পরিবহন খাতে সন্ত্রাস চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা- ১৯ সদস্যের কমিটি by শংকর কুমার দে

সারাদেশের দেড় শতাধিক পরিবহন কোম্পানির ২০ সহস্রাধিক গাড়ি থেকে বছরে ৪ শতাধিক কোটি টাকার চাঁদা আদায় হচ্ছে। সোনার খনি অভিহিত বাস টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ড, বাস কাউন্টারগুলোতে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব।
হঠাৎ করেই পরিবহন সেক্টর দখল ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে ঠেলে দেয়ার ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নেতৃত্বাধীন সংগঠন ও কোম্পানিগুলো একত্রিত হয়ে পরিবহন সেক্টরকে উত্তপ্ত ও অশান্ত করার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার খুনীচক্রের এক আত্মীয় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে চাঁদাবাজি ও দখলের আধিপত্য বিস্তারের জন্য পরিবহন সেক্টরকে অশান্ত করে তুলছে বলে পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ রাজধানীর চাঁদাবাজি, মাদকদ্রব্য, সন্ত্রাসী, অস্ত্র উদ্ধারাভিযান ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে।
রাজধানীর মিরপুরে গত বুধবার পরিবহনের চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে মারামারি, ভাংচুর, সংঘর্ষ ও বাস ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত পরিবহন মালিক_শ্রমিক সংগঠনের পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ঘটনাটি ঘটেছে বলে পুলিশী ও গোয়েন্দা তদন্তে পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খুনী মোশতাকের ভাতিজী জামাই ও পলাতক খুনী কর্নেল (অব) রশীদের এক চাচাত ভাই বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত পরিবহন মালিক_শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরিবহন সেক্টরের দখল ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করানো হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ ও ঢাকা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সংগঠন সমন্বয়ে পরিবহন খাতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধে ১৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ৪ আগস্ট এক বৈঠকে তারা বাসপ্রতি দৈনিক চাঁদা আদায়ের হার নির্ধারণ করে দেয় ৭০ টাকা। এ ৭০ টাকা চাঁদার মধ্যে মালিক সমিতি পাবে ৪০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ২০ টাকা ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন পাবে ১০ টাকা। রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, নয়াবাজার, কমলাপুর, আজিমপুর, মিরপুর বাস টার্মিনাল ও বাসস্ট্যান্ডে সরকার সমর্থিত ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা চাঁদা আদায় করে আসছে। এসব স্থানে নানা কমিটির আড়ালে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে পরিবহন সেক্টরে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধে ১৭ সদস্যের কমিটি গঠন করে চাঁদার হার নির্ধারণ করে দেয়ার ৬ মাস পর গত ২৭ আগস্টে চাঁদার হার নির্ধারণের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে এক রিট পিটিশন করেন মোহাম্মদপুরের বাবুল হোসেন। রাজধানীর ৪টি বাস টার্মিনাল ছাড়াও রাজধানীর রাস্তাঘাটের যত্রতত্র গড়ে ওঠে বাস কাউন্টার ও বাসস্ট্যান্ড। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা বাসস্ট্যান্ড ও বাস কাউন্টারে চাঁদাবাজি ছাড়াও যানজট ও নগরবাসীর বিড়ম্বনার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার একেএম শহীদুল হক বলেছেন, পরিবহন সেক্টরে কারও বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোরহস্তে দমন করা হবে। রাজধানীতে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা, অস্ত্র উদ্ধারাভিযান শুরু হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির বখরা নিয়ে পরিবহন সেক্টর দখল, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির ঘটনা বহু পুরনো। আশির দশকে এরশাদের শাসনামলে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে প্রায় প্রতিমাসেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও সংঘাতে খুন ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটত। এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র মীর্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার সমর্থকদের মধ্যে টার্মিনাল দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনা নিয়ে বহুবার সংঘর্ষ হয়েছে। বিএনপি সরকারের বিদায়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বিনা প্রতিবাদে টার্মিনাল ও চাঁদাবাজি ফেলে পালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মকবুল হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন টার্মিনালগুলো দখল ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক_শ্রমিক সংগঠনের নেতারা পালিয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ নেয় মীর্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার সমর্থকরা। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বহুবার সংঘর্ষ ও সংঘাত হয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেনা সমর্থনে একটি পরিবহন মালিক_শ্রমিক সংগঠন রাতারাতি গজিয়ে উঠে পরিবহন সেক্টর দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিবহন সেক্টরের দুই পক্ষ আত্মপ্রকাশ করে। নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সমর্থক সংগঠন ও অপরটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের এমপি নূর ই আলম চৌধুরীর নিকটাত্মীয় মনির চৌধুরী। দুই পক্ষই ঢাকা পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দাবি করলেও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন খন্দকার এনায়েত উল্লাহর সমর্থকরাই রাজধানীর পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সমিতির লোকজনদের দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন রুট কমিটির নির্ধারিত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরে চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাস ভাংচুর, মারধর, ধর্মঘটের কারণ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের সমর্থিত পরিবহন কোম্পানিগুলো পৃথকভাবে চাঁদা আদায় করার ব্যাপারে এক জোট হয়েছে। আওয়ামী সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তাদের চাঁদাবাজির ঘটনাকে প্রতিহত করে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি, সংঘর্ষ, ভাংচুর ও ধর্মঘটের রূপ নেয়। নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের নেতারাই বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি করছে। বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজির ঘটনা অনেক পুরনো। একদিনে এটা পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না; সময় লাগবে।

No comments

Powered by Blogger.