একুশের প্রথম কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী by ড. নীরু শামসুন্নাহার

আজীবন লড়াকু সৈনিক, আলোকের অভিযাত্রী, একুশের প্রথম কবি ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী নিজেই আমাদের চেতনায় হয়ে উঠেছেন একুশের অবিনাশী কবিতা।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিহত শহীদদের স্মরণে রচনা করেন ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একুশের ঐতিহাসিক কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।” এটি প্রকাশের পর তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া হয়। দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর ভালবাসা কিংবদন্তির মত আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কবিতা, নাটক, স্বদেশ জাগরণমূলক লেখালেখি তাঁর জীবন-চর্যার অন্যতম সাধনা। কলম ছিল তাঁর আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষুরধার তলোয়ার। এ দেশের মানুষের কল্যাণ আর শুভ বোধের জন্য আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন অপশক্তির সঙ্গে। কখনও অপোস করেননি। শিশুরাই যে আগামীর স্বপ্ন পূরণের অগ্রদূত সেই গভীর ভাবনা থেকে শিশু-চিত্তে ইতিহাস, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা এবং মানবিক বোধের জাগরণ ঘটাতে শিশু-সাহিত্যের জগতেও অনায়াস দক্ষতায় বিচরণ করেছেন তিনি। তাঁর শিশুদের জন্য রচিত বেশ কিছু অসাধারণ দেশপ্রেমমূলক কবিতা এবং ছড়ার খোঁজ পাইÑ
“...ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে
এমন দেশটি কোথায় আছে
কোন বা দেশের কবির গানে
ঢেউয়ের মত রক্ত নাচে।”
(আমাদের গর্ব)
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কর্মময় জীবনের দিকে তাকালে দেখি তিনি শুধুমাত্র একজন ভাষাসৈনিকই নন, তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে জ্ঞানের বিচিত্রধর্মী অঙ্গনে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন দক্ষ বহুমুখী কর্মযোদ্ধা ছিলেন। নিজের শেকড়ের প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি অফুরন্ত প্রেম ছিল তাঁর। শুধু কাব্য রচনা নয়, এই বহুপ্রজ মানুষটি বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা, শিশু-সাহিত্য রচনা, আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ও অসংখ্য অনুসন্ধিৎসামূলক প্রবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গঠনে নিজেকে আমৃত্যু ব্যাপৃত রেখেছিলেন। দেশের সকল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কথা বলতে গিয়ে মানসপটে ভেসে উঠছে আমার নানাভাই, নিভৃতচারী ভাষাসৈনিক শামসুল আলমের মুখচ্ছবি। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এই পরিষদের আহ্বায়ক হন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রনেতা শামসুল আলম। তিনিও অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন ১৯৯২ সালে। এই সাথে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সাথে তাঁর প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
মাহবুব-জওশন সুখী পরিবার ছিলেন। সহধর্মিণী-স্মৃতিভারাতুর জওশন আরা রহমান মর্মের বান্ধবকে হারিয়ে ইট-কাঠ সিমেন্টের অহল্যা রাজধানীর এক কোণে শুধু তাঁর প্রিয় মানুষটির অজস্র সহজিয়া স্মৃতির সিন্দুক আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন! দেখতে ছোটখাটো মানুষটির ভেতরে ছিল অফুরন্ত প্রাণরস। আলোকের দিশারী হয়ে দেশকে কেমন করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় বিশ্ব-প্রাঙ্গণে তারই সাধনা আজীবন করে গেছেন নিভৃতচারী, নির্লোভ দেশপ্রেমিক এই মানুষটি। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর মাহবুব উল আলম চৌধুরী মর্তলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন সুতোর ওপারে, অন্য আরেক পৃথিবীতে। তিনি যেন আমাদের ‘রহু চ-াল’। তাঁর অঙ্গীকারের কবিতা আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়
“...যতক্ষণ পর্যন্ত না
আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে
আমার স্বপ্নগুলো মানুষের বুকে বুকে
ছড়িয়ে দিতে পারি
ততক্ষণ পর্যন্ত আমি হাঁটতে থাকবো।”
(অঙ্গীকার, সূর্যের ভোর, পৃষ্ঠা-৩৫)
তাঁর মেধা মননের সারাৎসার বাংলাদেশ নামের এই স্বাধীন ভূখণ্ডের প্রতিটি মানুষকে মাথা তুলে যেন দাঁড়াতে শেখায়। আজীবন নিঃশঙ্কচিত্ত, ভাষাসৈনিক এই মানবাত্মার প্রতি তাঁর পঞ্চম প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জানাই।
লেখক : শিল্পকলা গবেষক, জাদুঘর আন্দোলক
niru.terracotta@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.