ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের উদ্বেগ- আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাদের মোল্লার রায় ফলাও প্রচার

আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে গতকাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে (৬৪) হত্যাকাণ্ডসহ ছয়টি অভিযোগের পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর কাদের মোল্লা আদালতে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করেন। তাকে দেয়া এই দণ্ডাদেশের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, বিবিসি, আলজাজিরা, হিন্দুস্তান টাইমস ও পাকিস্তানের দ্য ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়েছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই রায়ের কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। রাজপথে জামায়াতে ইসলামির বিক্ষোভ সমাবেশ আরো জোরদার হতে পারে। জামায়াত মনে করে, সরকার এই বিচারকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কাজে ব্যবহার করছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারাধীন ১০ জনই বিরোধী দলের নেতা। তাদের মধ্যে আটজন জামায়াতের সিনিয়র নেতা। জামায়াত এই ট্রাইবুনালকে বিতর্কিত আখ্যায়িত করে তা বাতিল ও দলের নেতাদের মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে। জেনেভাভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের এশিয়া মহাদেশের পরিচালক সাম জারিফি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বর্তমানে যে সমালোচনা চলছে তা বাংলাদেশকে আরো বিভাজনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে যাতে এই বিচারের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সঙ্ঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত একটি আদালত দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের সমর্থকেরা তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিচারের নামে রাজনৈতিক মতলব হাসিলের অভিযোগ এনেছেন।

বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের কৌঁসুলি ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এই ট্রাইব্যুনালকে ‘একটি উইচহান্ট’ (ভিন্ন মতাবলম্বীদের নির্যাতনের হাতিয়ার) বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলেছে, এই ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানের নয়।

গত মাসে ট্রাইব্যুনাল তার প্রথম রায়ে জামায়াতের সাবেক নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে মানবতাবিরোধী আটটি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দোসরদের বিচার করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামে এই বিশেষ আদালত গঠন করে।

আলজাজিরা জানায়, আবদুল কাদের মোল্লার বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় দাঙ্গা হয়। বিতর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ধর্ষণ, গণহত্যা ও হত্যার দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, কাদের মোল্লাকে ৩৮১ জন নিরস্ত্র বেসামরিক লোককে হত্যাসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে ভূমিকার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তবে কাদের মোল্লা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জামায়াতও তাদের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার ‘সরকারি ব্লু প্রিন্ট’ যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করতে গতকাল মঙ্গলবার দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়।

যে আদালতে এই বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে, সেটি নামে আন্তর্জাতিক হলেও একটি দেশীয় আদালত। ২০১০ সালে গঠিত এ আদালতের আন্তর্জাতিক কোনো মান নেই। এ আদালত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি উভয়ই এ বিচারকে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দকে অযোগ্য ঘোষণার লক্ষ্যে ‘বিচারের নামে প্রহসন’ বলে অভিহিত করেছে।

লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে ‘বাংলাদেশ জেইলস ইসলামিক পার্টি লিডার ফর লাইফ’ শিরোনামে খবরে বলেছে, রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা জামায়াত নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এ রায়কে কেন্দ্র করে গতকাল দলটি সারা দেশে হরতালের ডাক দেয়। ধর্মঘটে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যান চলাচল, দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এ রায় ঘোষণার পর জামায়াত সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে কয়েকজন পুলিশসহ অনেকে আহত হন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আসামিপক্ষের একজন সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করা হয়। যিনি ছিলেন মূলত রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী।

বিএনপি নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ ট্রাইব্যুনালকে প্রহসনের ট্রাইব্যুনাল বলে অভিহিত করেছেন। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে স্বাধীনতার বিরোধীকারীদের সঙ্গ ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার প্রাক্কালে গত সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হলে এক তরুণ ব্যাংকার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। জামায়াত তার নেতৃবৃন্দকে বিচারের নামে হত্যার সরকারি নীলনকশা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার হরতাল চলাকালে পুরান ঢাকায় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি অটোরিকশা ও প্রাইভেটকার ভাঙচুর করা হয়। এই রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে নিরাপত্তা রক্ষায় ১০ হাজার পুলিশ টহলদানে নিয়োজিত ছিল। ব্যবসায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। রাজধানী ঢাকার সাথে অন্যান্য নগরীর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে বগুড়া জেলায় গত বৃহস্পতিবার ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। ওই দিন সেখানে জামায়াতের তিনজন নিহত হন।

হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি দেশীয় আদালত। এর আন্তর্জাতিক মানের ঘাটতি রয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর সিনিয়র রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে টার্গেট করার অভিযোগ আনা হয়েছে। জামায়াত ও বিএনপি উভয় দলই আগামী নির্বাচনে তাদের নেতৃবৃন্দকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণার লক্ষ্যে এই প্রহসনের বিচার চলছে বলে দাবি করে আসছে। কেননা জামায়াতের সব শীর্ষ রাজনীতিক ও বিএনপির দুইজন সিনিয়র রাজনীতিকের বিচার চলছে এই ট্রাইব্যুনালে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই বিচারকার্যক্রমের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা দি ডনও অনুরূপ সংবাদ প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এই রায় ঘোষণা করেন।

রায় ঘোষণার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় তিনি মৃত্যুদণ্ড পাবার যোগ্য। কিন্তু বিচারক তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। তিনি ৩৫০ জনের বেশি লোককে হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন।’

এ দিকে কাদের মোল্লার আইনজীবী নাজিম মোমেন বলেন, ‘এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন রায়ের এই সংবাদ ব্যাংকক পোস্ট ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টও ফলাও করে প্রকাশ করেছে।
       

No comments

Powered by Blogger.