিস্ট্রেশনে সরকারের সাম্প্রতিক কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি আইএমইআইবিহীন এবং ভুয়া আইএমইআই নম্বর সংবলিত মোবাইল ফোন সেট বিক্রি বন্ধ করাও জরুরী বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
ডিবি পুলিশের একটি সূত্র মতে, কোন মোবাইল থেকে কাউকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ মিললে সেই মোবাইল সেটটির আইএমইআই নম্বর আগে শনাক্ত করা হয়। আনত্মর্জাতিক মোবাইল ফোন নির্মাণের শর্ত মোতাবেক প্রতিটি মোবাইল ফোনেরই একটি করে ১৪ থেকে ১৭ ডিজিটের আইএমইআই নম্বর থাকতে হবে। কোন সিম থেকে কল করা হলে সেই সিম নম্বরটিসহ মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বরটিও নেটওয়ার্কে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। কাজেই আইএমইআই নম্বর শনাক্ত হলে হুমকিদাতা সেই সিমটি ফেলে দিয়ে অন্য সিম ব্যবহার করলেও তার অবস্থান সম্পর্কে সহজেই নিশ্চিত হওয়া যায়। সহকারী পুলিশ কমিশনার সানোয়ার হোসেনের তথ্য মতে, সম্প্রতি একটি চাঁদা দাবির ঘটনার তদন্তে গিয়ে একটি আইএমইআই নম্বরের বিপরীতে সাড়ে ১২ হাজার মোবাইল সেট থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। অথচ, সঠিক আইএমইআই নম্বর থাকলে অপরাধীর অবস্থান শনাক্ত করা মাত্র ৩০ সেকেন্ডের ব্যাপার বলে তিনি মনন্তব্য করেন।
প্রত্যেক মোবাইল ফোন সেটে নির্দিষ্ট একটি আইএমইআই নম্বর রয়েছে। মোবাইল ফোনের স্টার, হ্যাশ জিরো সিক্স এবং হ্যাশ বাটন চাপলেই (*#০৬#) যার যার মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর দেখা যায়; যা অনেক ফোন সেটে সিরিয়াল নম্বর হিসেবেও লিপিবদ্ধ থাকে। আবার স্টার, হ্যাশ চারটি শূন্য চেপে পুনরায় হ্যাশ বাটনে চাপ দিলেই (*#০০০০#)মোবাইল সেটটির সফটওয়্যার ভার্সন এবং সেট তৈরির মেয়াদ প্রদর্শন হয়। নকল সেটে এগুলো থাকে না বা একই সিরিয়ালের একাধিক সেটে ব্যবহার করা হয়। চীন থেকে এক মোবাইল সেট আমদানিকারকের তথ্য মতে, এখন মোবাইল ফোনের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। নোকিয়া মোবাইল সেট পর্যন্ত যেগুলো ওয়ারেন্টি দিয়ে ঢাকার বাজারে বিক্রি হয় সেগুলোও চীনের তৈরি। চীনের ঘরে ঘরে কুটির শিল্পের আদলে মোবাইল তৈরির ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠায় তারা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যে কোন দামে মোবাইল সেট সরবরাহে সৰম। ইংল্যান্ডভিত্তিক ব্রিটিশ এ্যাম্প্রুভাল বোর্ড ফর টেলিকমিউনিকেশন্স (বিএবিটি) আন্তর্জাতিকভাবে আইএমইআই নম্বর প্রদানের বিষয়টি দেখভাল করছে। এজন্য অতিরিক্ত কিছু ফি প্রদান করতে হয়। চীনভিত্তিক অনেক মোবাইল কোম্পানিই এই নম্বর গ্রহণের তোয়াক্কা করে না। এমনকি ভুয়া নম্বর পর্যন্ত ব্যবহার করেই মোবাইল ফোন বাজারজাত করে থাকে। দাম কম হওয়ায় দেশের অনেক ব্যবসায়ীই স্বল্পমূল্যের সেসব সেট কিনে আনেন। আন্তর্জাতিক ৰেত্রে বিএবিটির সদস্য হলেও বাংলাদেশে এসব মোবাইল সেট অবৈধ পন্থায় বাজারজাত হচ্ছে। নিয়মমাফিক প্রতিটি জিএসএম এবং ইউএমটিএস ভিত্তিক সেলুলার, মোবাইল সেটে আইএমইআই নম্বরসহ বাজারজাত করা এবং এর তদারকির দায়িত্ব বিটিআরসির ওপর ন্যস্ত থাকলেও তাদের ঢিলেমির কারণে এসব মোবাইল সেট বাজারজাত হচ্ছে। এ সম্পর্কে ডিবি পুলিশের সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ শাখার সাম্প্রতিক তথ্য মতে, এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিগত এক বছরে মোবাইল ফোন সম্পর্কে এক হাজর ৩শ' ৪২টি অভিযোগ লিপিবদ্ধ হওয়ায় ২ হাজার ৪শ' ৫১টি সিম বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। ভুয়া আইএমইআই নম্বর ব্যবহারের কারণে এখানে মোবাইলে সংঘটিত নানা অপরাধের জন্য কেবল সিম বন্ধের মাধ্যমেই পুলিশী এ্যাকশন সীমাবদ্ধ রাখা হয়। সঠিক আইএমইআই নম্বর শনাক্ত করা গেলে এক্ষেত্রে অপরাধীদেরও ধরে ফেলা সম্ভব ।
সূত্রাপুর এবং কোতোয়ালি থানা পুলিশ সূত্র মতে, এই এলাকায় মোবাইলে ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা দাবির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ৰেত্রেই ব্যবসায়ীরা এখানে বোবা চাঁদাবাজির শিকার বলে স্বীকার করে কোতোয়ালি থানার এক দারোগা বলেন, প্রাণের ভয়ে অনেকেই পুলিশে অভিযোগ না করে গোপনে চাঁদা পরিশোধ করে দেন। আবার ভুয়া রেজিস্ট্রেশনসহ সিম এবং ভুয়া আইএমইআইওয়ালা মোবাইল ব্যবহার করায় অনেকে পুলিশে অভিযোগ করলেও পুলিশ অপরাধীকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবিকারী সন্ত্রাসীদের সহজে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বলে দু'টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ সালাউদ্দিন এবং আব্দুল হানিফ উভয়েই স্বীকার করেছেন। অতীতে, উত্তরায় চাঞ্চল্যকর শাহীন হত্যা মামলা, হাতিরপুলে মহিলা আইনজীবী হত্যা মামলা, ব্র্যাক ব্যাংকের লকার ভেঙ্গে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা রেখেছিল মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর। কিন্তু চীন থেকে আইএমইআইবিহীন মোবাইল সেট আমদানি শুরু হবার পর থেকে পুলিশের অপরাধী খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে। উদ্ধার করা যাচ্ছে না হারিয়ে যাওয়া মোবাইল সেট পর্যন্ত।
১৮ বছরের নিচের সন্তানদের অভিভাবকের মাধ্যমে সিমকার্ড কিনতে হবে। আবেদন করতে হবে নির্ধারিত ফরমের মাধ্যমে। সকল সিমকার্ডের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। বিষয়টি তদারকির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে দু'টি কমিটি কাজ করবে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিমকার্ডের মাধ্যমে কাউকে হুমকি, চাঁদাবাজি বা কোন অপরাধ ঘটলে তার দায়দায়িত্ব মোবাইল কোম্পানিকেই বহন করতে হবে। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন ঘোষণার পরও ভুয়া আইএমইআই ওয়ালা মোবাইল বিক্রি বন্ধ করা না গেলে মোবাইলে সংঘটিত অপরাধ কমবে না বলেই অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত। পুলিশের একটি সূত্র মতে, এটি তদারকির দায়িত্বে থাকা বিটিআরসির কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একাধিকবার পুলিশের পৰ থেকে আবেদন নিবেদন করা হয়ছে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। এ সম্পর্কে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) জিয়া আহমেদ সম্প্রতি মিডিয়াকে জানান, ব্র্যান্ডের সেটের চেয়ে দাম কম বলেই বাজারে সাধারণত ঐ ধরনের মোবাইল সেট বিক্রি হচ্ছে। সসত্মা হওয়ায় অনেকেই ঐ ধরনের সেট ব্যবহারে ঝুঁকেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, বিটিআরসির জনবল স্বল্পতার মাঝে এটি শনাক্ত করা একটি দুরূহ প্রক্রিয়া। নাম রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটি যথার্থভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে মোবাইল অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে বলেও মনত্মব্য করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.