মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণে বাংলাদেশ কত দূর by কর্নেল এস এম শওকত আলী
ব্যক্তিজীবনে বা সমষ্টিগতভাবে বিশেষ কিছু
অর্জন করতে হলে নিয়মতান্ত্রিক কিছু পন্থা অবলম্বন করতে হয়। প্রথমত, লক্ষ্য
নির্ধারণ করা; দ্বিতীয়ত, লক্ষ্য অর্জনে কী কী উপাত্তের প্রয়োজন; তৃতীয়ত,
উপাত্ত সংগ্রহের কৌশল; চতুর্থত, কী পন্থা অনুসরণ করে নির্ধারিত লক্ষ্য
অর্জন করা হবে।
অতঃপর উলি্লখিত চারটির সম্মিলিত
প্রচেষ্টায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার প্রয়াস। সব সময় যে নিয়মতান্ত্রিক
পন্থা অবলম্বন করে শতভাগ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে, এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ
নেই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতা-উত্তর দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। জাতীয় অর্থনীতি শুধু তলানিতেই উপনীত হয়েছিল না, শূন্য অতিক্রম করে মাইনাস থেকে শুরু করতে হয়েছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের সরকারকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে দেশ পুনর্গঠনের কাজে শক্ত হাতে হাল ধরেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত একটি দেশকে নিজস্ব সম্পদ ছাড়া দাঁড় করানো শুধু দুরূহ নয়, অসম্ভবও বটে। আর সেই দেশ যদি হয় ২৩ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা (বর্তমান পাকিস্তান) সর্বক্ষেত্রে শোষিত বাংলাদেশ। একদিকে সীমিত সম্পদ নিয়ে বা বন্ধুপ্রতিম দেশের সহায়তায় দেশকে পুনর্গঠনের অক্লান্ত প্রচেষ্টা, অন্যদিকে সদ্যপ্রসূত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তি এবং দেশীয় উগ্রবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসরদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র করার প্রয়াসে ১৯৭৪ সালে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র বাধ্য করে দেশকে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত করতে। ফলে প্রাণ দিতে হয় বেশ কিছু ভুখা-নাঙ্গা সাধারণ মানুষকে। এ দুর্ভিক্ষকে পুঁজি করে চলতে থাকে পরাজিত শক্তি এবং তাদের আন্তর্জাতিক দোসরদের একটার পর একটা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। উদ্ভূত পরিস্থিতির গভীরতা অনুধাবন করে একে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে বেছে নেওয়া হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা বা বাকশাল। বাকশাল নিয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের মধ্যে অনেক বিতর্ক থাকলেও এ বিষয়ে এখানে আমি কোনো মন্তব্য করব না। আমার অনুভবে শুধু এটুকুই বলতে চাই 'রাষ্ট্র পরিচালনার একটি পদ্ধতির চিন্তা-চেতনা যা কি না সম্পূর্ণরূপে আলোর মুখ দেখতেও পারেনি, এর ভালো-মন্দ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা ভেবে দেখার বিষয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ইতিহাসের জঘন্য ও নির্মম হত্যার শিকার হন। সহসা নিবে গেল বাঙালি জাতির ধ্বংসস্তূপে নিমজ্জিত অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উত্তরণের প্রদীপ শিখা। একই বছর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষমতার পালাবদল করল খুনি মোশতাক থেকে বিচারপতি সায়েম। অতঃপর ষড়যন্ত্রে সব থেকে অধিক লাভবান জেনারেল জিয়া। সামরিক শাসক দ্বারা যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হয় না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জিয়ার ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত শাসনকাল। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সালে বিচারপতি সাত্তারকে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে জেনারেল এরশাদ দীর্ঘ ৯ বছর সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার কাঁধের ওপর চেপে বসেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০-এ ১৫ বছর ক্যু, কাউন্টার ক্যু আর বেশ কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল হলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে যায়।
বিগত চার দশকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটা শক্ত ভিতের ওপর দণ্ডায়মান। বিগত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ গড়ে ৫.৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথমত, ২০১৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘের দেওয়া মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করা। দ্বিতীয়ত, ২০২১ সালের মধ্যে অর্থাৎ দেশটির স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, যেটাকে বর্তমান সরকার আখ্যায়িত করেছে ভিশন-২০২১ হিসেবে। আপাতদৃষ্টিতে দুটি লক্ষ্য অর্জন সম্ভব মনে হলেও ভবিষ্যতে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে, যদিও বাংলাদেশ তার লক্ষ্যবস্তু স্থির রেখে প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এ ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি প্রয়োজন ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে পর্যায়ক্রমে উন্নতি সাধন অব্যাহত রাখা।
জাতিসংঘ ২০০০ সালে 'মিলেনিয়াম সামিটে' এর সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশ এবং ২৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থা ২০১৫ সালের মধ্যে আর্থসামাজিক উন্নয়নে আটটি বিষয়ে একমত পোষণ করে, যাকে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এ বিষয়গুলো হলো- অতিদরিদ্র ও ক্ষুধা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, নারীদের ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন, এইচআইভি বা এইডস এবং ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং বিশ্ব উন্নয়নে পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিতকরণ। সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে অর্থনীতির পণ্ডিতদের মতে, বাংলাদেশ একটি রোল মডেল। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ক্ষেত্রে লিঙ্গের সমতা, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগ উচ্ছেদ, সুপানীয় ও স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থার উন্নতি সাধন। নারীর ক্ষমতায়নে রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, কূটনীতিসহ সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদে মহিলাদের আরোহণ, এমনকি জাতিসংঘ বাহিনী ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বমন্দা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের জিডিপি ৬- শতাংশের ওপরে অর্জন নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। আর জিএনআইয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২৫টি উন্নয়নশীল দেশের একটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বিশ্ব অর্থনীতির বিশালতার দিক থেকে বাংলাদেশ ৪৩তম স্থানে অবস্থান করছে। মাত্র কয়েক মাস আগে এইচআইপি ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের ১১তম সুখী দেশ। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক, জেপি মর্গান অর্থনীতি উন্নয়নের সম্ভাবনার বিবেচনায় বাংলাদেশকে বিশ্বের পাঁচটি দেশের মধ্যে মনে করেন। যে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭৫ মার্কিন ডলার, তা ২০১২ সালে ৮৪৮ মার্কিন ডলারে উপনীত হয়েছে; যদিও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে মাথাপিছু আয় হতে হবে ন্যূনতম ১০০৬ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নের সফল স্বীকৃতিস্বরূপ বিখ্যাত গোল্ডম্যান স্যাক বিনিয়োগ ব্যাংক ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চীন) পর পরবর্তী উন্নয়নশীল ১১টি দেশের (এনইসি) মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম বলে মনে করে। এই ১১টি দেশ হলো বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম।
২০১১ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ১.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রত্যাশা থেকে অনেক কম হলেও বৈদেশিক বিনিয়োগের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১৬তম স্থানে অবস্থান করছে। তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জ্বালানি ক্রয়ের পরও ২০১০ সাল থেকে বৈদেশিক বিনিময় মজুদ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর, যা এযাবৎকালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০০৯ সালে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৩৫০০ মেগাওয়াট, বর্তমানে তা ৬০০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে সক্ষম; যদিও উৎপাদনের খরচ আধিক্যতায় ৪৫০০ মেগাওয়াট পিক আওয়ারে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই মহিলা। এদের মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ মহিলা জাতীয় অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখছেন। বিগত ২০ বছরের (১৯৯০-২০১০) মধ্যে দরিদ্রতা প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ৩১.৫ শতাংশে কমে এসেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাচুর্যতায় পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে স্বল্পমূল্যের শ্রমিক বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণ করছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিওর যুগান্তকারী অবদান।
আগেই উল্লেখ করেছি, বর্তমানে আমাদের জিডিপি ৬.৩ শতাংশ, আর মাথাপিছু আয় ৮৪৮ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের মতে, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে প্রয়োজন জিডিপি ৭.৫-৮ অর্জন, আর মাথাপিছু আয় ন্যূনতম ১০০৬ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের অন্য সূচকগুলো তো আছেই। উদ্দেশ্য সাধনে বাংলাদেশের আর কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন? এই ফাঁকে দেখে নেওয়া যাক, অর্থনীতিতে অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্তরায়গুলো কী কী? দুর্বল অবকাঠামো ও পরিবহন খাত, অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, দক্ষ জনশক্তির অভাব। এই সাতটি সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান বাধা। মধ্যম আয়ের দেশ বা ভিশন-২০২১ অর্জন করতে হলে এর প্রতিটি বিষয়কে আলাদাভাবে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনে রাজনীতি ছিল আমাদের সব থেকে শক্তিশালী মাধ্যম, যেখানে অর্থনীতি ছিল খুবই দুর্বল আর আজ স্বাধীনতার চার দশক পর অর্থনীতি শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হলেও চলমান রাজনীতির অপসংস্কৃতি অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি, প্রথম পর্যায়ে ২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনে আমরা অনেক দূর এগোলেও কিছু ক্ষেত্রে শতভাগ অর্জন এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এই ঘাটতিগুলো আগামী দুই বছর সর্বস্তরের নিরলস প্রচেষ্টায় চালিয়ে পূর্ণ করতে হবে। অতঃপর এ অর্জনের ওপর দাঁড়িয়ে ভিশন-২০২১ সালের দিকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। রাজনীতি বা সরকার পরিবর্তনে যেন উদ্দেশ্য সাধনে বিন্দুমাত্র প্রভাব না পড়ে, সেদিকে দেশের মানুষকে বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। আমাদের জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করে এর সংখ্যা বর্তমানের ৮০ লাখ থেকে এক কোটিতে দক্ষ শ্রমিক দিয়ে উন্নীত করতে হবে। পোশাকশিল্পকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে একটি সুশৃঙ্খল টেকসই শিল্পে পরিণত করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা ধরে রাখতে হবে। নতুন নতুন রপ্তানিবাজার সৃষ্টি করে অচিরেই চীনকে সরিয়ে বিশ্বের প্রথম পোশাক রপ্তানি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কৃষি খাতে শতভাগ স্বনির্ভরতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। পর্যটন, জাহাজ নির্মাণ, চিংড়ি রপ্তানিসহ সম্ভাবনাময় খাতগুলো চিহ্নিত করে পোশাকশিল্পের মতো বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে আরো অনেক বড় আকারে আবির্ভূত হতে হবে। অর্থনীতির পণ্ডিতরা সচরাচর বলে থাকেন, শুধু পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ১.২ শতাংশ। তাই পদ্মা সেতু প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করে ২০২১ সালের আগে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সব থেকে বড় কথা হলো, একটি শোষণমুক্ত সমৃদ্ধিশালী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়েই ১৯৭১ সালে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলাম। অগণিত আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলেও পূর্ণ হয়নি আমাদের হৃদয় লালিত সে স্বপ্ন। তাই এই ৬০ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে স্বপ্ন পূরণের একটা প্রচ্ছন্ন আভা দেখে আপন মনেই পুলকিত হয়েছি। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে দেশ-বিদেশে তথাকথিত আঁতেলদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। ২০২১ অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের স্বপ্ন ও আমাদের প্রত্যাশা যদি পূরণ হয় আর তা যদি জীবিত অবস্থায় দেখে যেতে পারি, বাঙালি হিসেবে এর থেকে বড় পাওয়া জীবনে আর কী হতে পারে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক
১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতা-উত্তর দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। জাতীয় অর্থনীতি শুধু তলানিতেই উপনীত হয়েছিল না, শূন্য অতিক্রম করে মাইনাস থেকে শুরু করতে হয়েছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের সরকারকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে দেশ পুনর্গঠনের কাজে শক্ত হাতে হাল ধরেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত একটি দেশকে নিজস্ব সম্পদ ছাড়া দাঁড় করানো শুধু দুরূহ নয়, অসম্ভবও বটে। আর সেই দেশ যদি হয় ২৩ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা (বর্তমান পাকিস্তান) সর্বক্ষেত্রে শোষিত বাংলাদেশ। একদিকে সীমিত সম্পদ নিয়ে বা বন্ধুপ্রতিম দেশের সহায়তায় দেশকে পুনর্গঠনের অক্লান্ত প্রচেষ্টা, অন্যদিকে সদ্যপ্রসূত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তি এবং দেশীয় উগ্রবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসরদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র করার প্রয়াসে ১৯৭৪ সালে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র বাধ্য করে দেশকে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত করতে। ফলে প্রাণ দিতে হয় বেশ কিছু ভুখা-নাঙ্গা সাধারণ মানুষকে। এ দুর্ভিক্ষকে পুঁজি করে চলতে থাকে পরাজিত শক্তি এবং তাদের আন্তর্জাতিক দোসরদের একটার পর একটা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। উদ্ভূত পরিস্থিতির গভীরতা অনুধাবন করে একে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে বেছে নেওয়া হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা বা বাকশাল। বাকশাল নিয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীদের মধ্যে অনেক বিতর্ক থাকলেও এ বিষয়ে এখানে আমি কোনো মন্তব্য করব না। আমার অনুভবে শুধু এটুকুই বলতে চাই 'রাষ্ট্র পরিচালনার একটি পদ্ধতির চিন্তা-চেতনা যা কি না সম্পূর্ণরূপে আলোর মুখ দেখতেও পারেনি, এর ভালো-মন্দ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটা ভেবে দেখার বিষয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ইতিহাসের জঘন্য ও নির্মম হত্যার শিকার হন। সহসা নিবে গেল বাঙালি জাতির ধ্বংসস্তূপে নিমজ্জিত অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উত্তরণের প্রদীপ শিখা। একই বছর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষমতার পালাবদল করল খুনি মোশতাক থেকে বিচারপতি সায়েম। অতঃপর ষড়যন্ত্রে সব থেকে অধিক লাভবান জেনারেল জিয়া। সামরিক শাসক দ্বারা যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হয় না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জিয়ার ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত শাসনকাল। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সালে বিচারপতি সাত্তারকে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে জেনারেল এরশাদ দীর্ঘ ৯ বছর সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার কাঁধের ওপর চেপে বসেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০-এ ১৫ বছর ক্যু, কাউন্টার ক্যু আর বেশ কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল হলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে যায়।
বিগত চার দশকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটা শক্ত ভিতের ওপর দণ্ডায়মান। বিগত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ গড়ে ৫.৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথমত, ২০১৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘের দেওয়া মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করা। দ্বিতীয়ত, ২০২১ সালের মধ্যে অর্থাৎ দেশটির স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, যেটাকে বর্তমান সরকার আখ্যায়িত করেছে ভিশন-২০২১ হিসেবে। আপাতদৃষ্টিতে দুটি লক্ষ্য অর্জন সম্ভব মনে হলেও ভবিষ্যতে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে, যদিও বাংলাদেশ তার লক্ষ্যবস্তু স্থির রেখে প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এ ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি প্রয়োজন ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে পর্যায়ক্রমে উন্নতি সাধন অব্যাহত রাখা।
জাতিসংঘ ২০০০ সালে 'মিলেনিয়াম সামিটে' এর সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশ এবং ২৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থা ২০১৫ সালের মধ্যে আর্থসামাজিক উন্নয়নে আটটি বিষয়ে একমত পোষণ করে, যাকে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এ বিষয়গুলো হলো- অতিদরিদ্র ও ক্ষুধা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, নারীদের ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন, এইচআইভি বা এইডস এবং ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং বিশ্ব উন্নয়নে পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিতকরণ। সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে অর্থনীতির পণ্ডিতদের মতে, বাংলাদেশ একটি রোল মডেল। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ক্ষেত্রে লিঙ্গের সমতা, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগ উচ্ছেদ, সুপানীয় ও স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থার উন্নতি সাধন। নারীর ক্ষমতায়নে রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, কূটনীতিসহ সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদে মহিলাদের আরোহণ, এমনকি জাতিসংঘ বাহিনী ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বমন্দা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের জিডিপি ৬- শতাংশের ওপরে অর্জন নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। আর জিএনআইয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২৫টি উন্নয়নশীল দেশের একটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, বিশ্ব অর্থনীতির বিশালতার দিক থেকে বাংলাদেশ ৪৩তম স্থানে অবস্থান করছে। মাত্র কয়েক মাস আগে এইচআইপি ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের ১১তম সুখী দেশ। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক, জেপি মর্গান অর্থনীতি উন্নয়নের সম্ভাবনার বিবেচনায় বাংলাদেশকে বিশ্বের পাঁচটি দেশের মধ্যে মনে করেন। যে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭৫ মার্কিন ডলার, তা ২০১২ সালে ৮৪৮ মার্কিন ডলারে উপনীত হয়েছে; যদিও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে মাথাপিছু আয় হতে হবে ন্যূনতম ১০০৬ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নের সফল স্বীকৃতিস্বরূপ বিখ্যাত গোল্ডম্যান স্যাক বিনিয়োগ ব্যাংক ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চীন) পর পরবর্তী উন্নয়নশীল ১১টি দেশের (এনইসি) মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম বলে মনে করে। এই ১১টি দেশ হলো বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম।
২০১১ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ১.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রত্যাশা থেকে অনেক কম হলেও বৈদেশিক বিনিয়োগের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১৬তম স্থানে অবস্থান করছে। তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জ্বালানি ক্রয়ের পরও ২০১০ সাল থেকে বৈদেশিক বিনিময় মজুদ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর, যা এযাবৎকালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০০৯ সালে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৩৫০০ মেগাওয়াট, বর্তমানে তা ৬০০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে সক্ষম; যদিও উৎপাদনের খরচ আধিক্যতায় ৪৫০০ মেগাওয়াট পিক আওয়ারে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই মহিলা। এদের মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ মহিলা জাতীয় অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখছেন। বিগত ২০ বছরের (১৯৯০-২০১০) মধ্যে দরিদ্রতা প্রায় ৬০ শতাংশ থেকে ৩১.৫ শতাংশে কমে এসেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাচুর্যতায় পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে স্বল্পমূল্যের শ্রমিক বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণ করছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিওর যুগান্তকারী অবদান।
আগেই উল্লেখ করেছি, বর্তমানে আমাদের জিডিপি ৬.৩ শতাংশ, আর মাথাপিছু আয় ৮৪৮ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের মতে, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে প্রয়োজন জিডিপি ৭.৫-৮ অর্জন, আর মাথাপিছু আয় ন্যূনতম ১০০৬ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের অন্য সূচকগুলো তো আছেই। উদ্দেশ্য সাধনে বাংলাদেশের আর কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন? এই ফাঁকে দেখে নেওয়া যাক, অর্থনীতিতে অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্তরায়গুলো কী কী? দুর্বল অবকাঠামো ও পরিবহন খাত, অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, দক্ষ জনশক্তির অভাব। এই সাতটি সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান বাধা। মধ্যম আয়ের দেশ বা ভিশন-২০২১ অর্জন করতে হলে এর প্রতিটি বিষয়কে আলাদাভাবে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনে রাজনীতি ছিল আমাদের সব থেকে শক্তিশালী মাধ্যম, যেখানে অর্থনীতি ছিল খুবই দুর্বল আর আজ স্বাধীনতার চার দশক পর অর্থনীতি শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হলেও চলমান রাজনীতির অপসংস্কৃতি অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি, প্রথম পর্যায়ে ২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনে আমরা অনেক দূর এগোলেও কিছু ক্ষেত্রে শতভাগ অর্জন এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এই ঘাটতিগুলো আগামী দুই বছর সর্বস্তরের নিরলস প্রচেষ্টায় চালিয়ে পূর্ণ করতে হবে। অতঃপর এ অর্জনের ওপর দাঁড়িয়ে ভিশন-২০২১ সালের দিকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। রাজনীতি বা সরকার পরিবর্তনে যেন উদ্দেশ্য সাধনে বিন্দুমাত্র প্রভাব না পড়ে, সেদিকে দেশের মানুষকে বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। আমাদের জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করে এর সংখ্যা বর্তমানের ৮০ লাখ থেকে এক কোটিতে দক্ষ শ্রমিক দিয়ে উন্নীত করতে হবে। পোশাকশিল্পকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে একটি সুশৃঙ্খল টেকসই শিল্পে পরিণত করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা ধরে রাখতে হবে। নতুন নতুন রপ্তানিবাজার সৃষ্টি করে অচিরেই চীনকে সরিয়ে বিশ্বের প্রথম পোশাক রপ্তানি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কৃষি খাতে শতভাগ স্বনির্ভরতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। পর্যটন, জাহাজ নির্মাণ, চিংড়ি রপ্তানিসহ সম্ভাবনাময় খাতগুলো চিহ্নিত করে পোশাকশিল্পের মতো বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে আরো অনেক বড় আকারে আবির্ভূত হতে হবে। অর্থনীতির পণ্ডিতরা সচরাচর বলে থাকেন, শুধু পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ১.২ শতাংশ। তাই পদ্মা সেতু প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করে ২০২১ সালের আগে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সব থেকে বড় কথা হলো, একটি শোষণমুক্ত সমৃদ্ধিশালী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়েই ১৯৭১ সালে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব স্তরের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলাম। অগণিত আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলেও পূর্ণ হয়নি আমাদের হৃদয় লালিত সে স্বপ্ন। তাই এই ৬০ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে স্বপ্ন পূরণের একটা প্রচ্ছন্ন আভা দেখে আপন মনেই পুলকিত হয়েছি। কারণ স্বাধীনতার পর থেকে দেশ-বিদেশে তথাকথিত আঁতেলদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। ২০২১ অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের স্বপ্ন ও আমাদের প্রত্যাশা যদি পূরণ হয় আর তা যদি জীবিত অবস্থায় দেখে যেতে পারি, বাঙালি হিসেবে এর থেকে বড় পাওয়া জীবনে আর কী হতে পারে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক
No comments